ফেসঅ্যাপ
ফেসঅ্যাপ
সুবায়ন টেকনোলজি নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নয়। স্মার্টফোন একটা ব্যাবহার করে, কিন্তু তা বন্ধুদের জোরাজুরির ফলে কেনা। শুধুমাত্র হোয়াটসঅ্যাপটাই ফোনে ইন্সটল করেছে। একপ্রকার ব্যাবহার করেনা বললেই চলে।
সুবায়নের বয়স ৬৫ বছর। অবিবাহিত। মা-বাবা দুজনেই মারা গিয়েছে। কলকাতায় একটা ওয়ান-বি-এইচকে ফ্ল্যাটে থাকে। একটি বেসরকারি অফিসে পার্টটাইম একাউন্টসে চাকরি করে। যা স্যালারি পায় তাতেই কোনোরকমে চলে যায়। একজন কাজের লোক আছে যে রোজ দিন এসে ঘর পরিষ্কার করা থেকে রান্না করা এইসব করে যায়। কলকাতায় সুবায়নের বন্ধুবান্ধব বলতে বিশেষ কেউ নেই। যারা আছে তারা সবাই দেশের বাইরে থাকে, তাদের সংসার নিয়ে।
সুবায়নের মাঝেমধ্যে মনে হয় বিয়েটা সে করলেই পারতো। কলেজে থাকাকালীন একটা মেয়ের সাথে সম্পর্ক হয়েছিল কিন্তু তা বিয়ে অবধি গড়ায়নি। সুবায়ন জীবনের বেশির ভাগ সময়ই নারী ছাড়াই কাটিয়েছে। নারীপুরুষের ভিতর সম্পর্ক কেমন হয় তা ও প্রায় জানেনা বললেই চলে। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে এসে একজন বন্ধুর যে দরকার রয়েছে সেটা বুঝতে পারে।
হঠাৎই চোখটা খবরটার দিকে পড়ে – ‘তিনদিনের ব্যাবধানে প্রায় ১০ লাখ লোক ফেসঅ্যাপ অ্যাপটি ডাউনলোড করেছে’। সুবায়ন খবরটি পড়ে অবাক হয়। একটি অ্যাপের ভিতর কি থাকতে পারে যাতে এত লোক একসাথে অ্যাপটি ডাউনলোড করেছে।
খবরটি পড়ে অবাক হলেও সুবায়ন অত গুরুত্ব দেয় না। তার নিস্তরঙ্গ, ঘটনাবিহীন জীবন কাটতে থাকে। কিন্তু সব কিছু বদলে যায় বিপ্লবের ফোনটা পাওয়ার পরে। বিপ্লব একথা-সেকথা জিজ্ঞেস করার পর বলে, ‘ফেসঅ্যাপ অ্যাপটা ডাউনলোড করেছিস? কি দারুন না অ্যাপটা?’। উত্তরে সুবায়ন বলে, ‘না নামাই নি। খবরের কাগজে পড়েছি যে অনেক লোক ব্যাবহার করছে। কিন্তু ব্যাবহার করে দেখা হয়নি’। বিপ্লব ঠিক এরকম একটাই উত্তর আশা করছিলো সুবায়নের কাছ থেকে। কিন্তু বিপ্লব আশা ছাড়ে না।
‘একবার ডাউনলোড করে দেখ দারুন মজা পাবি। আমরা সবাই ডাউনলোড করেছি। ভীষণ মজার’।
‘আচ্ছা ঠিক আছে দেখব’।
যদিও ফেসঅ্যাপ ডাউনলোড করার কোনও ইচ্ছে সুবায়নের ছিলনা কিন্তু বিপ্লবের ফোনটা পাওয়ার পর সুবায়নের চিন্তা পাল্টাতে শুরু করে। সে ফেসঅ্যাপটা ফোনে ইন্সটল করে নেয়। এবং কিছুদিনের মধ্যেই বাকি সকলের মতন সুবায়ন নিজেও আকর্ষিত হয়ে পড়ে অ্যাপটার প্রতি। সে বিশেষ আকর্ষণ অনুভব ‘এজ’ ফিচারটির প্রতি। সব থেকে মজা পায় যখন সে তার বর্তমান মুখটিকে তার যৌবনের মুখে পরিবর্তন করতে পারে। ছবিগুলো দেখে সে তার যৌবনে ফিরে যেতে চায়। সুবায়নের নিজের অল্প বয়সের কথা মনে পড়ে। সেই ছবিগুলো সে বিপ্লব এবং বাকি বন্ধুদের সাথে শেয়ারও করে। সুবায়ন একপ্রকারে ফেসঅ্যাপে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অফিসে-বাড়িতে সব জায়গায় সে ফেসঅ্যাপ ব্যাবহার করতে থাকে।
কিন্তু অ্যাপের একটা ব্যাপার তাকে খুব বিরক্ত করে তুলেছে কিছু দিন যাবৎ তা হল যখনি অ্যাপটি খুলছে তখনই স্ক্রিনে একটা মেসেজ ভেসে উঠছে – ‘আপনি কি চির যুবক এবং অমর হতে চান? তাহলে নিচের বোতামটা টিপুন’। মেসেজটিতে সে বেশ বিরক্ত হতে থাকে। কিন্তু মেসেজটি সে কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারেনা। যতবারই সে এড়ানোর চেষ্টা করেছে ততবারই স্ক্রিনে মেসেজটি ভেসে উঠেছে।
তাই একদিন একপ্রকার বিরক্ত হয়েই বোতামটি টিপে দেয় কি হয় দেখার জন্য।বোতামটি টেপা মাত্রই একটি অদ্ভুত জিনিস হয়। সুবায়ন ফোনের ভিতর ধুকে যায় এবং গড়াতে শুরু করে। গড়িয়ে গড়িয়ে সে একটি জায়গায় গিয়ে পড়ে। জায়গাটি সুবায়নের চেনা নয়। আগে কখনও সে এখানে আসেনি। তাও জায়গাটা তার চেনা চেনা লাগতে লাগলো। যে জায়গাটায় গিয়ে পড়েছে সুবায়ন সেটা একটা সবুজ প্রান্তর। চারপাশে গাছ-গাছালি। একটা পুকুরও রয়েছে। তার প্রথমে মনে হল কোনও একটা গ্রামে সে এসে পড়েছে। তারপর চারপাশ দেখে মনে হল শহরের ভিতরের একটা পার্ক। কারন চারপাশে অনেক উঁচু উঁচু বাড়ি। সেখান থেকে বেরিয়ে যখন রাস্তায় পড়ল তখন আর বুজতে বাকি রইল না যে সে একটি শহরেই এসে পড়েছে। কিন্তু সুবায়ন কি করবে এবং কেনই বা এখানে এসে পড়ল তা বুঝে উঠতে পারে না। তার এইটুকু মনে আছে সে ফোনের ভিতর ঢুকে যায়। কিন্তু কি ভাবে ঢুকল সেটা সে এখনও বুজে উঠতে পারছে না। তবে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তার জায়গাটি ভাল লেগে যায়। একটা অদ্ভুত প্রান আছে জায়গাটিতে। যেদিকে তাকাচ্ছে সেদিকেই লোক ছুটছে।
কিছুক্ষণ চলার পর একটা রাস্তার মোড় এসে সুবায়ন দাড়িয়ে পড়ে। হঠাৎই সে একটা বিল্ডিং দেখতে পায় যেটা অবিকল তার ফোনটির মতন দেখতে। সে আশ্চর্য হয়ে যায় বিল্ডিংটি দেখে। সে প্রায় সম্মহিত হয়ে এগিয়ে যায় বিল্ডিংটির দিকে। এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করে বিল্ডিংটির ভিতরে যাওয়ার জন্য। বিল্ডিংটির ভিতরে ঢুকে সে আরও তাজ্জব বনে যায়। কোনও লোক নেই ভিতরে। একেবারে খালি। কিছুটা এগোতে সে বিরাট টিভির সামনে গিয়ে থেমে যায়। যেই মুহূর্তে টিভিটার সামনে দাড়িয়ে পড়ে, তখনই টিভিটা অন হয়ে যায় আপনা থেকেই। স্ক্রিনে ভেসে ওঠে একটা মেসেজ – ‘স্বাগত, সুবায়ন’। সুবায়ন অবাক হয় এই ব্যাপারটি ভেবে টিভিটা তার নাম কি করে জানলো। তারপরে আরও একটি মেসেজ ভেসে ওঠে – ‘আপনি এখানে কতদিন থাকতে চান?’। সে কিছু ভেবে ওঠার আগেই অনেক গুলি অপশন ভেসে ওঠে স্ক্রিনে। অনেক গুলি অপশন থেকে সে ২ মাস অপশনটা পছন্দ করে। যদিও সে জানেনা ২ মাস কি করবে এখানে এবং কেনই বা ২ মাস অপশন পছন্দ করেছে।
বিল্ডিংটি থেকে যে মুহূর্তে সুবায়ন বেরোতে যাবে তখনই নিজেকে কাঁচের দরজায় দেখে নিজেকে দেখে চমকে ওঠে। নিজেকে যেন চেনাই যাচ্ছে না। বয়স একধাক্কায় ৪০ বছর কমে গেছে। নিজের কম বয়স দেখে সত্যিই অবাক হয়। তখনি মনে পড়ল মেসেজটার কথা। তাহলে মেসেজটাতে যা লেখা ছিল তা আসলে সত্যি। তাহলে কি তার মৃত্যু নেই। সে কি অমর এবং চির যুবক হয়ে থাকবে?
যেই মুহূর্তে বিল্ডিংটার ভিতর থেকে বেরোল তখন চারপাশ দেখে বুজতে পারল জায়গাটাতে কোনও বার্ধক্যের চিহ্নই নেই। রাস্তায় যারাই রয়েছে তারা সবাই অল্পবয়সী। তাহলে কি এরা সবাই অমরও – এই প্রশ্নটিও তার মাথায় আসে।
কিন্তু সুবায়নের এখন কি কাজ তা সে বুজতে পারেনা। সে শহরটির বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকে। একটা জিনিস সে খেয়াল করে তার কোনও ক্লান্তি আসছে না এবং খিদেও পাচ্ছে না। কিছুটা ঘোরাঘুরির পর তার মনে হয় কথাও একটা থাকার জায়গা তাকে খুজতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে যখন প্রায় শহরের শেষ প্রান্তে এসে পড়েছে তখন একটা পরিত্যক্ত রেলগাড়ি দেখতে পায় সুবায়ন। রাতটা এখানে কোনও রকমে কাটাতে পারলেই হবে।
রেলগাড়ির ভিতরে ঢুকে সুবায়ন একাবারে তাজ্জব বনে যায়। ভিতরটা একেবারে একটা ফাইভ-স্টার হোটেলের মতন। যাকে বলে রাজকীয় ব্যাপার। একটি কামরা সে বেছে নেয়। কামরাটি সুসজ্জিত। আরামের সকল উপকরন রয়েছে। একটি চেয়ারে বসে বিশ্রাম যখন করছে, তখন তার চোখ গেল পাসে রাখা টেবিলটার দিকে। টেবিলটিতে বিভিন্ন পদের খাবার রাখা। খাবারের দিকে চোখ যেতেই তার খিদে পেয়ে যায়। এদিকে কিছুক্ষন আগেই অনেকখানি পথ চলার পরও ক্লান্তি বা খিদে কোনওটাই বুজতে পারেনি। খাওয়া দাওয়ার পরই তার ঘুম চলে আসে।
ঘুম ভাঙার পর কামরাটি থেকে যেই বেরোল তখনই দেখল পাশের কামরাটি থেকেও একজন বেরিয়ে আসলো। একটি মেয়ে। যুবতি, অবশ্যই। মেয়েটি দেখতে সত্যিই সুন্দর। সুবায়নের যেমন নজর মেয়েটির দিকে যায় তেমনই মেয়েটির নজরও সুবায়নের দিকে পড়ে। সুবায়নকে দেখা মাত্র মেয়েটি হাসিমুখে সুবায়নের দিকে এগিয়ে আসে। এসে নিজে থেকেই পরিচয় দেয়। নাম শ্রেয়সী। সুবায়ন নিজের পরিচয় দেয়। কথাবার্তা চলতে থাকে।
শ্রেয়সী জানায় সেও ফেসঅ্যাপের মাধ্যমেই এসেছে। সাথে তার দিদি এবং জামাইবাবুও এসেছে। শ্রেয়সী এও জানায় সে সুবায়নকে পছন্দ করে। এই এত অল্প সময়ের আলাপে কি ভাবে একজন অপরজনকে ভাল লাগতে পারে তা ভেবে আশ্চর্য হয় সুবায়ন।
মাঝে মাঝেই তারা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে একসাথে বেড়াতে যায়। এরই মাঝে সুবায়নের সাথে শ্রেয়সীর দিদি এবং জামাইবাবুর আলাপ হয়ে গেছে। চারজনের বন্ধুত্ব একটা দারুন জায়গায় চলে যায়।
এরই মাঝে সুবায়নও শ্রেয়সীর প্রতি একটা টান অনুভব করে। সুবায়ন তার মনের কথা শ্রেয়সীকে জানায়। শুনে শ্রেয়সী ভীষণ খুশি হয়। দুজনে একসাথে থাকাও শুরু করে। সুবায়ন জীবনে প্রথমবার প্রেমে পড়ার এবং প্রেমে থাকার অনুভুতি কেমন হয় তা বুজতে পারে। এত দ্রুত ব্যাপার গুলো ঘটতে থাকে এবং সবই অনুকূলে হওয়ায় সুবায়ন অন্য কোনও বিষয়ে আর নজর দিতে পারেনি। এরই মাঝে সুবায়ন এবং শ্রেয়সী সিদ্ধান্ত নেয় তারা বিয়ে করবে।
এদিকে সুবায়ন যে মাত্র ২ মাস সময় নির্দিষ্ট করেছে তা শ্রেয়সীকে জানাতে ভুলে যায়। এদিকে বিয়ে হতে আর মাত্র আর কদিন বাকি। শ্রেয়সীই সুবায়নকে জিজ্ঞেস করে সে কতদিন সময় পছন্দ করে অপশন থেকে। যখন জানতে পারে সে ২ মাস সময় পছন্দ করেছে তা শ্রেয়সী শুনে ভীষণ রেগে যায়। সুবায়ন বুঝতে পারেনা কি করবে। ব্যাপার গুলি খুব দ্রুত ঘটতে থাকে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত শ্রেয়সী জানায় উপায় আছে এখানে থাকার। কিন্তু উপায়টি কি সেটা জানায় না। বলে পড়ে জানাবে। রাতে শুতে যাওয়ার আগে আরও একবার সুবায়ন শ্রেয়সীকে জিজ্ঞেস করে উপায়টি কি? কারন সে শ্রেয়সীকে ছেড়ে যেতে চায় না। সে যেকোনো ভাবেই এখানে শ্রেয়সীর সাথে থাকতে চায়। কিন্তু শ্রেয়সী উপায়টি বলে না। জানায় পরদিন সকালে জানাবে। এই বলে ঘুমাতে চলে যায়। শ্রেয়সীর এই আচরণে সুবায়ন আশাহত হয়। কেন এরম আচরণ শ্রেয়সী করছে তা বুঝতে পারেনা। কিন্তু তার কাছে সকালের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।
সে নানা চিন্তা করতে থাকে। কি উপায় শ্রেয়সীর কাছে আছে এই সমস্যা থেকে বেরনোর তা চিন্তা করতে থাকে। সে একবার পাশে শুয়ে থাকা শ্রেয়সীকে দেখে। নানা কথা চিন্তা করতে করতে কখন যে ঘুম চলে আসে বুজতেই পারেনা।
ঘুমের মধ্যেই সে একটি গলা শুনতে পায়। মহিলার গলা। মহিলাটি বলছে, ‘এবার উঠুন। বেলা যে অনেক হল’। সে প্রথমে বিরক্ত হয়। কিন্তু সেই আওয়াজকে সে কিছুতেই এড়াতে পারেনা। আওয়াজ আরও তীব্র হতে থাকে। একসময়ে তার ঘুম ভেঙ্গে যায়।
ঘুম থেকেই উঠেই দেখে সামনে পারুল দাঁড়ানো। হাতে ঝাঁটা। সে অবাক হয়ে বলে, ‘আর কত ঘুমাবেন? ১০ টা বাজে। অনেকক্ষণ ধরে ডাকছি’। সুবায়ন কিছু বুঝে উঠতে পারে না। বিছানার যে পাশে সে বসে ছিল তার অন্য পাশটা দেখে। সেখানে কেউ নেই খালি। বিছানা থেকে নেমে আয়নায় নিজের মুখটা দেখে। চামড়া একেবারেই কুঁকড়ে গেছে। মুখে যৌবনের লেশ মাত্র নেই। পাশেই টেবিলের ওপর ফোনটা রাখা ছিল, কিছুক্ষণ ধরে সেটিকে সে দেখে। তারপর ফোনটি অন করে ফেসঅ্যাপ অ্যাপটির ভিতরে ঢোকে। নাহ, কোনও মেসেজ নেই। ফোনটি বন্ধ করার আগে সে ফেসঅ্যাপ অ্যাপটি ডিলিট করতে ভোলে না।