Biplab Das

Drama Tragedy Others

3  

Biplab Das

Drama Tragedy Others

৯/১১

৯/১১

7 mins
209


সন্ধ্যাবেলায় পার্টি অফিসে যাওয়ার আগে অচিন্ত্য সান্যালের অন্তত একবার টিভিতে খবর দেখা চাই। তাহলে পার্টি অফিসে আড্ডাটা ভাল জমে। তাছাড়া কোনও বিষয়ে আলোচনা করার সময় হাতে একটু তথ্য থাকলে সুবিধা হয়।আলোচনাটা ভালো হয়। অচিন্ত্য সান্যাল সি পি আই (এম) পার্টির মেম্বার। একটা সময়ে পার্টির ভালো পোস্টে ছিল। এখন স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন। তবে সন্ধ্যাবেলায় একবার পার্টি অফিসে গিয়ে কোনও একটি বিষয়ে আলোচনা না করতে পারলে অচিন্ত্যর রাতের ভাত হজম হয় না।

অচিন্ত্য সান্যাল একা থাকেন। মেয়ে থাকে জার্মানিতে। পড়াশোনা করতে গেছে। স্ত্রী মারা গেছে বছর তিনেক হল। অচিন্ত্য বাবু রাজ্য সরকারের একটি দফতরে কাজ করেন। স্ত্রী কাজ করতেন পৌরসভাতে। স্ত্রীর সাথে পার্টি করতে করতেই আলাপ। দুজনেই পার্টির ওপরতলার লোককে ধরে চাকরিটা পেয়েছেন। অচিন্ত্যবাবুর বাবাও সরকারি চাকরি করতেন। দক্ষিন কলকাতার রামগড়ে অচিন্ত্যবাবুর বাড়ি। তিনতলা বাড়ি, আকারে বেশ বড়ই।

অচিন্ত্যবাবুর কম্যুনিস্ট পার্টিতে কাজ শুরু করেন একজন দেয়াল-লিখন শিল্পী হিসেবে। সেখান থেকে বুথ সভাপতিও একবার হয়েছিলেন কিন্তু চাকরির জন্য পুরো সময় তিনি দিতে পারেননি। তাই তিনি পার্টির একজন সাধারন মেম্বার হিসেবেই রয়ে গেছে। অচিন্ত্যর রাজনৈতিক কোনও স্বপ্ন ছিল না। তাছাড়া তিনি পার্টির কাজ শুরু করেন একটা চাকরির পাওয়ার আশায়ই। তার সেই আশা পূরণ হয় যখন বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসেন। বামপন্থার খুব যে একটা কিছু বোঝেন তাও নয়। ছোটবেলায় ভালো ছবি আঁকতে পারতেন, তাই পার্টির বড়রা তাকে ডাকত দেয়াল লেখার জন্য। দেয়াল লেখা ছাড়া পার্টির মিটিং-মিছিলে যেতেন। মূল উদ্দেশ্য ছিল পার্টির ওপরতলার লোকেদের নেক নজরে থাকা। তাছাড়া যে সময়ে অচিন্ত্যবাবু দেয়াল লেখা শুরু করেন, তার পাড়ায় তখন প্রায় সবাইই কম্যুনিস্ট পার্টি করত। অচিন্ত্যর বাবা সবার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখার কথা বলতেন এবং অচিন্ত্যবাবু তা পালনও করে চলেছেন।

যৌবনের শুরু থেকেই পার্টি অচিন্ত্যবাবুর জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে রয়েছে। প্রথমে পার্টির একটি মেয়েকে পছন্দ হয়েছিল, মেয়েটি ব্রাহ্মণ হওয়াতে পার্টি থেকে বারণ করা হয় ওর সাথে সম্পর্ক রাখতে। অচিন্ত্যবাবু মেনে নেয়। তারপরে অবশ্য পার্টিরই একটি মেয়ের সাথে আলাপ হয়। আলাপ থেকে প্রেম। প্রেম থেকে বিয়ে। আরেকবার পার্টি থেকে জানানো হয় মেদিনীপুরে পোস্টিং নিতে, তিনি নিয়ে নেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন পার্টির নেক নজরে থাকলে অনেক সুবিধা আছে। পাড়ায় এবং অফিস, দুই জায়গাতেই।

                                                                  ***

অচিন্ত্যবাবুর অফিস মহাকরণে। ১২ টায় অফিসে ঢোকেন এবং ৪ টের মধ্যে বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়িতে তিনি একাই থাকেন। বিকেলে বাড়ি ফিরে একটু ফলাহার করেন। তারপর এক ঘণ্টা ঘুম। ছটায় উঠে টিভিতে খবর দেখেন প্রায় সাতটা অবধি। তারপর ধীরে ধীরে পার্টি অফিসের দিকে পা বাড়ান। সকালে রান্নার লোক এসে গোটা দিনের রান্না করে দিয়ে যায়। রাতে পার্টি অফিস থেকে ফিরে সেই খাবার খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েন। একেবারেই নিস্তরঙ্গ জীবন শুধুমাত্র পার্টি অফিসের দুই-আড়াই ঘণ্টা আড্ডা দেওয়া ছাড়া। পার্টি অফিসের আড্ডার বিষয় যে বামপন্থা তা একদমই নয়। খেলা, রান্না এই সব বিষয়েই কথা বেশি হয়। রাজনীতি নিয়ে কথা হয়না বললেই চলে।

সেদিন একটু বেশিই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন অচিন্ত্যবাবু। ঘুম থেকে উঠে দেখে প্রায় ৭-টা বেজে গেছে। বাথরুম থেকে এসেই টিভি চালিয়ে বসেন। টিভিতে সাধারানত রাজ্য-রাজনীতির খবর থাকে। কিন্তু সেদিনের খবর দেখে চমকে ওঠেন অচিন্ত্যবাবু। খবরে দেখাচ্ছে, আমেরিকার সব থেকে উঁচু দুটো বাড়ি, অর্থাৎ ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার, জ্বলছে। খবরে এও বলছে সম্ভবত কোনও জঙ্গি হানা। অচিন্ত্যবাবু বুঝতে পারে বড় কিছু একটা ঘটেছে।

তড়িঘড়ি ছোটেন পার্টি অফিসে। অ্যামেরিকার ওপর যখন আক্রমন তখন নিশ্চয়ই জোর আলোচনা শুরু হয়ে গেছে পার্টি অফিসে। কিন্তু পার্টি অফিসে গিয়ে দেখেন কেউ নেই। পার্টি অফিস পুরো ফাঁকা। খোজ নিয়ে জানতে পারেন সবাই পাড়ার ক্লাবে গেছে টিভিতে খবর দেখবে বলে। অচিন্ত্য ছুটে যায় ক্লাবে। ক্লাবে গিয়ে দেখেন লোক থিকথিক করছে। সবার চোখ টিভির দিকে। সবার সাথেই অচিন্ত্য টিভিতে দেখে কিভাবে ওরকম দুটো উঁচু বাড়ি মাটিতে ধুলিস্যাত হয়ে যায়। কেউ কোনও কথা বলে না। সেদিন রাতে কিছুটা আশাহত হয়েই বাড়ি ফিরে আসেন। ভেবেছিলেন খুব আলোচনা হবে। আলোচোনা হয়, কিন্তু পরের দিন। এর মধ্যে জার্মানিতে একবার মেয়ের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিলেন জানার জন্য ওদের ওখানে সব কিছু ঠিক আছে কিনা। কিন্তু সংযোগ হয়নি। দু-তিন বারের পর আর চেষ্টাও করেননি।

পরেরদিন, অর্থাৎ ১২/৯/২০০১, পার্টি অফিসে অচিন্ত্য পৌঁছে দেখেন বড় বড় নেতাদের ভিড় জমেছে। যারা মূলত এলাকার পার্টির মাথা তারা জড়ো হয়েছে। তাদের আলোচনার একটাই বিষয় - ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের পতন। তাদের কথা বার্তা থেকে এটাই বুঝতে পারা যায় যে এটা যেন হওয়ারই ছিল। তারা এও বলতে থাকে ক্যাপিটালিসমের পতন আসন্ন। তাদের মত যেভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছিল, সেরকম আমেরিকারও পতন হবে।

অচিন্ত্য সান্যাল ভাবতে শুরু করেন তাহলে কি নতুন কিছু হবে? অচিন্ত্য সান্যাল বুজতে পারে এইটুকু যে ঘটনাটির প্রভাব পৃথিবীর রাজনীতির ওপর গভীর ভাবে পড়বে। কিছু একটা হওয়ার আশায় অচিন্ত্য বাবু আরও বেশি সময় করে পার্টি অফিসে থাকা শুরু করে দেয়। এদিকে তখন পশ্চিমবঙ্গে নতুন মুখ্যমন্ত্রী। অচিন্ত্যর ধারনা কিছু একটা নতুন হবেই। টুইন টাওয়ার্স ভেঙে পড়ার দৃশ্য তার মনে গেথে গেছে।

                                                                     ***

অচিন্ত্যবাবু মেয়ের সাথে কথা বলার অনেক চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু বারংবার চেষ্টা সত্ত্বেও যোগাযোগ করতে পারেননা। অচিন্ত্য সান্যাল ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়ে। কি করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। সে ঠিক করে পার্টি অফিসে জানাবেন। পার্টি অফিসে জানানোর পর বলে চিন্তা করার কোনও কারন নেই, কিছু দুর্ঘটনা ঘটলে খবর ঠিক আসত। কিন্তু অচিন্ত্যর দুশ্চিন্তা যায়না। সে ঠিক করে পুলিশকে জানাবে। পুলিশকে জানাও। পুলিশ বলে ব্যাপারটা তারা দেখবে। কিন্তু অচিন্ত্যবাবু বুঝতে পারে এই ব্যাপারে পুলিশ কিছু সাহায্য করতে পারবে না।

এদিকে অচিন্ত্যর অস্থিরতা বাড়তে থাকে। মেয়ের সাথে কথা বলার জন্য মন আনচান করতে থাকে। কিন্তু দিন কেটে যেতে থাকে। যে পুলিশকে তার পছন্দ ছিলনা তদের কাছেই বারবার যেতে শুরু করেন।

একদিন পুলিশ স্টেশনে বসে রয়েছেন এমন সময় অচিন্ত্যদের বিরোধী দলের এক নেতা কোনও একটা কাজে পুলিশ স্টেশনে আসেন। সেখানে তিনি অচিন্ত্যবাবুর মেয়ের জার্মানিতে একপ্রকার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে জানতে পারেন। তিনিই অচিন্ত্যকে জানায় যে জার্মান এমব্যাসিতে গিয়ে খোঁজ নিতে। জার্মান এমব্যাসিতে জানানোর পর তারা অচিন্ত্যকে জানায় যে তারা খোঁজ পেলে জানাবেন।

কিছুদিন পরেই জার্মান এমব্যাসি থেকে অচিন্ত্যকে ডেকে পাঠায়। সেখানে জানানো হয় যে অচিন্ত্যবাবুর মেয়ে কিছুদিনের জন্য আমেরিকা বেড়াতে গেছিল, তারপর তার খোঁজ পাওয়া যাচ্ছেনা। আমেরিকা শুনে অচিন্ত্য ঘাবড়ে যায়। কারন কিছুদিন আগেই একটা বিরাট ঘটনা আমেরিকাতে ঘটে গেছে। অচিন্ত্য পার্টি অফিসে গিয়ে জানায়। পার্টি অফিস থেকে কিছুই বলতে পারেনা। পার্টি অফিসের লোকেরা ‘দেখ কি হয়’ গোছের কিছু কথা বলে ছেড়ে দেয়।

অচিন্ত্য বুঝে পায়না সে কি করবে। কিছুদিন পরে কলকাতায় জার্মান দুতাবাস থেকে দিল্লিতে যাওয়ার কথা বলে। কিন্তু অচিন্ত্যবাবু দিল্লিতে কাউকে চেনে না। পার্টির একটি ছেলেকে বলে কিন্তু সে যেতে অস্বীকার করে কাজের বাহনা দিয়ে। অথচ অচিন্ত্যবাবু জানে যে ছেলেটি কিছু করেনা, সারাদিন পার্টি অফিসে বসে থাকে। অচিন্ত্যবাবুকে শেষে দিল্লি একাই যেতে হয়।

***

দিল্লিতে গিয়ে জানতে পারেন যে, মেয়ে আমেরিকা বেড়াতে গেছিলো বন্ধুদের সাথে। সেখানেই একটি লোকের সাথে আলাপ হয় যার সাথে কোনও একটা কাজে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে গেছিলো। যে মুহূর্তে আক্রমনটি হয়, সেই মুহূর্তে অচিন্ত্যবাবুর মেয়ে সাউথ টাওয়ারে ছিল। লোকটির সাথে সোহিনী, অর্থাৎ অচিন্ত্যবাবুর মেয়েও মারা যায়।

অচিন্ত্যবাবু কিছুতেই মেনে নিতেন পারেন না এই খবর। কি করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। মেয়ের দেহ আমেরিকা থেকে জার্মানিতে এসে পৌঁছেছে। কিন্তু কিছু সমস্যার জন্য জার্মান সরকার সোহিনীর দেহ ভারতে পাঠাতে পারছে না। দেহ আনতে জার্মানিতে যেতে হবে। অচিন্ত্যবাবুর যেটুকু চেনাজানা আছে তা কলকাতায় পার্টির লোকেদের সঙ্গে। অচিন্ত্য বিষয়টি পার্টির লোকজনকে জানায়। কিন্তু পার্টির লোকজন কোনও সাহায্য করতে পারেনা। শেষে বিরোধী দলের প্রধান নেত্রীর তত্ত্বাবধানে অচিন্ত্যবাবুর জার্মানিতে যাওয়া সম্ভভ হয়।

জার্মানিতে গিয়ে অবশ্য কোনও সমস্যা হয়নি। বার্লিনে ভারতীয় দূতাবাসের কাছ থেকে তিনি সবরকমের সাহায্য পান। সোহিনীর দেহ আগেই বার্লিনে চলে এসেছিল।

বার্লিনে গিয়ে অচিন্ত্যবাবু গোটা বিষয়টা কি ঘটেছিল তা জানতে পারে। সোহিনী ওখানে পড়াশুনা করতে গেলেও পড়াশুনা অনেকদিন আগেই লাটে উঠেছিল। পড়াশুনার খরচ চালাতে পারছিলনা। তাই বিভিন্ন রকমের কাজ সে করছিল। শেষে বেশি টাকার আশায় দেহ ব্যাবসায় নামে। তার সুত্রেই একজন আমেরিকানের সাথে আলাপ হয়। লোকটি একটু বয়স্ক গোছের যে বার্লিনে কাজে এসেছিল। তার একজন সঙ্গীর প্রয়োজন ছিল। সে সোহিনীর ফটো দেখে এবং যে এজেন্সির সাথে সোহিনী যুক্ত ছিল তাদের জানায়। তারাই সোহিনীকে লোকটির কাছে পাঠায়।

বার্লিনে কিছুদিন কাটিয়ে সোহিনী লোকটির সাথে আমেরিকা যেতেও রাজি হয়ে যায়। নিউইয়র্কে গিয়ে লোকটির বাড়িতেই ওঠে। লোকটির ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে একটা অফিস ছিল। লোকটি এবং সোহিনী দুজনেই অফিসে ছিল যখন প্লেনটি সাউথ টাওয়ারের পেটের ভিতর ঢুকে যায়। সোহিনী কেন সেই সময়ে অফিসে ছিল তা অবশ্য জানা যায়নি।

গোটা বিষয়টা জানতে পেরে অচিন্ত্য সান্যাল খুবই ভেঙে পড়েন। কফিন বন্দি দেহ নিয়ে দিল্লি হয়ে কলকাতায় ফেরেন। ততদিনে কলকাতায় সবাই জেনে গিয়েছে যে সোহিনী জার্মানিতে কি ধরনের কাজ করছিল। দেহ সৎকার করে অচিন্ত্য বাবু পার্টি অফিসে গেলে সেখানে লোকজনের মধ্যে এক অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করেন। তারা সবাই অচিন্ত্যকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। অচিন্ত্য বুঝতে পারেনা তাকে কি কারনে সবাই এড়িয়ে চলছে?

কিছুদিন পর পার্টি অফিস থেকে অচিন্ত্যকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে সে যেন আর পার্টি অফিসে না আসে। অচিন্ত্য কিছুই বলে। যে পার্টিকে তিনি এত একসময় ভালবেসে ছিলেন তারাই আজ তাকে তাড়িয়ে দিল। সে ব্যাপারটা কিছুতেই মেনে নিতে পারেন না। তিনি বুঝতে পারেন যে সে বড় কোনও নেতা নয় বলেই তাকে এভাবে তাড়িয়ে দেওয়া হল। আর তাছাড়া কলকাতায় কি কেউ বেশ্যাবৃত্তির কাজে যুক্ত নেই? 

কিছুদিন পরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি বিরোধী দলে যোগ দেবেন এবং বাকি জীবনটা রাজনীতি করবেন। বিরোধী দলের কার্যালয়ে গিয়ে অচিন্ত্য তার মনের ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু বিরোধী দলের থেকেও কিছুই স্পষ্টভাবে জানানো হয় না। অচিন্ত্যবাবু বুঝতে পারেন কেউ তাকে চাইছেন না। শেষে আর কোনও উপায় নেই দেখে অচিন্ত্য সান্যাল একরাতে ফ্যানে দড়ি লাগিয়ে ঝুলে পড়েন।

                                ***


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama