Bhaswati Ghosh

Inspirational

3  

Bhaswati Ghosh

Inspirational

রডোডেনড্রনে নতুন পাতা

রডোডেনড্রনে নতুন পাতা

9 mins
9.9K


ঘোর লাগা চোখে ঘরের চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে নিল যুবকটি।মুখের মধ্যে

ঝুঁকে পড়া একটা উদ্বিগ্ন মুখ।আম্মা কি?উফ্ তীব্র যন্ত্রনায় পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিদুত্‍ খেলে গেল।সঙ্গে সঙ্গে আবছা অতীত চোখে স্পষ্ট হল, একি ও কোথায়!তবে কি ধরা পড়ে গেল?দাঁতে দাঁত চেপে যন্ত্রণা কে গিলে নিয়ে উঠে বসবার চেষ্টা করতেই একটি হাত এসে বাধা দিয়ে শুইয়ে দিল।একটা আবছা যেন খুব অস্পষ্ট কথা কানে ভেসে এল কিন্তু মস্তিষ্কে পৌঁছালো না।চোখটা বুজে কিছুক্ষণ শ্বাস নিল।ধীরে ধীরে আবার চেতনার বাইরে চলে গেল।মহামায়া দেবী উঠে গিয়ে ফোনটা ডায়াল করলেন।পুরো রিং হয়ে কেটে গেল।একমিনিট পরে আবার চেষ্টা করলেন।এবারে ফোনটা ওপার থেকে কেউ ধরলেন।"আমি মহামায়া ডাক্তার বাবু।ছেলেটির জ্ঞান এসেছিল তবে আবার সেন্সলেস হয়ে পড়েছে।"-এপার থেকে বললেন মহামায়া।ওপার থেকে ডাক্তার বাবু কি বললেন বোঝা গেল না।কিন্তু আধঘন্টা পরেই একটি স্কুটি এসে থামলো ছোট্ট একতলা কটেজ টির সামনে।নীলিমা আর বাবান তখন সবে গেট পেরোচ্ছে স্কুলে যাবে বলে।বাবানের চুলগুলো একটু ঘেঁটে দিয়ে নীলিমার দিকে তাকিয়ে বললেন ডাক্তার বাবু,-"কি মা, স্কুলে বেরোনো

হচ্ছে?তা ছেলে তো তোমার স্কুলেই পড়ে?"

নীলিমা হালকা হেসে জবাব দেয়,-"না কাকু ও তো নার্সারিতে।আমার তো মাধ্যমিক স্কুল।"

"ও আচ্ছা আচ্ছা"- বলে মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করেন বৃদ্ধ ডাক্তার বাবু।"তা তোমার শাশুড়িমা ঘরে আছেন তো?"

"হ্যাঁ যান ঐ ছেলেটিকে যে ঘরে রাখা হযেছে ওখানেই"-কথাগুলো বলেই নীলিমা হেসে বিদায় নিয়ে রাস্তায় পা বাড়ায়।ডাক্তারবাবু গেট ঠেলে ঘরে ঢোকেন।মহামায়া দেবী হাতের ম্যাগাজিন টা রেখে উঠে দাঁড়ান।ডাক্তারবাবু এগিয়ে গিয়ে যুবকটিকে পরীক্ষা করেন সময় নিয়ে।তারপর মহামায়াদেবী কে হাতের ইশারায় বাইরে ডাকেন।দুজনে গিয়ে রেলিং ঘেরা বারান্দায় পেতে রাখা বেতের চেয়ারে বসেন।একটা ঠান্ডা হাওয়া বয়ে আসছে।শীত প্রায় শেষের মুখে,রডোডেনড্রনে নতুন পাতা।তবু পাহাড়ের ঠান্ডা ওয়েদারের সাথে মহামায়া দেবীর তিনবছরে ও মানিয়ে নিতে বেশ কষ্ট হয়।মহামায়া দেবী গায়ের চাদরটা আর একটু ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকান।ডাক্তারবাবু মিনিট দুয়েক চুপচাপ থাকেন দূরের পাহাড়টার দিকে তাকিয়ে।সকালের হালকা রোদ পড়েছে পাহাড়টাতে।একটা আলতো শোভা চারিদিকে বিস্তার করে রয়েছে।এত সুন্দর প্রকৃতির দৃশ্যর মাঝেও ডাক্তারবাবু অন্য এক চিন্তায় আবিষ্ট যা তার বাঁকা ভুরু

দেখলেই বোঝা যাচ্ছে।মিনিট দুয়েক বাদে নিজেই চিন্তার জ্বাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এলেন।হালকা কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন।মহামায়া দেবীর দিকে তাকিয়ে সরাসরি-ই কোনো রকম ভনিতা ছাড়াই বললেন-,"তুমি ঠিক করছ না মহামায়া।তোমার উচিত পুলিশকে সব জানানো।"মহামায়াদেবী মিনিট খানেক চুপ করে থাকেন।বাগানের কোণের রডোডেনড্রনটার দিকে তাকান।কি সুন্দর কচি কচি সোনালি পাতায় গাছটা ভরে উঠেছে।দুটো ছোট্ট ফড়িং এর মতো পাখি এক টানা টুইটুই স্বরে ডেকে উঠছে।মনটা যেন আপনিই ভাল হয়ে যাচ্ছে।মিনিট খানেক ওই দিকে তাকিয়ে মাথাটা ঘুরিয়ে ডাক্তারবাবুর দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট শ্বাস টেনে ভাঙা কন্ঠে বললেন-,"জানি,আমি ভুল করছি এর জন্য অনেক ক্ষতিও হতে পারে।তাছাড়া বাবানের একটা ভবিষত্‍ আছে।তবু জানেন পারছি না।পারছিনা কারণ আমি জানি এখন পুলিশে খবর দিলে ছেলেটির কি অবস্থা হবে।ও নিজে ধরা দিলে হয়তো,.. " "সেটাই তো হওয়া উচিত।ঐ রকম অ্যান্টিসোশাল ক্রিমিনালদের তো এটাই কাম্য।"-মহামায়া দেবীর কথার মাঝেই ডাক্তার বাবু রাগত স্বরে বলেন।-"আর বিশেষ করে যেখানে..."ওদের কথার মাঝেই পাশের ঘর থেকে একটা কিছু পড়ার আওয়াজ পেলেন দুজনেই।দুজনেই ঘরের দিকে ছুটলেন।ঘরে গিয়ে দেখলেন ছেলেটি উঠে দাঁড়িয়েছে আর ওর হাত লেগে জলের গ্লাসটা মাটিতে পড়ে গেছে।মহামায়া দেবী তাড়াতাড়ি গিয়ে কাঁচগুলো মাটি থেকে ভুলে জায়গাটা পরিষ্কার করে ফেললেন।ডাক্তারবাবু

ছেলেটিকে জোর করে ধরে শুইয়ে দিলেন।ছেলেটি চিত্‍কার করে উঠলো-"ছেড়ে দাও আমায়।ছাড়ো আমায়।"ডাক্তারবাবু একটা ইঞ্জেকশান বার করে তাড়াতাড়ি ছেলেটিকে দিলেন।ছেলেটি ঝিমিয়ে পড়ে আবার শুয়ে পড়লো।তবে সেন্স হারালো না।কিছুটা ধাতস্থ হতে ডাক্তারবাবু ছেলেটির পাশে বসে বললেন,-"তোমার ভয় নেই।তুমি নিরাপদে আছ।তুমি ঘুমাও।আমরা তোমার কোন ক্ষতি করব না।তুমি খুব অসুস্থ।তোমার পায়ে গুলি লেগেছে। একটু সুস্থ হও,তারপর তুমি নিজের ইচ্ছামত যেখানে পার চলে যাবে।আমরা কেউ বাধা দেব না।"ছেলেটি ডাক্তারবাবুর কথাগুলো বুঝতে পারলেও একটা ঝিমুনির মত অবস্থায় থাকায় কিছু বলতে পারল না।ধীরে ধীরে ছেলেটি আবার ঘুমিয়ে পড়লো।

 

"তোমার নাম কি?"

"বাবান"-"তোমার নাম কি কাকু?"

একটু চমকে উঠলো যুবকটি।না নিজের পরিচয় কোনো মতে জানানো যাবে না।কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলো তাই-,"তোমাদের বাড়িতে কে কে থাকে?"

"আমি,মামণি আর ঠাম্মা"-বাবান উত্তর দিল।

"তোমার বাবা?"-যুবকটি জিজ্ঞাসা করে।

"ওর বাবা মারা গেছে।"ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন মহামায়া।এরপর বাবান কে উদ্দেশ্য করে বললেন-"বাবান যাও মা তোমায় ডাকছে।"বাবান একছুটে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।মহামায়া দেবী এক গ্লাস দুধ নিয়ে যুবকটিকে দিলেন।যুবকটি কুন্ঠিতভাবে দুধটা নিয়ে ধীরে ধীরে খেয়ে শেষ করে গ্লাসটা পাশে রেখে বললো,-"আন্টি আপনি যা করছেন আমার জন্য এর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে ছোট করবার ক্ষমতা আমার নেই।তবে এবার আমি বিদায় নেব।ভাবছি কালই...." কথা শেষ করতে না দিয়ে মহামায়া দেবী ধীরে ধীরে বললেন,-"কোথায় যাবে বাবা তুমি?তোমার দলতো তোমায় ক্ষ্যাপা কুকুরের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে।যুবকটি চমকে তাকালো-"আ.. আপনি কি.. কি করে....?"মহামায়া দেবী অল্প হেসে বললেন-," জ্বরের ঘোরে তোমার প্রলাপ

অনেক কথাই আমায় বলে দিয়েছে।তবে এর কিছুটা আমি আগেও জানতাম।"

"ক্কি কি জানতেন আপনি?"-যুবকটি চিত্‍কার করে ওঠে।

মহামায়া দেবী স্মিত হাসি হেসে বললেন-,"থাক বাবা, বন্দুকটা বার করতে হবে না৷ওটা আমি আগেই দেখেছি তার থেকে তোমায় একটা গল্প বলি সেটা মন দিয়ে শোন।"

"আমার শ্বশুর বাড়ি, বাপের বাড়ি কলকাতাতে। আমার স্বামী ছিলেন একজন ডাক্তার।যে

ডাক্তারবাবু তোমাকে দেখছেন উনি আর আমার স্বামী একসাথে মেডিকেল কলেজে

পড়াশোনা করেন। ওনার নাম মাইকেল জেমস।উনি একজন অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান।ওনার বাড়ি এই

অঞ্চলেই।উনি কলেজ শেষ করে এখানে চলে আসেন আর আমার স্বামী আর্মিতে জব্ পেয়ে পাঞ্জাবে চলে যান আর্মি হসপিটালের ডক্টর হিসাবে। উনি চাকরি পাবার একবছর পরেই আমাদের বিয়ে হয়। আমার বিয়ের একবছর পর আমার ছেলে হয়।আমার ছেলের

বয়স তখন দশ বছর, ওর বাবা একমাসের ছুটিতে বাড়ি ফিরবে৷ আর তিন দিন ধরে তাই আমি আর ছেলে বাড়ি সাজাতে ব্যস্ত।আমার শাশুড়িমা আচার,জ্যাম,জেলি করছে সারা দিন

ধরে ছেলে আসবে বলে।নিলেশ,রহমান ওর পাড়ার বন্ধুরা উত্‍সাহে লাফাচ্ছে, বন্ধু অনেক

দিন পর ফিরছে। জানো বাবা, ফিরলো ও তবে তিনদিন নয় চারদিন বাদে, কফিনে বন্দী

হয়ে।সেদিন আমার ছেলে ওর কফিনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করলো ওর বাবার

মৃত্যুর প্রতিশোধ ও নেবে।ও বড় হল।ইঞ্জিনিয়ারিং এ তুখোড় রেজাল্ট করলো।কিন্তু ওর সেদিনের প্রতিজ্ঞা ও ভুললো না।একদিন এসে জানালো ও এক সপ্তাহ বাদেই আর্মিতে জয়েন করছে।মনটা কেঁপে উঠলো।তবু বাধা দিতে পারলামনা।পাঁচ বছর সফলভাবে চাকরিও করলো।নীলিমা এল ওর জীবনে।বাবান এল।কানায় কানায় পূর্ণ হল সংসার।সব দুশ্চিন্তা সব কষ্ট সব ভয় যেন মন থেকে ধীরে ধীরে লোপ পেয়েছিল।আঘাতটা এল তখনি।বাবানের বয়স তখন একবছর।আমার ছেলে একমাস ছুটি কাটিয়ে সবে ফিরে গেছে ওর কাজের জায়গায়।আবার দিন গোনা শুরু হল আমার আর নীলিমার ওর ফিরে আসার।এবারে প্রতীক্ষাটা একমাস ও করতে হলনা।ওর যাবার আঠেরো দিন পরেই ফিরে এল।ঠিক ওর বাবার মত।জানো মুখটাও চিনতে পারিনি,এতটাই বীভত্‍স।বাবানকে কিছুতেই দেখতে দিইনি ওর বাবার ক্ষতবিক্ষত দেহটা।নীলিমা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে পাগলের মত হয়ে গেল।কিন্তু আমি তো অভ্যস্থ বল? তাই কিছুতেই কাঁদলাম না।"-একরাশ হাহাকার যেন বুক চিরে বেরিয়ে এল মহামায়া দেবীর।কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে দূরের পাহাড়টার দিকে চেয়ে রইলেন।নিজেকে সামলে

নিয়ে আবার শুরু করলেন-"তারপর জোর করেই নীলিমাকে এই পাহাড়ি এলাকায় চাকরিটা

নিতে বাধ্য করি।এ ক্ষেত্রে ডাক্তারবাবুই সব রকম সাহায্য করেন।আমরা তিনজনে মিলে এখানে শিফ্ট করি।"-মহামায়া দেবী কথা বলার মাঝেই দেখলেন যুবকটি উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।"নাম কি আপনার ছেলের ?"-চিত্‍কার করে জিজ্ঞাসা করে যুবকটি।

"বলছি বস শান্ত ভাবে"-মহামায়া দেবী দৃঢ় স্বরে বললেন।তারপর এক মিনিট গভীর

চোখে তাকিয়ে রইলেন যুবকটির মুখের দিকে।চোখে চোখ রেখেই উনি বললেন,-"সৌম্য

বসু।"

"সৌ..সৌম্য বসু!"ছেলেটি চিৎকার করে ওঠে।তারপর নিজেই শান্ত হয়ে বসে পড়ে।মহামায়া দেবী চোখ না সরিয়েই জিজ্ঞাসা করলেন,-"চেনো তো?"যুবকটি চমকে উঠে বললো,-"না না, আমি চিনি না।"মহামায়া দেবী একই ভাবে চেয়ে রইলেন স্থির দৃষ্টিতে।তারপর খুব ধীরে ধীরে বললেন,- "সৌম্য শেষ যেবার বাড়ি এসেছিল সেবার হঠাত্‍ রাত্রে ওয়াশরুমে যাচ্ছি। দেখি ছাতের আলো জ্বলছে।সিঁড়িতে উঠে গেলাম।সৌম্যর গলা শুনতে পেলাম ও বলছে-'সেলিম তুমি কি বলছ? আমাদের রেজিমেন্টে চর!আমাকে মারার জন্য!তুমি যার কথা বলছ ছেলেটিকে আমি দুবার দেখেছি।থুতনিতে একটা জরুল আর কব্জিতে Rশব্দটা উল্কিতে লেখা।মনে হচ্ছে

ছমাস হল জয়েন করেছে।ওর কথাই বলছো তো?'এপারে মিনিট দুয়েক চুপচাপ আবার

সৌম্যর গলা-'কিন্তু ভয়ে তো ছুটি নিয়ে অনন্তকাল বসে থাকা সম্ভব না।'এবারেও

কিছুক্ষণ চুপচাপ।আবার দশ সেকেন্ড মত পরে সৌম্যর গলা-'ঠিক আছে ভাই কথা

দিলাম আমি যতটা পারবো সাবধানে থাকবো, তুমি অত টেনশন নিও না।ছেলেটিকে কবে

থেকে পাওয়া যাচ্ছে না বললে?'আবার একমিনিট পর সৌম্যর গলা-'আচ্ছা তোমরা

এতটা শিওর্ হলে কিভাবে ও চর হিসাবেই ছিল, আর আমার উপরেই অ্যাটাক্ করবার

সম্ভবনা বেশি?'এরপর আর বিশেষ কথা হয় না।আমি চুপচাপ নেমে আসি।সেই রাত থেকে

আর ঘুমাতে পারি না, তারপর তো সবই বলেছি।জানতাম সৌম্য কে বাধা দিয়ে লাভ নেই,

ও কিছুতেই চাকরি ছাড়বে না তাই কাউকেই কিছু বলতে পারি না।কিন্তু কি ভাগ্য

দেখো তো! এই সাতদিন আগে রাতের খাবার খেয়ে আমি একটু বারান্দায় বসে।সৌম্য

চলে যাবার পর থেকে রাতে আর ঘুম আসেনা।সারা রাত গীতা,এটা ওটা পড়াশোনা করে

কাটিয়ে দিই।ঐ দিন এমনিই একটু বসে ছিলাম।নীলিমা, বাবান ওদের ঘরে শুয়ে পড়েছে।হঠাত্‍ করে ঝুপ্ করে পাঁচিল ডিঙিয়ে কাউকে লাফাতে দেখলাম।কে?কে?চিত্‍কার করলাম। কোনো শব্দ নেই।নীলিমাও বেরিয়ে এসেছে ।একটা টর্চ নিয়ে এগিয়ে গেলাম।দেখি রডোডেনড্রন গাছটার গোড়ায় তুমি প্রায় সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছো।দুজনে কোনোমতে ধরে তোমায় বারান্দায় শোয়ালাম।ডাক্তারবাবুকে খবর দিলাম।নীলিমা পুলিশে খবর দেবে বলে ফোন করতে যায়।তখনি তোমাকে ভাল করে দেখতে গিয়ে কব্জিতে Rঅক্ষরটা দেখলাম।জরুলটা অনেক আগেই দেখেছিলাম।চিত্‍কার করে পুলিশে ফোন করতে বারণ করলাম নীলিমাকে।কেন জানো?"

ছেলেটি যেন সম্মোহিত নিজের অজান্তেই বলে,-"কেন?"

"বলছি কেন, তার আগে তুমি বলতো তুমি কেন এই রকম সন্ত্রাসবাদী হিসাবে নিজেকে গড়ে তুললে?তোমার বাড়ি নেই?মা নেই?বাবা নেই?"-ছেলেটির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন মহামায়াদেবী।

"না কেউ নেই'' -চিত্‍কার করে বলে যুবকটি।একরাশ দলা মাখানো কষ্ট যেন তার

বুক চিরে বেরিয়ে এল।-"কেউ নেই আমার যাদের জন্য এই জীবনটা কে পণ রেখে টাকা

ইনকাম্ করলাম তারাই আজ আমার মুখ দেখতে ঘৃণাবোধ করে।আমার বাবা ছিলেন একজন

ধর্মপ্রাণ মানুষ।ভেবেছিলাম বাবা অনন্ত সমর্থন করবে আমায় অথচ, বাবা যখন সব

জানলো আমার কার্যকলাপ বললেন, "আমাকে সন্তান হিসাবে পরিচয় দিতে তার ঘৃণা

লাগছে।"আমি নাকি ধর্মকে কলুষিত করেছি।ধর্মের পবিত্রতাকে নষ্ট করেছি।মহামায়া দেবী ধীর কন্ঠে বললেন,''-তোমার বাবা তো ভুল কিছু বলেন নি।ধর্ম কি?পৃথিবীতে এমন কোন ধর্ম নেই যা মনুষ্যত্বের মৃত্যুর কথা বলে।ধর্মের ভিত কোনদিন মানুষের কঙ্কালের উপর হতে পারে না।কেন ভুল পথে চালিত হয়ে তোমরা পৃথিবীর সকল পবিত্র ধর্মকে কলুষিত কর তোমরা?জীবনে কি সৃষ্টি করেছো যে এত ধ্বংস করছো?দশ মাস দশ দিন গর্ভের যন্ত্রনা জান?"-মহামায়াদেবী কথাগুলো বলে একটানা একটু থামলেন।যুবকটির চোখ মেঝেতে যেন কেউ গেঁথে দিয়েছে।মাথা তোলবার ক্ষমতা নেই।

মহামায়া দেবী শ্লেষের স্বরে বললেন-"তোমাকে জন্ম দিতে তোমার মা কতটা কষ্ট

পেয়েছিলেন তা অনুভব করার ক্ষমতা তোমার আছে?কোনো মা যখন তার সন্তানের

জন্ম দেয় সব কষ্টটা সহ্য করে তার সেই সন্তানের মুখটা দেখবে বলে।একটা

সন্তান কে জন্ম দেওয়ার কষ্ট কি তোমরা বোঝ?বোঝো না তোমরা অথচ, মারতে তোমরা

পার।"-আবার মিনিট খানেক চুপ করে থেকে উনি বললেন-"অবশ্য দোষ তোমাদের

নয়।তোমাদের দারিদ্র্যতা.উচ্চাশাকে পাথেয় করে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ

তোমাদের ব্রেন ওয়াশ করেছে।একবারো ভেবে দেখেছো এত রক্তের বিনিময়ে তোমরা কি

পেয়েছো?কিসের আশায় তোমরা এই সব করেছো?পৃথিবী তোমাদের কি চোখে দেখে?জানবে

রক্তে ভেজা মাটিতে ফসল কোনো দিনও পাবে না।তুমি জিজ্ঞাসা করছিলে তোমাকে

চিনতে পেরেও কেন আমি ধরিয়ে দিলাম না তাই তো?"

যুবকটি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মুখটা তুললো।মহামায়া দেবী একটু ওর দিকে তাকিয়ে

থেকে আবার বললেন-"জান, তোমাকে প্রথম দেখার পর ভেবে নিয়েছিলাম আমার খোকার

মৃত্যুর শাস্তি আমি নিজে হাতে দেব।তারপর হঠাত্‍ নিজের মুখোমুখি

দাঁড়ালাম।এসব আমি কি ভাবছি!একজন মা আমি, একজন শিক্ষিকা আমি, সেই আমি

প্রতিশোধ নেব বলে ছুরিতে শান দিচ্ছি।লজ্বায় ঘৃণায় কুঁকড়ে গেলাম।তোমাদের

সাথে তো তাহলে আমার কোনো তফাত্‍ পেলাম না।তোমরা তো পথের ঠিকানা হারিয়েছো,

কিন্তু আমি নিজেই নিজেকে হারিয়ে ফেলছি। আমার এতদিনের শিক্ষা,ন্যায়,নীতি

কে বিসর্জন দিয়ে।এছাড়া জ্বরের ঘোরে বার বার তুমি তোমার মায়ের কথা

বলছিলে।তোমার না পাওয়া,তোমার বিশ্বাস সব কিছু উগরে দিচ্ছিলে প্রলাপের

ঘোরে।সব শুনে তোমার মায়ের কথা খুব মনে পড়লো।বুঝলাম তুমি একজন পথভ্রষ্ট

মানুষ।সেদিন সারা রাত আমি ভাবলাম নিজের সাথে যুদ্ধ করলাম।তারপর ধীরে ধীরে

ভোর হল।ভোরের আলো এক নতুন চেতনায় আমায় উদ্ভাসিত করলো আমার হৃদয়কে।

আজ তোমার উপর আমি প্রতিশোধ নিতাম, আবার আমার বাবানের উপর তোমার বংশধর

প্রতিশোধ নিত।এইভাবেই তো একটা হামলার বদলে আর একটা হামলা চলছে।বিনিময়ে কি

পাচ্ছি আমরা?-মা সন্তান হারাচ্ছে, স্ত্রী স্বামী হারাচ্ছে, সন্তান পিতাকে

হারাচ্ছে।আর আমরা আমাদের পাশের বাড়ির একদা বন্ধুকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাতে

শিখছি।শুধু সন্দেহ বুকে নিয়ে কীটের মত বেঁচে থাকছি।তোমাকে চেনার পর

নীলিমাকে কিছু বলি না।শুধু ডাক্তার বাবু সারারাত ছিলেন ওনাকে সব

বলি।ওঁনার থেকে আমাদের তিনজনের আপন আর কেউ নেই।উনি প্রথম থেকেই আমাকে

বলেন, এর ফলে কতটা বিপদে পড়তে পারি আমরা।কিন্তু উনি নিজের হাতে চিকিত্‍সার

সব দায়িত্ত্ব তুলে নেন নিজের বিপদ জেনেও।তবে উনি বার বার বলেছেন আমি

মারাত্মক ভুল করছি।তোমরা নাকি মনুষ্যত্ত্ব হারিয়ে ফেলা শয়তান।আমি ভাবলাম

দেখি না তোমার মধ্যে সত্যিই কি মনুষ্যত্ত্ব পাব না?আমি জানি না এরপর তুমি

কি করবে।আমার সন্তান থাকলে তো তোমার বয়সী হত।তাই তুমিও আমার সন্তান।তোমার

মাও বোধায় আমার মতই হবেন।তোমার মাও নিশ্চই তোমার জন্য পথ চেয়ে

আছেন।"-শেষদিকে মহামায়াদেবীর গলা বুজে আসে।উনি ঘর থেকে আস্তে আস্তে

বেরিয়ে যান।

যুবকটি জানালার ধারে গিয়ে দূরে পাহাড়টার দিকে চেয়ে থাকে।মনে পড়ে তাদের

ছোট সেই গ্রামটার কথা।তার সেই একতলা মাটির খড়ে ছাওয়া বাড়িটার কথা।সুখ

স্বাচ্ছন্দ্য হয়তো বেশি ছিল না।তবু হাসি ছিল, পাখির গান ছিল।স্কুলের

বন্ধু ছিল নীলাদ্রি,রোহিত।ওদের সাথে একসাথে টিফিন ভাগ করে খাওয়ার সেই

দিনগুলো চোখে হঠাত্‍ ছবির মত ভাসছে।ওদের সাথে সেই দূর্গা ভাসান,ঈদের দিনে

ওদের ডেকে আম্মার হাতের পায়েস,রুটি খাওয়া সব যেন অনেক দিন পর ওকে হাত

ছানি দিচ্ছে।কে হিন্দু কে মুসলিম তখন।কিন্তু কোথা দিয়ে সব ওলটপালট হয়ে

গেল।আর্মিতে জব পাওয়া।হঠাত্‍ একদিন অপরিচিত এক ফোন, তারপর ধীরে ধীরে

বোঝানো হল ও কি পায়নি।কিভাবে অত্যাচারিত অন্য ধর্ম দ্বারা।সব চিন্তা

ভাবনা ওর ওলটপালট হয়ে গেল।কিন্তু যেন সব আবার অন্য রকম আজ নতুন করে

ভাবাচ্ছে।কই মহামায়া দেবী,বাবান,নীলিমা,ডাক্তারবাবু,আম্মা,আব্বা এরা তো

জাতের নিয়ে বাড়াবাড়ি না করেও নিজেদের ধর্মপালন করে চলেছে। ধর্মের কোন

বিরোধ ওদের মনে তো আসেনি।মহামায়া দেবীর সাথে তো আম্মার কোন তফাত্‍ পেলাম

না।যুবকটি এগিয়ে যায় ফোনের দিকে।ফোনটা ডায়াল করে।রিং হচ্ছে।ওপারে কেউ ফোন

তোলে"হ্যালো পুলিশ স্টেশন"....

যুবকটি ফিরে যাবে জানে ঠিক একদিন ওর গ্রামে।ওর আম্মার কোলে।তার আগে পাঁক

গুলো ধুয়ে যাক।সেদিন আর আব্বা ওকে ঘৃণা করতে পারবে না।ও পুলিশকে বললো

এদের কে ভয় দেখিয়ে ও এত দিন ওদের বাড়িতে ছিল তবে ওনাদের ভালবাসা, সেবা,

যত্ন ওকে আলোর পথে এনেছে।পুলিশের জীপ ছাড়বে মহামায়া দেবী,নীলিমা গেটে

দাঁড়িয়ে।দুজনের চোখ যেন চিকচিক করছে। যুবকটি চোখ তুলে তাকায় গেটের পাশের

রডোডেনড্রন গাছটার দিকে।পুরনো সব পাতা ঝরে গিয়ে গাছটায় সোনালি এক ঝাঁক

নতুন পাতা।পাশে ছোট্ট বাবান ওর খেলার রাজ্যে ব্যস্ত।হঠাত্‍ চোখ তুলে বলে

-"কাকু আবার আসবে তাড়াতাড়ি কিন্তু...."

#positiveindia


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational