Bhaswati Ghosh

Drama

3  

Bhaswati Ghosh

Drama

প্রতিধ্বনি

প্রতিধ্বনি

12 mins
1.9K


রোদ্দুটা এবার সরাসরি বারান্দায় এসে পড়েছে।অয়ন্তিকা কিছুটা ছায়া ঘেঁসে টেনে নিয়ে যায় আরাম কেদারাটা। ফাগুনের শেষের দিকের রোদ্দুর ,বেলা দশটাতেই মাথায়। অয়ন্তিকাদের বাড়ির কাছেই একটা ছোটখাটো বাজার বসে। দোতলার বারান্দা থেকেই নজর পড়ে।বাজার চলতি মানুষজনেরও যে কৌতুহল রয়েছে বারান্দার দিকে অয়ন্তিকা তা ভালোই জানে। প্রথম কয়েকদিন অস্বস্তি লাগলেও এখন সবই গা সওয়া হয়ে গেছে তার।কাঁহাতক বন্দী থাকা যায় ঘন্টার পর ঘন্টা চার দেওয়ালের মাঝে!


মাত্র তো কয়েকটা মাস আগেও ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা ভরা জীবনে ফুরসতের অবসর মেলা ছিল ভার। এখন এই দীর্ঘ অবসর যেন পঙ্গুত্ব বয়ে এনেছে তার জীবনে।

মায়ের হাঁক কানে আসে।ব্যস্ততা ছাড়াই ধীরে ধীরে নিচে নামে। কিছুক্ষণ খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া চলে। আবারও উঠে আসে বারান্দায়। সুলেখা দেবী কিছুটা সময় নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকেন মেয়ের দিকে। তারপর হালকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পড়ে থাকা খাবার গুলো ফেলে দেন ডাস্টবিনে।নিঃশব্দেই মুছে নেন গাল বেয়ে নামা চোখের জল।আর আরো একবার অলক্ষ্যের ইশ্বরকে দুষতে থাকেন নিজের ভাগ্যকে দোহাই দিয়ে।

দুপুর দুটো,খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে মা টিভি নিয়ে বসেছে। অয়ন্তিকা তাক থেকে টেনে বার করে সময় কাটাতে ফ্যামিলি অ্যালবামটা।

কলিং বেলটা বেজে ওঠে।হয়তো কোন শুভানুধ্যায়ী!মাথা ঘামায় না সে।জানে মা-ই সামলে নেবে।

অয়ন্তিকা বারান্দায় এসে বসে।রোদটা এখন বারান্দায় থাকে না তবু হালকা তাপের একটা হলকা রয়েছে। উঠে যাবে ভেবেও তবু চুপচাপ বসেই থাকে । কেমন যেন একটা আলসেমি ভর করে।এই সময় রাস্তাটা প্রায় ফাঁকা থাকে।দু-একটা সাইকেল যাত্রী পার হয় রাস্তা দিয়ে।কয়েকটা স্কুলের বাচ্চা কি যেন কথায় হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে একে অপরের গায়ে। খানিকক্ষণের মধ্যে তারাও  হারিয়ে যায় গলির মোড়ে। শুধু কারো একজনের হাত থেকে পড়ে যাওয়া কাঠি আইসক্রিমটা গলতে থাকে রাস্তার তাপে। পরিত্যক্ত সব্জী, ছেঁড়া চটের অংশ আরও এটা সেটা ছড়িয়ে রয়েছে ভেঙে যাওয়া বাজারে এধারে ওধারে । অয়ন্তিকা তার দোতলায় বারান্দা থেকে কখন যে হারিয়ে গিয়েছিল এসব দৃশ্যের মাঝে নিজেরও মনে নেই। হঠাৎ ঘোর ভাঙে কাঁধে হালকা ছোঁয়ায়….।

স্যার!!!!!!!


(২)

'আসতে পারি'?

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না অয়ন্তিকা। বিখ্যাত নাট্য অভিনেতা ,আজকে তাদের কলেজ ফেস্টের নাট্য প্রতিযোগিতার প্রধান বিচারক অম্বর স্যানাল মেকাপ রুমে তার কাছে!!!!

প্রস্তাবটা যেন স্বপ্নের মত লাগে অয়ন্তিকার কাছে।অত বড় নাট্য গোষ্ঠীতে তারমত আনপর একজনকে সুযোগ দিচ্ছে তাও এতবড় নাট্য পরিচালক নিজে এসে!!!

নিজের গায়েই নিজে চিমটি কাটে সে।

তবে যতটা সহজ অয়ন্তিকা এতদিন নাটকে অভিনয়কে ভেবে এসেছে আজ সঠিক ভাবে হাতে কলমে শিখতে এসে সে বুঝতে পারে অতটা সহজ আদপে নাটকে অভিনয় নয়। কলেজ ফেস্টে নাটক করা আর গ্রুপে নাটকের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। এখানে অভিনয় এক সাধনা।আর স্টেজ হল সাধনালয়। কিন্তু নিজের সহজাত ক্ষমতায় আর পরিশ্রমের মূল্যে অয়ন্তিকা ক্রমেই নাট্যগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ অভিনেত্রী হয়ে ওঠে কিছু দিনের মধ্যেই।সেই দিনটা অয়ন্তিকার আজও মনে পড়ে……

;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;;

নাট্যগ্রুপগুলির মধ্যে​ অয়ন্তিকার শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসাবে জায়গাটা যথেষ্ট পোক্ত হয়েছে।ইতিমধ্য সময় অনেকটা পার হয়েছে।তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষাও শেষ হয়েছে।অয়ন্তিকার অভিনেত্রী হিসাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল ছোটবেলা থেকেই সে কত্থক আর খেয়ালের তালিম নিয়ে আসছে তাই অভিনয়ের পাশাপাশি নাচ আর গানের বিষয়টিও তাকে মঞ্চে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

এই সময়েই সম্ভবত শিশির মঞ্চে গ্রুপের একটি নাটক পরিবেশিত হচ্ছিল। নাটকটার নাম আজ ঠিক করে মনে পড়ে না তবে নাটকে এক আধুনিকার চরিত্রে সে ছিল এটুকু তার মনে আছে। তার বলিষ্ঠ অভিনয় যে দর্শকদের মন কেড়েছিল তা ঘন ঘন করতালিতেই বোঝা যাচ্ছিল। এছাড়া একটা তার নিজের কন্ঠে পপ গান ও সাথে ড্যান্সও দর্শকদের অভিভূত করেছিল।তা স্টেজের ওপারে বসা দর্শকদের অভিব্যক্তিই অয়ন্তিকাকে বলে দিচ্ছিল।নাটক শেষে মেকাপ রুমে যখন ফ্রেস হচ্ছিল অয়ন্তিকা তখনই প্রবেশ করেছিলেন বিখ্যাত আ্যড নির্মাতা দেবেশ শর্মা। প্রাথমিক আলাপ পর্ব শেষে সরাসরিই প্রস্তাবটা দিয়েছিলেন তিনি….।

অয়ন্তিকা প্রথমে তো ওনার করা অফারের মানেটাই বুঝে উঠতে পারছিল না।প্রাথমিক বিহ্বলতা কেটে যাবার পর কিছুটা সময় নিয়েছিল সে।তিনদিন ধরে কখনো তার মন বলেছিল প্রস্তাবটা তার কেরিয়ারের মোড় বদলে দেবে পরক্ষণেই মনে হয়েছে এ পথ তার জন্য নয় একটা মিডিলক্লাস ফ্যামিলির ছোট্ট এই মফঃস্বলের মেয়ে সে,তার পক্ষে গ্লামার ওয়াল্ডের ঐ পিচ্ছিল পথ ধরে হাঁটা এত সহজ হবে না,তাছাড়া তাদের সমাজ এখনো এই পেশাকে অন্য পেশার মত এত সহজ সাবলীল ভাবে গ্রহন করে না।অয়ন্তিকা তার নাট্য গুরু অম্বর স্যানালের কাছেও ছুটে গিয়েছিল সঠিক দিশা পেতে কিন্তু তিনি সরাসরিই বলেন,-এ ডিশিশন তাকেই নিতে হবে।একটা সময় অয়ন্তিকা গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ড-এর হাতছানির কাছে হার স্বীকার করে। অয়ন্তিকার বাবা ছোট বেলাতেই মারা গিয়েছেন তার শিক্ষিকা মা-ই তাকে একা হাতে মানুষ করেছেন।সেই সাথে তাকে দিয়েছেন জীবনে যথেষ্ট স্বাধীনতা। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী সমঝদার অয়ন্তিকার উপর ওনার পূর্ণ মাত্রায় রয়েছে ভরসা।

অতি অল্প দিনের মধ্যে অয়ন্তিকা একজন উঠতি মডেল হিসাবে তার জায়গা পোক্ত করে নিতে থাকে। পাশাপাশি তার নাটকটাও চালাতে থাকে। কিন্তু সময়ের কাছে একটা সময় হার মানতে হয় তাকে তাই শেষ পর্যন্ত নাটকের পর ছাড়তেই হয় তাকে।অম্বর স্যানাল সেদিন শুধু হালকা দীর্ঘশ্বাসের সাথে বলেছিলেন-”তুমি খুব শক্তিশালী অভিনেত্রী অয়ন্তিকা তাই অভিনয়টা কোনোদিন ছেড়ো না।সেটা যেখানেই থাকো।আর আমার গ্রুপের দরজা তোমার জন্য সবসময় খোলা রইলো”...।


একটা বছর খুব ভালো ভাবেই কেটে যায় কাজের মধ্যে দিয়ে অয়ন্তিকার। সম্ভবনাময় মডেল হবার সমস্ত গুনই ছিল তার মধ্যে তাই গুনগ্রাহীর পাশাপাশি বাড়তে থাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যাও।

এই সময়তেই বিখ্যাত এক সাবান প্রস্তুতকারক কোম্পানিতে সে পেয়েছিল লিড রোলের অফারটি। কিন্তু এখানেই যে অয়ন্তিকার চরম বিপদের দিনটা ঘনিয়ে আসছে তা বুঝতেও পারেনি সে।

খুব ট্যালেন্টের সাথে কাজটা শেষ করেছিল সেদিন অয়ন্তিকা। অনেক নামী জনের কাছে প্রশংসিতও হয়েছিল ‌কয়েকটি ভালো কাজের অফারও পাওয়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল।

সেদিন কাজ শেষে প্রায় বিকেল হয়ে এসেছিল। আকাশের ঈশান কোনে দেখা দিয়েছিল মেঘ। কলকাতা শহড়ে বৃষ্টি এলে যদিও বোঝার উপায় কম বড় বড় বিল্ডিং-এর ফাঁক গলে আর হাজার আওয়াজ আর আলোর মাঝে মেঘ যে কখন আসে আর যায় তাহলে শুধু বৃষ্টিতেই বোঝা যায়। কিন্তু ছোট থেকেই অয়ন্তিকার বৃষ্টি বড় প্রিয় আর তাছাড়া বছরের প্রথম কালবৈশাখী তাই আনন্দে মনটা নেচে উঠেছিল তার।হাতেও বিশেষ কাজ ছিল না তাই সোজা বাড়ির দিকেই রওনা দিয়েছিল। কিন্তু কিছুটা যাবার পরেই একটা ফোন ঢুকেছিল অয়ন্তিকার মোবাইলে।যে সাবানের আ্যডটা একটু আগেই সে করে এসেছিল সেখানেই তার সাথে আলাপ হয়েছিল ছেলেটার। বিখ্যাত আ্যড নির্মাতা কোম্পানির ম্যানেজার মোহন আগরওয়াল। তাদের কোম্পানিতে নতুন নির্মিত একটা আ্যডের গুরুত্বপূর্ণ রোলের জন্য তখনই ডেকে পাঠায় সে অয়ন্তিকা কে। ততক্ষণে বৃষ্টিটা প্রায় মুসলধারে।ছাতাও সাথে নেই কিন্তু এত গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানিতে কাজের সুযোগ সে হারাতে চায় না।তাই প্রায় কাকভেজা হয়েই উপস্থিত হয়।জায়গাটা দক্ষিণ কলকাতার শেষ দিকে।মোহন আগরওয়ালের নিজের বাংলো। অয়ন্তিকার অবস্থা দেখেই মোহন বাবু আফশোস করে ওঠেন ‌।এই অবস্থায় অয়ন্তিকাকে দেখে ওনার ভীষন খারাপ লাগে।তাই নিজের একটা সার্ট দেন কিছুক্ষণের জন্য অয়ন্তিকাকে পরার জন্য। বৃষ্টিটা সন্ধ্যা আটটা নাগাদ প্রায় ধরে আসে। অয়ন্তিকা বেরিয়ে আসে। কাজের ব্যাপারে সমস্ত কথা প্রায় পাকাই হয়ে যায়।বেশ বড়ই একটা প্রজেক্ট। পারিশ্রমিকের অংকও মোটা রকম।

সেদিন খুশিতে উড়তে উড়তে অয়ন্তিকা বাড়ি ফেরে।রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ নিধির ফোনটা আসে।যে সাবানের আ্যডটা অয়ন্তিকা করেছে সেই রোলটা নিধিরই করার কথা ছিল কিন্তু পারিশ্রমিকের ব্যাপারে কিছু একটা গোলমাল হওয়ায় রোলটা অয়ন্তিকাকে অফার করা হয়।এই ব্যাপারে নিধি অয়ন্তিকার উপর বেশ অসন্তষ্ট।

নিধির কথাগুলো অয়ন্তিকার কানে যেন গরম শলাকা হয়ে প্রবেশ করে।সারা ঘরটা ওর দুলে ওঠে। পাগলের মত ফেসবুকটা অন করে।তারপর আর কিছুই ওর মনে নেই।


তিনদিন পর হসপিটালে নিজেকে আবিষ্কার করে অয়ন্তিকা।পাশে উদ্বিগ্ন মুখে বসেছিল মা।পুরো ব্যাপারটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগে অয়ন্তিকার।

আস্তে আস্তে সবটা মনে পড়ে অয়ন্তিকার। নিধি অয়ন্তিকাকে বলে-

নিধির বয়ফ্রেন্ড হল মোহন আগরওয়াল। সেদিন কাজের ব্যাপারে অয়ন্তিকাকে ডেকে পাঠানো ছিল আদপে একটা ফাঁদ। অয়ন্তিকা যে আস্তে আস্তে নিধির জায়গাটা দখল করে নিচ্ছে সেটা সে কোনো দিনই হতে দেবে না।তাই সেদিন একা অয়ন্তিকাকে ডেকে পাঠিয়ে মোহন চেয়েছিল অয়ন্তিকার আপত্তিকর ছবির তুলে সোস্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করবে।হয়তো সেটা জোর জবরদস্তি করেই করতে হত কিন্তু হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে অয়ন্তিকা কাজটা নিজেই সহজ করে দেয়। ঘরে লাগানো গোপন ক্যামেরায় অয়ন্তিকার ড্রেস চেঞ্জ করার সমস্ত দৃশ্যই ক্যামেরা বন্দী হয়ে যায়। এবং ততক্ষণে সেটি সোস্যাল মিডিয়ায়” উঠতি মডেলের গোপন ক্যামেরায় তোলা ছবি” ক্যাপশানে ভাইরালও হয়ে গেছে।

ঘরে রাখা সমস্ত ক্যারাসিনের জারটাই নিজের গায়ে উজাড় করে ধরিয়ে দেয় দেশলাই কাঠি অয়ন্তিকা। ছোট্ট মফস্বলের মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির মেয়ে সে। মডেলিং করার জন্যই তাদের ফ্যামিলি ইতিমধ্যে ব্রাত্য হয়ে গেছে তাদের এই ছোট্ট মফঃস্বলের সমাজে।ট্যারা চোখের চাহনি সবসময় কটাক্ষ করে তা তাদের মা-মেয়ের বুঝতে অসুবিধা থাকে না। অয়ন্তিকার মা সবসময় যেন এক সংকোচে থাকেন তাহলে অয়ন্তিকা ভালোই বুঝতে পারে। তবুও মেয়ের স্বপ্নে কখনই তিনি বাধা দেননি। অয়ন্তিকার মা যে স্কুলে চাকরি করেন সেখানেও যে মেয়ের পেশার ব্যাপারে ছোট বড় আদেশ উপদেশ শুনতে হয় তা অয়ন্তিকাকে মা না বললেও বুঝতে অসুবিধা হয় না অয়ন্তিকার। এরপর অয়ন্তিকার এই ছবি আর ভাবতে পারে না সে…..। মায়ের এই অপমানের আগে নিজেকে শেষ করে দেওয়াই তার উচিত মনে হয়। তারপর আর কিছুই মনে নেই তার ‌। শুধু সারা দেহতে অসম্ভব জ্বালা নিয়ে জ্ঞান ফেরে তার। কিন্তু সমস্ত কথা মনে পরতেই দেহের সব জ্বালা উধাও হয়ে মনের মধ্যে ভীষন যন্ত্রণা মোচড় দিয়ে ওঠে। কেন কেন কেন মা বাঁচালে আমায়? তোমার এই অপমানের আগে আমার মৃত্যু যে অনেক ভালো ছিল মা। তোমার মেয়ে তো মরেই গেছে মা...।-প্রবল আর্তনাদে কঁকিয়ে ওঠে অয়ন্তিকা।


 ‌অয়ন্তিকার মা একদৃষ্টে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন মেয়ের দিকে,তারপর খুব ধীর কন্ঠে বলেন-”তুই তখন আট মাসের,তোর বাবা একটা কোম্পানিতে সেল্স অফিসার ছিলেন,আমিও চাকরি পাইনি। বলতে পারিস্ টানাটানির সংসার। হঠাৎ বাড়িতে অনেক লোকজন, অশ্রাব্য গালিগালাজ। তোর বাবাও উধাও তিনদিন ধরে। তোকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে কাটিয়েছি। বাড়িতে ঢিল পড়ছে, লোকজনের আক্রমণ সব সয়েছি।কবে যে তোর বাবা চিটফান্ডের সাথে যুক্ত হয়েছিল আমি বুঝতেও পারিনি। আস্তে আস্তে সব জানলাম। তোর বাবার মত বহু কর্মচারী আজ এই চিটফান্ডের সাথে যুক্ত হয়ে জড়িয়ে গেছে এক ফাঁদে।তারা নিজেরাও বুঝতে পারেনি এগুলো সাধারণ মানুষের থেকে টাকা কামানোর এক একটা ফাঁদ।এই সমস্ত কোম্পানির মালিকেরা সাধারণ মানুষের টাকা লুটে ইতিমধ্যে পাড়ি দিয়েছে বিদেশে। কিন্তু তোর বাবার মত কর্মচারীরা সাধারণ মানুষের রোষে পড়ে। যদিও এইসব মানুষেরো তো কোন দোষ ছিল না।তারাও তো তাদের সর্বশ্ব ক্ষুইয়ে আজ নিঃস্ব।তাই সব রাগ গিয়ে পড়ে এই সমস্ত কর্মচারীদের উপরেই।তুই তো এতদিন বারবার জানতে চাইতিস্ কিভাবে তোর বাবার মৃত্যু হয়?না কোন এক্সিডেন্ট-এ নয় ,সব মিথ্যা বলেছি তোকে,তোর বাবা আত্মহত্যা করেন, হ্যাঁ তোর বাবা সুইসাইড করেন ঠিক তোর মতই গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে। কিন্তু আমি তোর বাবার মত তোকে একা ফেলে সেদিন কিছুতেই পারেনি জীবন থেকে পালিয়ে যেতে। লোকজনের কুৎসিত ইঙ্গিত, গালিগালাজ, অত্যাচার সব সহ্য করেছি মুখ বুজে শুধু মাত্র তোর মুখ চেয়ে ‌।ঐ পাড়া থেকে উঠে আসি এই ছোট্ট মফঃস্বলের ভাড়া বাড়িতে। নিজেদের বাড়ি বিক্রি করে কিছুটা মেটায় সকলের দেনা।এই বেসরকারি স্কুলের চাকরিটা বহু চেষ্টা করে জুটে যায়। তোর বাবার মৃত্যুর পর পাওয়া ইনসোরেন্সের টাকাটাও পুরোটা চলে যায় দেনা মেটাতে। এমনকি আজও অল্প অল্প করে তোর বাবার ঋণের বোঝা মিটিয়ে চলেছি।

জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়া অনেক সহজ রে লড়াই করে বেঁচে থাকার নামই তো জীবন। শুধু একটা ছবি তোর সকলে দেখে নিয়েছে ব্যাস সব শেষ তোর জীবনের?এতই ছোট তোর জীবন?

জানিস তোর বাবা চলে যাবার পর চাকরিটাও তখনও পাইনি শুধু দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি চাকরির সন্ধানে কিন্তু চিটিংবাজের স্ত্রী কে তখন কে বিশ্বাস করবে?

না খেয়ে, ছেঁড়া শাড়ি পরেও শুধু তখন একটাই চিন্তা আমার মাথায় ঘুরেছে যে করেই হোক তোকে আমি বাঁচাবার।সেই তুই আজ….আর কিছু বলতে পারেন না উনি।কান্না দলা পাকিয়ে আসে গলায়।

প্রায় এক মাস পরে অয়ন্তিকা হসপিটাল থেকে ছুটি পায়। পঞ্চাশ শতাংশ বার্ন। আয়নার দিকে তাকিয়ে সারা দেহটা কেঁপে ওঠে অয়ন্তিকার।একটানে ছুঁড়ে ফেলে দেয় আয়নাটা।নিজেকে আরোও অসহায় মনে হয় তার। দিনরাত গুমরে গুমরে যন্ত্রণায় কাটতে থাকে তার প্রতিটা দিন। প্রতিবেশীদের কৌতূহলী চাহনী আর কটাক্ষ।মুখ টিপে হাসি,অতি কৌতূহলী দের বাড়িতে এসে সরাসরি উপদেশ, আদেশ, মডেলের পেশা মেয়েকে বেছে নিতে দেওয়ায় অয়ন্তিকার মাকে দোষারোপ চলতে থাকে। অয়ন্তিকা নিজেকে বাইরে থেকে বিচ্ছিন্ন করে তার দু-কামরার ঘর টার মধ্য নিজেকে বন্দী করে নেয়। বন্ধু বান্ধবের সংখ্যা তার কম যে দু-একজন ছিল তারাও দেখা করতে এসে ব্যর্থ হয়েই ফিরে যায় কয়েকবার। অয়ন্তিকার মা হাজার বুঝিয়েও মেয়েকে বার করতে পারেন না এ ঘরের।তবে অয়ন্তিকা মাকে কথা দেয় মরার চেষ্টা সে আর করবে না। ইতিমধ্যে কয়েক মাস কেটে যায়।পাড়ার ফিসফিস, কৌতূহলও ঝিমিয়ে আসে‌। দমবন্ধ অয়ন্তিকা হাঁপিয়ে ওঠে।সাহস করে ধীরে ধীরে সে নিজেকে শক্ত করে বেড়িয়ে আসে তারা ছোট্ট বারান্দায়।তার দর্শন পেয়ে কৌতূহলী দর্শকদের চোখ গিয়ে আবার পড়ে এ বাড়ির বারান্দায়। শুরু হয় হাসি ঠাট্টা সরাসরিই।ঐ দেখ্ সেই মেয়েটা না যার সেই উলঙ্গ ছবি বেড়িয়ে ছিল !!!এই রকম টুকটাক কথা তার বারান্দায় রোজই ভেসে আসতে থাকে।সে যেন চিড়িয়াখানায় বাঁধা জন্তু এই রকম কৌতুহলে অনেকেই পথ চলার মাঝে দাঁড়িয়ে পরে দেখতে থাকে তাকে। কিন্তু অয়ন্তিকাকে হঠাৎ অজানা সাহস আর জেদে ভর করে।সে দেখতে চায় কতদিন মানুষের মধ্যে তাকে নিয়ে চলবে এই কৌতূহল,উৎসাহ। আস্তে আস্তে সকলের আলোচনায় এক ঘেয়েমি তার অয়ন্তিকার বারান্দা থেকে সকলের দৃষ্টি ঘুরতে শুরু করে হয়তো অন্য কোন বারান্দায় বা গসিপে। অয়ন্তিকা নিজের জগৎ গড়ে তোলে এই ঘর, বারান্দা আর বই-এর মাঝে। সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটো সে সম্পূর্ন ছেড়ে দেয়।ঐ সাইটগুলো তার কাছে হয়ে ওঠে আতঙ্ক। অ্যান্ড্রয়েড ফোন ব্যবহার করাও সে ছেড়ে দেয়। কৌতূহলী মিডিয়ায় হাত থেকে বাঁচতে সে ফোনের ব্যবহারও ছেড়ে দেয় শুধুমাত্র মায়ের সাথে যোগাযোগ-এর জন্য একটা নম্বর ব্যবহার করে সিম্পল একটা ফোনে তাও মায়ের স্কুল যাবার সময় টুকুতেই ।তাই পৃথিবীর কারো পক্ষেই সম্ভব হয় না তার সাথে কোনোভাবেই যোগাযোগ-এর। অয়ন্তিকা মাকেও বলে দেয় কোনোভাবেই কেউ যেন তার সাথে দেখা করতে না পারে। কিন্তু হঠাৎ স্যারকে তার বারান্দায় দেখে চমকে ওঠে সে…….


(4)

অনেকক্ষণ দুজনেই নীরবে বসে থাকেন। অয়ন্তিকার চোখ বেয়ে নামে অভিমানী নোনতা স্বাদ। কেবলই তার মনে হতে থাকে সেদিন স্যার যদি একবার তাকে বাধা দিত হয়তো সে পা বাড়াতো না এ পথে ।কেন কেন স্যার তার করলেন না!!!

অম্বর বাবু নিজেই ধরে আসা গলাটা ঝেড়ে নিয়ে আচমকা বলতে শুরু করেন….. 

শোন তোর এমন কিছু অসুখ হয়নি যে কাজকর্ম ছেড়ে এতদিন পড়ে থাকতে হবে। অনেক ছুটি কাটেয়েছিস আর নয় এবার সামনের মঙ্গলবার থেকে রিহার্সাল নতুন নাটকের ।আর তুই তো জানিস নাটকের রিহার্সাল-এর ব্যাপারে আমি কতটা পাংচুয়াল।ঠিক বিকেল চারটে মনে থাকে….


অম্বর বাবুর কথা শেষ করতে না দিয়েই অয়ন্তিকা ব্যঙ্গ মিশ্রিত হাসির স্বরে বলে ওঠে -"আপনি স্যার মজা করতে এসেছেন আমার সাথে না স্বান্তনা দিতে"!!!!

অম্বর বাবু মিনিট কয়েক কোনো কিছুই না বলে অয়ন্তিকার দিকে তাকিয়ে থাকেন একদৃষ্টে। তারপর কেটে কেটে বলেন-"মঙ্গলবার আমি নিজে এসে তোকে নিয়ে যাব রেডি থাকিস যেন"।

আর কোন কথাই না বলে গটগট করে সোজা হাঁটা দেন। অয়ন্তিকা অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন স্যারের যাবার পথে। ভীষন অবাক লাগে তার এনাকে।কেন যে আর পাঁচজনের সাথে মেলাতে গিয়েও মেলাতে পারেন না সে এই মানুষটাকে……

আমি পারব না স্যার আপনি বোঝার চেষ্টা করুন। আমি মরে গেছি। হারিয়ে গেছে আমার মধ্যে অভিনেত্রী সত্ত্বা।মৃত একটা মানুষ কেমন করে অভিনয় করবে বলুন?কেমন করে জীবন্ত করবে সে চরিত্র গুলোকে?আর আমি স্টেজে উঠলে লোকে আমার অভিনয় নয় আমার মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া খোলা শরীরটা খুঁজতে আসবে। আপনি চলে যান স্যার আপনি চলে যান-, কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়ে অয়ন্তিকা।

অম্বর বাবু অনেকক্ষণ কিছু বলেন না। চুপচাপ চেয়ে থাকেন অয়ন্তিকার দিকে। তারপর হঠাৎ করেই একটা চড় মারেন তার গালে। হতচকিত অয়ন্তিকা বিমূঢ় হয়ে যায় কয়েক মিনিট।

কি আঘাতটা লাগলো তো? হ্যাঁ এইরকম একটা আঘাতই তোর গালে বসিয়ে দিয়েছে একটা নোংরা সমাজ।সেই আঘাতের জবাব দিতে তোর কাছে একটা সুযোগ নিয়ে আসছি আমরা আর তুই তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিস? শুধু একবার উঠে দেখ পারবি তুই ঠিক পারবি। আমরা সবাই বিশ্বাস করি তুই পারবি। তোর মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখ কত কষ্ট কত অপমান তিনি এই কমাসে শুধু মুখ বুজে সহ্য করে আসছেন। শুধু তার এই অপমানের বদলা নেবার জন্য কি তুই ঘুরে দাঁড়াবি না?

প্রায় দশ মিনিট অয়ন্তিকা বসে থাকে নিশ্চুপ ভাবে। সুলেখা দেবী অদূরে দাঁড়িয়ে চোখের জল ঢাকতে থাকেন আঁচলের আড়ালে।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় অয়ন্তিকা.. 


(5)

সারি সারি কালো মাথা অয়ন্তিকার সামনে। বুকের মধ্যে ভয়ের একটা গুড়গুড়ানি যেন চেপে ধরেছে ‌।অবুঝ মন বারবার পিছু হটে আসতে চাইছে।না না সে পারবে না।কেন কেন সে রাজি হল -নিজের মনেকেই সে বারবার সম্মুখীন করে এক প্রশ্নের।ঐ দিকে দর্শকদের উত্তেজনা বাড়তে থাকে। অম্বরবাবু কিছু না বলে একভাবে চেয়ে থাকেন অয়ন্তিকার দিকে। অয়ন্তিকা কাতর দৃষ্টি মেলে তাকায় ওনার দিকে।

কি করবে সে? পারবে সে সব ভুলে অভিনয়ে ডুবে যেতে?না না কেন কেন সে পারবে না। নিশ্চয়ই পারবে।তিন মাসে অনেকবার সে ভেঙেছে আবার দাঁড়িয়েছে উঠে। সারা দিনরাত নিজেকে সে ডুবিয়ে দিয়েছে রিহার্সাল-এ।তার জন্য হ্যাঁ শুধু তার জন্যই তো স্যার সৃষ্টি করেছেন এই চরিত্র।না না তাকে পারতেই হবে।আরো একবার অয়ন্তিকা তাকায় অম্বরবাবুর দিকে।ঐ দিকে বাড়ছে দর্শকদের উত্তেজনা। প্রথম দৃশ্যই তার। নিজের সাথে বোঝাপড়া শেষে অয়ন্তিকা পা বাড়ায় স্টেজের দিকে।

অবশ্য বলা যায় অয়ন্তিকা নয় পা বাড়ায় অপমানিত,প্রকাশ্য সভায় যার শাড়ি হরণ করা হয়েছিল সেই দ্রোপদী।দ্রোপদী গিয়ে দাঁড়ায় তার সখা কৃষ্ণের সামনে।এ দ্রোপদী স্বামী পরিত্যক্ত।যে স্বামীরা দ্রোপদীর সম্মান রক্ষা করতে পারে নি তারাই তার সন্মান যাওয়ার অপরাধে তাকে করেছে পরিত্যাগ। শুধু সখা কৃষ্ণ এসে দাঁড়িয়েছে দ্রোপদীর হাতে হাত রেখে।না এখানে কৃষ্ণ নন কোন ইশ্বর।যিনি স্বাভাবিক বোধ সম্পন্ন এক বন্ধু।সে পারেনি তার সখীর অলৌকিক উপায়ে রক্ষা করতে সম্মান। কিন্তু সমস্ত সমাজকে তুচ্ছ করে একমাত্র সেই তার, সখীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ন্যায়ের লড়াই-এর জন্য। অয়ন্তিকার মনের গভীর থেকে উঠে আসা অভিনয় কাঁপিয়ে দেয় দর্শকদের হৃদকম্পন।যারা শুধু সোস্যাল সাইটে ভাইরাল হওয়া অয়ন্তিকাকে এসেছিল দেখতে দ্রোপদীর চরিত্রের আড়ালে তারা হারিয়ে ফেলে তারা সেই অয়ন্তিকাকে।

শেষ দৃশ্য,

প্রতিশোধের রক্ত মেখে উঠে দাঁড়ায় দ্রোপদী কুরুক্ষেত্রের মাঠে।না আর কেউ নয় একাই সে এই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের যোদ্ধা। অন্ধকারে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে তার বীর স্বামীগণ।অদূরে স্মিতহাস্য মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন ন্যায়ের কান্ডারী দ্রোপদীর একমাত্র সখা কৃষ্ণ। ধীরে ধীরে নামে পর্দা। অভিভূত দর্শকগণ ভুলে যায় কোথায় তারা।চিত্রাপিতের ন্যায় বসে থাকে তারা। মিনিট কয়েক পরে নীরবতা ভেঙে আচম্বিতে করতালিতে ভরে ওঠে হলঘর।

দীর্ঘ লড়াই শেষে জয়ী দ্রোপদী না কি অয়ন্তিকা মুখেতে অপূর্ব এক শান্তির দীপ্তির রেশ দিয়ে নেমে আসে স্টেজ থেকে নতুন করে শুরু করা তার জীবনে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama