ভোরের পাখি
ভোরের পাখি


ঝুপ ঝুপ করে পড়া সাদা বরফের চাদরে গ্রামটা মুখ ঢেকেছে।শীতল হাড় কাঁপানো
বাতাস 18 জন মানুষের বুকের হাড় গুলোকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।কিন্তু তাদের সতর্ক
চোখ রয়েছে বন্দুকের ট্রিগারে।ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসছে গ্রামটাকে ঘিরে
ফেলা জঙ্গীদের দল থেকে। এখনো পর্যন্ত যা খবর পাওয়া গেছে 25জন জঙ্গী রয়েছে
দলটাতে।
ক্যাপ্টেন সুবীর বোস বুঝলেন এইভাবে লড়াই করা মানে মৃত্যুরই আর এক
নামান্তর।হাঁটু গেড়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন হনুমান সিংহ এর পাশে।সাংকেতিক
ভাষায় 18 জনকে ডেকে নিলেন।মুহুর্তের অসর্তকতা ডেকে আনবে মৃত্যু।বেশি সময়
নে্ই, খাবারও সীমিত।অস্ত্র ও তাই।আর এই শীতের মধ্যে স্নায়ুও কতক্ষণ কাজ
করবে বিশেষ প্রশ্নের মুখে।
"তোমরা শোন এইভাবে লড়াই করে জঙ্গীদের নিশানা করা সম্ভব না।ওদের ঠিক মত
দেখাও যাচ্ছে না।আবার বরফ পড়ছে, তার ফলে দৃষ্টি বেশিদূর যাবে না।যেভাবে
ওরা আমাদের আক্রমন করছে তাতে বোঝাই যাচ্ছে অস্ত্রের দিক থেকে বা পজিশনের
দিক থেকে ওরা অনেক বেটার জায়গায় রয়েছে।তাই আমি ঠিক করেছি সামনের পাহাড়টার
চূড়ায় আমাদের পৌঁছাতে হবে।ইট ইজ মাই অর্ডার।জানি এটা অনেকটাই
ঝুঁকিপূর্ণ।পাহাড়ে পৌঁছানোর কোন পায়ে হাঁটা পথ নেই।বুঝতেই পারছেন আপনারা,
দড়ির রোপওয়ে ছাড়া পাহাড়ে ওঠার দ্বিতীয় কোন পথ নেই।"-এতটা বলে থামলেন
ক্যাপ্টেন বোস।কথা মত কাজ হতে বেশি দেরি লাগেনা এদের।
ক্যাপ্টেন বোস বললেন 18জনের মধ্যে 8জন নিচে থেকে জঙ্গীদের সামলাবে আমরা
পাহাড়ের চূড়ায় না পৌঁছানো পর্যন্ত।
রোপওয়ের প্রথমে থাকবেন বোস, এরপর সবাই আর শেষে হনুমান সিংহ থাকবেন ঠিক
হল।কথামত দড়ি বেঁধে নিল পরস্পরের কোমরে একে অপরের।ক্যাপ্টেন বোস ধীরে
ধীরে উঠতে লাগলেন
কলকাতার রাত প্রায় ঘুমে আচ্ছন্ন।বাইপাসের বুক চিরে শুধু ছুটে চলেছে কয়েকটা
গাড়ি।অ্যাম্বুলেন্সের ভিতরটা অসম্ভব গুমোট লাগছে।একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি
হয়ে গেছে।জানালাটা খুলে দিলেন দীপকবাবু।মেয কেটে গেছে রাতের আকাশে এক
আকাশ নির্ঘুম তারা।একাদশীর চাঁদটা আলোয় ভরিয়ে তুলেছে আকাশটাকে। দীপকবাবু
মনে মনে ভাবলেন খোকা যেখানে আছে ওখানেও কি চাঁদ এতো আলো ছড়াচ্ছে?খোকা
কি নির্ঘুম রাতে বন্দুকের নল শত্রুর দিকে তাক করে রাতের আকাশটাকে এমনি
ভাবে দেখছে?ও কি জানে আজ ওর জীবনের কত বড় দিন?
বিদিশা আবারো আর্তনাদ করে উঠলো।সুচরিতা দেবী মাথায় হাত বুলিয়ে
দিচ্ছেন।বাইরে থেকে মুখ ফিরিয়ে বিদিশার দিকে মুখ ফেরালো দীপক
বাবু।সুচরিতা দেবী জানতে চাইলেন আর কত দেরি?ব্যস এইটুকুই আর কোনো কথা
যোগায় না।হয়তো নীরব প্রার্থনা ফুটে ওঠে দুটি প্রাণে, খোকার সন্তান আমাদের
বংশধর যেন সুস্থ ভাবে জন্ম নেয়।খোকার কথা দুজনের ভীষণ ভাবে মনে পড়ে।
যন্ত্রণাকৃষ্ট বিদিশারও ভীষণ ভাবে কাছে পেতে ইচ্ছা করে তার সুবীর এর
ভরসার বুকটাকে।না পেয়ে যন্ত্রনাটা যেন আর বেশি করে বেড়ে যায়।
এক সেকেন্ডের এদিক ওদিক।পাশ দিয়ে পর পর দশটা গুলি বেরিয়ে গেল।জঙ্গীরা
দিকহীন ভাবে এলোপাথারি এদিক ওদিক গুলি চালাচ্ছে।তাত্ক্ষণিক তত্পরতায়
মাথাটা সরিয়ে নিলেন ক্যাপ্টেন বোস।মুহুর্তে
ই নিজেকে সামলে নিলেন।পিছনে
ফিরে তাকাবার উপায় নেই।তাই সবাই ঠিক আছে কিনা বোঝবারও উপায় নেই।আরো দ্রুত এগোতে হবে আর মাত্র 5 মিনিট।কিন্তু মুহূর্তের অসতর্কতায় পা পিছলে গেল
ক্যাপ্টেন বোস এর।
আর পাঁচমিনিট মা, একটু ধৈর্য্য ধর, বিড়বিড় করেন সুচরিতা দেবী।অধৈর্য্য হয়ে
ওঠে দীপকবাবু।ড্রাইভার কে আর একটু জোরে যেতে বলেন।হসপিটালের গেটটা দেখা
যায়।গাড়ি থামতেই দ্রুত নেমে এমারজেন্সিতে ছোটেন দীপক বাবু।বেশি দেরি হয়না
অ্যডমিট্ করতে।সাথেসাথেই ওটি রুমে নিয়ে যায় পেশেন্টকে। ওটির লাল আলো
জ্বলে ওঠে।শুধু দুজন বৃদ্ধ মানুষ বাইরে অপেক্ষায় রইলো।একে অপরের হাত
নীরবে স্পর্শ করলো।যেন একে অপরকে বলতে চাইলো, দেখ সব ঠিক হয়ে যাবে কোন ভয়
নেই।
একটা পাথর কিছুটা বেরিয়ে ছিল সেটাকে ধরে কোন ক্রমে বেঁচে যান ক্যাপ্টেন
বোস।এবার আরো সতর্কভাবে উঠতে থাকেন অবশেষে পাহাড়ের সমতল চটি নাগালে পেল
তাদের দলটা।বিশ্রামের কোন অবকাশ নেই। দেহের ক্লান্তি দেহতেই মেরে দিয়ে
নিজের নিজের পজিশন নিয়ে নেয় দশজনে।ধীরে ধীরে যুদ্ধের রেশ চলে আসে তাদের
হাতে।ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই।বরফ পড়াও অনেকটা কমেছে।পূর্ব আকাশটা ধীরে
ধীরে লাল হয়ে ওঠে।বুঝতে পারেন ক্যাপ্টেন সেন, নিচে সব জঙ্গী শেষ।পাল্টা আর
কোন গুলি আসছে না।তবুও অনেকক্ষণ সতর্ক থেকে চারদিকটা উপর থেকে ভাল করে
দেখে নেন।দশজন পরস্পরের কাছে এগিয়ে আসে।আরো একটা বিজয়।সকলে আলিঙ্গন করে
পরস্পরকে সকলের চোখেই আনন্দের অশ্রু।সুবীর এর চোখে ভেসে ওঠে তার
বাবা-মা এর আর তার শক্তি বিদিশার মুখটা।যখন সবাই তার চাকরি পাওয়ার পর ভয়ে
চোখের জলে ভাসছিল তখন বিদিশা তাকে শুকনো চোখে রাজটীকা পড়িয়ে দিয়ে
বলছিল-"দেখো তোমার ক্ষতি কিছুতেই হবে না তুমি একজন বীর সৈনিক হবে।"
দুজনের অপেক্ষা আর শেষ হয় না।ভোরের প্রথম পাখিটা ডেকে উঠল।এখনও
পেশেন্টরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।মাঝে মাঝে এমারজেন্সিতে রুগির আনাগোনা।কোথাও
যেন একটা মন্দিরে ঘন্টা বাজলো।সুচরিতা দেবী হাত তুলে নমস্কার
করলেন।অবশেষে ওটির আলো নিভল দুটি প্রাণের চলত্শক্তি যেন কেউ কেড়ে
নিয়েছে।এগিয়ে যাবারও ক্ষমতা নেই।অবশেষে হাসি মুখে বেরিয়ে এল ডঃ।আপনাদের
নাতনি হয়েছে কনগ্র্যাচুলেসন।ডাক্তার বাবুর হাত আবেগে জড়িয়ে ধরলেন দীপক
বাবু।তাদের খোকার তাদের আদরের ধন সুবীরের মেয়ে হয়েছে।দীপকবাবু মনে হচ্ছিল
একছুটে খোকাকে নিয়ে এসে ওর হাতে তুলে দিতে ওর ছোট্ট পুতুল সোনাকে।এত
আনন্দের মাঝে সুচরিতাদেবীর বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।খোকাই তো এখনও জানল না
তার জীবনের রাজকন্যা আসার সংবাদটা।নার্স এসে খবর দিল মা বাচ্ছাকে বেডে
দেওয়া হয়েছে।
রাজকন্যা দুহাত তুলে বিদ্রোহ করছে তার দাদু ঠাম্মা কে দেখে, যেন বলতে
চাইছে -এই যে আমার বাপিকে না নিয়ে তোমরা কেন এখন এলে বলতো?
বিদিশার পাশে বাচ্ছাটাকে নার্স দিয়ে এল।দুচোখ দিয়ে দেখেও যেন দেখা ফুরায়
না।দুজনের স্বপ্নের ধন।মনে মনে বিদিশা বললো -তোমার ধন তো এনে দিলাম এবার
তুমি কবে আসবে সুবীর?তোমার ধন কে তোমার হাতে তুলে দেব কবে?তোমার রাজকন্যা
তার বাবার অপেক্ষায় রয়েছে।