Bhaswati Ghosh

Drama Tragedy

2.8  

Bhaswati Ghosh

Drama Tragedy

আশাভরি

আশাভরি

5 mins
16.7K


আলাপ থেকে সবে বিস্তারে ধরেছে লোডশেডিং।একেবারে ঘন অন্ধকারে ঢেকে যায় ছোট্ট কটেজটা।সমীরণবাবু পাশের ঘর থেকে ছুটে আসার সাথে সাথেই শুনতে পান চু়রমার করে ভাঙার শব্দ।কিছুর সাথে অন্ধকারে পায়ে ঠোক্কর লেগে নখের কিছুটা অংশ উঠে যায়।যন্ত্রনায় পা চেপে বসে পরেন।নার্স আর কাজের মাসী দুজনেও সামলাতে ব্যর্থ।সমীরণবাবু কষ্ট চেপেই পাশের ঘরে গিয়ে ইনভাটারটা অন্ করে গানটা আবার চালু করে দিলেন।কিন্তু ভরি তখনো একই ভাবে তান্ডব চালিয়ে যাচ্ছে।আর সামলাতে না পেরে এই প্রথম একটা চড় বসালেন ভরির গালে সমীরণবাবু।এবার কিছুটা আয়ত্ত্বে এল ভরি।জলভরা চোখ তুলে তাকালো সে।হঠাত্‍ পাশে পড়ে থাকা ফলকাটা ছুরিটা তুলে নিয়ে অদক্ষ হাতে চালিয়ে দিল নিজের কবজি ঘেঁসে।সমীরণবাবু আর মাসীর প্রচেষ্টায় কিছুটা সময় নিয়ে তাকে শান্ত করেই ইঞ্জেকশান পুশ্ করলেন নার্স।ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়লো ভরি।ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো অডিও প্লেয়ারটির দিকে।নতুন করে আবার আলাপ শুরু হয়েছে।মাথাটা নিজের মনেই দোলাতে শুরু করল ভরি।সমীরণবাবু তার পায়ের কাছে বসে মাথা ঠুকতে লাগলেন গায়ে হাত তোলার অনুশোচনায়।নার্স আর কাজের মাসী চোখের জল মুছে একটু ঘরের বাইরে বেরিয়ে যায়।

সমীরণ সিনহা আই.টি সেক্টরে কর্মরত আর স্ত্রী মালবিকা প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় সংগীত গায়িকা।বিদুষী উপাধিপ্রাপ্ত অল্পবয়সেই।তার সাথে এক ব্যাক্তিত্ব আর স্নিগ্ধতা জাগানো রূপ।একঢাল কেশ রাশির সাথে মানানসই ঈষত্‍ ডিম্বাকার মুখ।স্লিম আর দীর্ঘকায় গঠনের সাথে কাঁচা সোনার মত ঈর্ষনীয় গায়ের রঙ।যে কোনো ফাংশানে শুধুমাত্র মঞ্চে তাঁর উপস্থিতিই পিনড্রপ্ সাইলেন্স সৃষ্টি করে, এরপর তার দীর্ঘদিনের রেওয়াজি গলার মনোহরণকারি সুর ক্ষণিকেই শ্রোতাদের মনে সৃষ্টি করে এক স্বর্গীয় মুগ্ধতা।মোট কথা মালবিকা সিনহা হলেন এমন এক বিদুষী যার উপস্থিতি যে কোনো সভাতেই তাঁকে মক্ষিরানী করে তোলে তাঁর নিজের অজান্তেই।মালবিকাদেবী আর সমীরণবাবুর একমাত্র সন্তান হল আশাভরি সিনহা বা ওরফে ভরি সিনহা।ভরি ছোট থেকেই তার মায়ের এই পরচিতিতে বেশ গর্বিত বোধ করত নিজেকে।কিন্তু ধীরে ধীরে শ্যামলা, পড়াশোনায় মিডিয়াম সবরকম আকর্ষণহীন ভরি যেন আত্নীয় পরিচিতের ভিড়ে হয়ে উঠতে থাকে এক বড়ো জিজ্ঞাসা চিহ্ন-"তুই মালবিকার মেয়ে?মালবিকা এটা তোর মেয়ে বোঝাই যাচ্ছে না। দিস ইজ আনবিলিভেবল!''এই রকম বহু প্রশ্নের তীক্ষ্ম খোঁচায় ভরি বিদ্ধ হতে থাকে ছোট থেকেই।কোন ফাংশানে মায়ের সাথে গেলে উদ্যোক্তাদের কৌতূহলি প্রশ্ন 'আশাভরি আপনার মেয়ে ম্যাডাম?'মায়ের ''হ্যাঁ'' উত্তরের পরে কতকগুলি বিস্মিত দৃষ্টি ফালাফালা করতো ভরির

অস্তিত্বের প্রশ্নকে।যেন নীরব চোখ গুলো বলে যেত মালবিকা সিনহার মেয়ে,মিডিয়াম আশাভরি সিনহা যেন সাধারণ হয়ে মস্তবড় অপরাধের ভাগীদার।কোনো ফাংশানে মায়ের সাথে সংগতের পরে মায়ের ছাত্রছাত্রীরা যখন তৃপ্ততার চাদরে গা ঢেকে ঘরে ফিরত, ভরি তখন স্টেজ থেকে নামত প্রত্যাশার চাপে ব্যর্থ হয়ে টলোমলো পায়ে।অডিয়েন্সের কতকগুলো কুঁচকে যাওয়া চোখ বলে যেত 'ইস্ মালবিকা সিনহার মেয়ের এত পুয়োর পারফমেন্স!'ধীরে ধীরে আশাভরি নিজেকে গুটিয়ে ফেলতে থাকে গুটির আড়ালে।মালবিকাদেবী আর সমীরণবাবু কিন্তু কখনোই চাইতেন না তাদের ভরি চাপা পড়ুক ওনাদের ব্যক্তিত্বের আড়ালে।তাঁরা বুঝতেন মালবিকা কিন্তু পৃথিবীতে সবাই নয়, পৃথিবীর আশি শতাংশ মানুষই আশাভরি।সেইসব আশাভরিরা কিন্তু পৃথিবীর বোঝা নয়, তারা সকলেই নিজের আকাশে তাদের রঙীন ডানা মেলে বেঁচে আছে।তাঁরাও চাইতেন ভরি গুটিপোকা কেটে বেরিয়ে এসে তার রঙীন ডানা মেলুক মুক্তবাতাসে।কিন্তু বিভিন্ন অনুষ্ঠান,পারিপার্শ্বিক কমিউনিটি ক্রমাগত বদ্ধ করে দিতে থাকে তার মুক্ত আকাশকে অসম তুলনা টেনে মা ও মেয়ের মধ্যে।তুমি বাপু স্টার এর মেয়ে তাই তোমাকেও হতে হবে স্টার। এ এক যেন অলিখিত নিয়ম ভরির চারপাশের সমাজের কাছে।তুমি সাধারণ হতে পার না এ তোমার অপরাধ, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।তার ফলে ভরির যা কিছু নিজস্ব সত্ত্বা ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকে।ভরির কাছে সঙ্গীত প্রাণের আরাম মনের শান্তি না হয়ে,হয়ে উঠতে থাকে গরম শলাকা।ক্রমশ ভরির অজান্তেই ভরির মনে ঠাঁই নেয় মায়ের প্রতি চরম এক ঈর্ষা।

মা মেয়ের সম্পর্কের মধ্যে রচিত হয় এক গভীর খাদ।এইসময় হঠাত্‍ করেই সময়ের ঘরে পড়ে উল্টো দাবার চাল।মালবিকাদেবীর শরীর ক্রমশ ভেঙে পড়তে থাকে। প্রথমদিকে ব্যস্ততার আড়ালে তা সকলের চোখ এড়িয়ে যায় কিন্তু, হঠাত্‍ করেই দীর্ঘ কাশির চিকিত্‍সায় গিয়ে ধরা পরে রক্তে পড়েছে মারণরোগের থাবা।সমীরণবাবু ওনার সর্বস্ব উজাড় করে দেন চিকিত্‍সার পেছনে।পাগলের মত ছুটে বেড়ান চিকিত্‍সার জন্যে কিন্তু তখন বড় দেরি হয়ে গেছে।এতকিছুর মধ্যে একমাত্র ভরি হয়ে থাকে নির্বিকার।কেমোর প্রভাবে মালবিকাদেবীর কালো হয়ে যাওয়া কুঞ্চিত চামড়া,রোগগ্রস্ত অকাল বার্ধক্য তাকে দিতে থাকে পৈশাচিক এক আনন্দ।ভরি আয়নার সামনে মাপতে থাকে নিজেকে ,সে কতটা তার মায়ের থেকে এখন এগিয়ে রয়েছে রূপের আকর্ষণে। মালবিকাদেবি আর রেওয়াজ করতে পারেন না ,গান ওনার রক্তের প্রতিটা কণায় মিশে, তাই সেই গান ছাড়া হয়ে পড়েন অসহায়।রোগের কষ্টের থেকেও যেন এ অসহায়তা তাকে আরো বেশি কষ্ট দিতে থাকে।ভরি সেই অসহায়তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে থাকে। সমীরণবাবু মালবিকাদেবীর কিছুটা কষ্টের লাঘবের আশায় চালিয়ে দিতেন একের পর এক বন্দিশ অডিও-প্লেয়ারে।কিন্তু ভরি হয়ে ওঠে নিষ্ঠুর আছড়ে ফেলে অডিও প্লেয়ার।"এটা কোন

বাইজী'বাড়ি নয় যে দিনরাত গান চলবে"-অসুস্থ, আহত,বিস্মিত মালবিকাদেবীর চোখের উপর আঙুল নেড়ে কথা গুলো বলে পরম তৃপ্তিভরে চলে যায় ভরি।সমীরণবাবু কিছু বলতে গেলে বাধা দেন মালবিকাদেবী।এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরেই মালবিকাদেবী সব চাওয়া পাওয়ার হিসাব চুকিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।ভরি দেখতে থাকে মালবিকাদেবীর দেহ ঘিরে জ্বলে এক লেলিহান শিখা।যে সৌন্দর্য্য মালবিকাদেবীকে দিয়েছিল সকলের ঈর্ষা,গর্ব,ভালবাসা সেই দেহই আজ আগুনে ভস্মীভুত।সমস্ত সন্মান প্রতিপত্তি আজ পিছনে পড়ে, মানুষটাই আজ চিরতরে মুছে

গেল।ভরি বুঝতে পারে মায়ের সাথে তার চির পাথর্ক্য কিভাবে যেন ঘুচে গেছে সময়ের প্রলেপে, শুধু তারই যেন বুঝতে বড় সময় লাগল।কিছুটা ঘোরের মধ্যে ভরি বাড়ি ফেরে।হঠাত্‍ করেই শূণ্য ঘর ভরিকে গিলতে আসে।রাতের বেলা সবার অলক্ষ্যে গিয়ে দাঁড়ায় মায়ের ঘরে।মায়ের ব্যবহার করা পোশাক,প্রসাধন,ঘরে সাজানো প্রতিটা শোপিস,বইয়ের থাক,গানের ইন্সট্রুমেন্ট সবই রয়েছে একই ভাবে শুধু তাদের মালিকই আজ অদৃশ্য।মায়ের হাতে বসানো ফুলের টবে রঙীন অর্কিড।ভরি ছুটে বেড়ায় এক ঘর থেকে আর এক ঘরে, অস্থিরভাবে কাকে যেন খোঁজে।মায়ের পোশাকে খোঁজে ছোট বেলায় পাওয়া সেই মায়ের গন্ধ।অস্থির ভরিকে সমীরণবাবু চেপে ধরেও শান্ত করতে পারেন না ,খুঁজে পাননা তার অস্থিরতার কারণ।এমন সময়েই ভরির চোখে পড়ে,টেবিলে উপরে থাকে পেনড্রাইভটা।কম্পিউটারে সংযুক্ত করে সে। ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পরে মালবিকার সুললিত কন্ঠ।আশাভরির চোখে এই প্রথম মায়ের মৃত্যুর পরে বৃষ্টি নামে মেঘমল্লারের ছোঁয়ায়।এরপর থেকে এই গানগুলিই হয়ে ওঠে আশাভরির সকাল,দুপুর,রাত।মুহূর্তকালের বিরতি করে তোলে তাকে উত্তাল।বহু চিকিত্‍সাতেও সাড়া দেয়নি ভরির অবুঝ মন।

আশাভরি ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।সমিরণবাবুর উঠে যাওয়া নখ থেকে রক্ত পড়তে থাকে তখনো।নার্স মেয়েটি ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেয়।"আপনি এবার ডঃ বাসুর পরামর্শ মেনে নিন।দিন দিন ফল করছে ওর কন্ডিশন, আরও ভায়োলেন্ট হয়ে পড়ছে ও।এই অবস্থায়..."নার্সের কথা শেষ হবার আগেই সমীরণবাবু নিজের ঘরে উঠে আসেন।নিজের সাথে যুদ্ধ শেষে ডায়াল করেন ডঃ বাসুর নং।সকাল থেকে সূর্য আজ মেঘের আড়ালে।দিনের শুরু হলেও এখনো যেন কাটেনি রাতের অন্ধকার।সমীরণবাবুর চোখের জলে ধুয়ে যেতে থাকে মালবিকাদেবীর ছবিতে জমে থাকা সব ধুলো।দেখ, দেখ মালবিকা, তোমার আশাভরি আজ কত দূরে চলে যাচ্ছে তার

বাবার কোল ছেড়ে।এমন কেন হল মালবিকা?-সমীরণবাবুর কন্ঠ চিরে বেরিয়ে আসে এক সর্বস্ব হারা পিতার হাহাকার।আশাভরির ঘোর লাগা চোখ খুঁজে ফেরে তার বাবাকে।সমীরণবাবু দাঁড়াতে পারেন না তার বিদায় বেলায়।আশাভরির খাঁচা ঘেরা গাড়ি যখন পথের বাঁকে তখন শূণ্য ঘরে মালবিকার কন্ঠস্বরে ছড়িয়ে পড়েছে তেহাই এর ওঠা পড়া আশাভরির উপর।

#positiveindia


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama