পদ্মটি নাই
পদ্মটি নাই
রোদে ঘরটা পুরো ভরে উঠেছে।ধড়ফড় করে শেফালী উঠে বসে।শরীর দিচ্ছে না।সারা
রাতে বাবুদের ক্ষিদে মিটিয়ে নিজেকে নিঃস্ব করে ভোরে ঘুম।তবুও উঠতে হবে।
মাসীর ঘরে মেয়েটাকে রাতে রেখে আসে, হয়তো এতবেলা পর্যন্ত কিছু খাওয়াই জোটে
নি।নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে শেফালী মেয়েকে ঘরে নিয়ে আসে।দুটো মুড়ি আর একটু
ছোলা ভাজা দেয়।গোগ্রাসে খেতে থাকে ঝিনুক।মেয়ের দিকে তাকিয়ে দুচোখ জলে
ভরে আসে শেফালীর।খাওয়া শেষ করে ঝিনুক দুহাতে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে
আব্দারের সুরে বলে,-"মা আজ তো লক্ষী পুজা।আমার স্কুলের সব বন্ধুদের বাড়িতে
হয়।আমাদের করো না মা?"
ঝিনুক মায়ের হাত ধরে বেরোয় পূজার সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের কেনাকাটি
করতে।একটা ছোট্ট মত লক্ষীর মূর্তিও কিনে আনে।মা মেয়ে দুজনে মিলে মনের
খুশিতে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলে ওদের ঘর।অপূর্ব আলপনায় ভরে ওঠে ঘরের
মেঝে।ঝিনুক তার সব থেকে পছন্দের জামাটা আজ পরেছে।যেন স্বয়ং মা লক্ষী নেমে
এসেছে ঝিনুকের রুপে।
"কিরে তোরাও আবার লক্ষী পূজা করিস?"-কথাগুলো বলে ঘরে ঢুকতে ঢুকত বিকৃত
হাসিতে ভরিয়ে তোলে সমাজের একজন নামকরা বিখ্যাত ব্যাক্তি।শেফালী করুণ
দৃষ্টি মেলে তাকায় বাবুর মুখের দিকে।আজকেই এই বাবুকে আসতে হল !হায়রে আজ তা
হলে মাসী আর তাকে ছুটি দেবে না।অস্ফুটে বলে ওঠে শেফালী,'' আজ এলেন?''বিছানায়
বসতে বসতে বাবু বলেন,-"হ্যাঁ রে কদিন তো বাইরে ছিলাম ব্যাবসার কাজে।আজ
গিন্নীর কড়া হুকুম বাড়িতে পূজা, বাড়ি এস। বাড়ি এলাম তাই একটু ঘুরে যাই
তোদের এখানে ভাবলাম। তবে বেশিক্ষণ আজ থাকতেও পারব না।আমার বাড়িতে তো আবার
বিশাল লক্ষী পূজা হয়।অনেক লোকজন নিমন্ত্রিত।যদিও লোক আছে, তবু আমাকে ও তো
একটু থাকতে হবে কি বলিস?"-কথাগুলো শেষ করে দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেয় বাবু।
অন্ধকার ঘরে মাটির লক্ষী মূর্তির চোখে যেন চিকচিকে জল দেখতে পায়
শেফালী।অদূরে পরে থাকা ফুলের মালাগুলো তখন ধীরে ধীরে শুকাতে থাকে।
লক্ষী দুপুর থেকে রাস্তায় বসে পড়েছে মালা,ফুল নিয়ে।আজ দিনটা বেশ ভালো
লাগে ওর।অন্য দিনের চেয়ে অনেক বেশী বিক্রি হচ্ছে।আর মাত্র কটা মালা
বাকি।মায়ের খুব ইচ্ছা বাড়িতে লক্ষী পূজা করে৷ আগে যখন বাবা বেঁচে ছিল,
প্রতিবছর পূজা হত।তারপর কোথা থেকে কি যে হয়ে গেল! ট্রেনের হকার ছিল বাবা,
সেদিন ভোরে কাজে বেরোলো কিন্তু উফ্ আর ভাবতে পারে না লক্ষী, বাবার সেই
ক্ষতবিক্ষত দেহটার কথা।তারপর তো শুধুই পেটের চিন্তা।পূজা এসব তো বিলাসিতা
ওদের জীবনে।কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে লক্ষীর বুঝতে বাকি থাকে না
মায়ের মনের ইচ্ছাটা।তাই লক্ষীর এবারে ইচ্ছা মাকে চমকে দেবে পূজার আয়োজন
করে।
লক্ষীর দুহাতে পূজার জিনিস পত্র ভর্তি। আকাশের কোজাগরীর চাঁদের আলো
লক্ষীর ছেঁড়া শাড়িতে সোনার রুপ ফুটিয়ে তুলেছে।লক্ষীর কালো ঘামে ভেজা
মুখের সর্বাঙ্গ সুন্দর রুপ বোধায় আজ চাঁদের রুপকেও ম্লান করে দিয়েছে।
মৌ অফিসের ব্যাগটা টেবিলে রেখে সোমের দিকে এগিয়ে গেল।বেচারা বোধ হয়
ঘুমাচ্ছে।দূর থেকেই শুনতে পায় মৌ শাশুড়ির কটু কথাগুলো -"মহারাণির আসা
হল?আমার কেন মরণ হয় না, ছিঃ ছিঃ বাজারে মেয়েছেলে একটা। রাত আটটা পর্যন্ত
অফিস করছেন উনি।পূজার দিনে কোন্ বাড়ির বউ...."-আর শুনতে পারে না মৌ,
ওয়াশরুমে ঢুকে যায়।শাওয়ারটা অন করে দেয়।জলের ধারা দিয়ে মৌ যেন ধুয়ে ফেলতে
চায় তার শরীরের সমস্ত পাঁকগুলো।
একটা শুকনো পোশাক পরে ছাতে উঠে আসে মৌ।আকাশে কোজাগরীর গোল চাঁদ।মনে মনে
ভাবে মৌ, ছোট বেলায় মা বলতো এই চাঁদের থেকে যা চাইবি তাই পাবি।দুচোখ থেকে
জলের ধারা নেমে আসে মৌ-এর গাল বেয়ে।''-এই নরক যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দাও
আমায়।''-অস্ফূটে বলে মৌ।মাঝে মাঝে ভাবে জীবনকে শেষ করে দিয়ে সব জ্বালা ওর
শেষ করে দেবে।কিন্তু পারে না শুধু পঙ্গু সোমের কথা ভেবে।বৃদ্ধা শাশুড়ি আর
অসহায় সোমের ওছাড়া আর কেই বা আছে।ছিল, সবাই ছিল যখন, সোম বড় চাকরি করতো সুখসম্পদে পরিপূর্ণ ছিল ওদের সংসার।কিন্তু সোমের বাইক এ্যাকসিডেন্টের পর
থেকে কোথায় যেন অদৃশ্য হতে থাকে চেনা পরিচিত মুখগুলো, শুধু একজনই পাশে
থাকে তখন, সোমের বস।কিন্তু মৌ তখন ঘুনাক্ষরেও ভাবে নি ঐ সুন্দর মুখের
আড়ালে ছিল একটা হায়নার মুখ।যখন বু্ঝলো, তখন অসহায় মৌ এর আত্মসমর্পন করা
ছাড়া উপায় ছিল না।সোমের ঐ বিশাল চিকিত্সা চালাবার আর কোন উপায় মৌ এর
কাছে ছিল না।নিচের পূজার ঘর থেকে শাঁখের আওয়াজ আসে।মৌ নষ্ট মেয়ে মানুষ
তাই ওর কোন অধিকার নেই শাশুড়ির ঠাকুর ঘরে প্রবেশের।সোমের চোখেও মৌ দেখে
সেই ঘৃণার দৃষ্টি।তাই সব কিছু থেকে মৌ নিজেকে গুটিয়ে রাখে।ছাদের কার্ণিস
ধরে দাঁড়িয়ে থাকে মৌ। চোখ থেকে জল ঝরে পড়ে মাটিতে।মৌ তার চোখের জলেই পূজা
করে অলক্ষ্যে দাঁড়িয়ে থাকা মা লক্ষীর।মা-ও বোধ হয় বলে চলে,-"তুই তো আ্মি ,আমিই
তো তুই।"
রামবাবু খেয়ার হাতটা ধরে কিছুএকটা বলতে চান।কিন্তু একটা হালকা গোঙানী
ছাড়া কিছুই বোঝা যায় না।
খেয়া ঝুঁকে পড়ে বাবার বুকে হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করে,'' কিছু বলছো
বাবা?''কিন্তু কোনো কথাই বার হয়না ।শুধু দুহাত জড়ো করে প্রণামের ভঙ্গী করেন,
আর দুচোখে বয়ে চলে জলের ধারা।ধীরে ধীরে মাথাটা এলিয়ে যায়।খেয়া বাবার বুকে
মুখ গুঁজে অস্ফুটে কেঁদে ওঠে।বাবার শেষ বলতে চাওয়া কথাগুলো খেয়ার কিন্তু
বুঝতে বাকি থাকে না।
" তুমি নাকি বলেছ বিয়ে করবে না।শোন খেয়া এইসব ধিঙ্গিপনা আমার বাড়িতে
চলবে না।পড়াশোনা করতে হয় বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে করবে।একেই তো গায়ের রঙ মা
কালিকে হার মানাবে..."-শেষের কথাগুলো আস্ফুটে বলতে বলতে বেরিয়ে যায়
রামুবাবু।খেয়া শুধু জলভরা চোখে তাকিয়ে থাকে।একে মেয়ে তার উপর কালো, তাই
চিরকাল অবজ্ঞার পাত্রী খেয়া নিজেকে যতটা পারে লুকিয়ে রাখে সবার চোখের
আড়ালে।কিন্তু বিয়ের কথা শুনে প্রতিবাদ না করে ও পারেনা।সেদিন রাতে খেয়া
ঘর ছাড়ে। তারপর 'আলো দিদিমণির' সাহায্যে ও কিভাবে প্রফেসর হয়ে উঠলো, সে আর এক
কাহিনী।কদিন আগেই খেয়া খবর পায় বাবার আদরের তিন দাদা বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে
পাঠিয়েছে। খবর পেয়েই খেয়া বাবাকে নিজের কাছে আনে।অক্ষম বাবার সব সেবার
ভার নেয় নিজের হাতে।
বাবার কাজ মিটিয়ে খেয়া গাড়িতে ফিরছে, আকাশে তখন কোজাগরীর চাঁদ মিটিমিটি
হাসছে মর্ত্যের লক্ষী দের দেখে।দূর থেকে ভেসে আসছে-"লক্ষী যখন আসবে তখন
কোথায় তারে দিবি রে ঠাঁই.দেখরে চেয়ে..।"
#positiveindia