গোপন কথাটি
গোপন কথাটি


আরে মুন্নি না?
পেছন থেকে ডাক শুনে তিরিশ উত্তীর্ণ মহিলাটি ঘাড় ঘোরান।
সামনে বছর চল্লিশ- এর এক ভদ্রলোক।
চোখ কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড তাকাবার পর হঠাৎ করেই একটা খুশির একটা হাসি খেলে যায় মহিলাটির চোখে মুখে৷
আরে সিধু দা না?-অষ্টাদশীর মতো খুশির গলায় মহিলাটি বলে ওঠে।
যাক চিনলি কষ্ট করে বল?
তা কিছুটা হলেও কষ্ট হয়েছে বই কি!জিমে পেটানো সলমন খান যদি হঠাৎ করে এই রকম বিশাল ভুঁড়ি আর কানের ফাঁকে উঁকি মারা সোনালী চুলে হাজির হয় একটু অবাক হতে হয় বই কি!
তোর সাথে কথায় আমি কবে পেরেছি বল তাই আজও সেই চেষ্টায় অব্যাহতি দিলাম।
মহিলাটি অর্থাৎ মুন্নিদেবী এবার রীতিমত শব্দ করে হেসে উঠলেন।
তুই না একটুও বদলাস নি।সেই রকমই পাগলী রয়ে গেলি।
কেন তোমার মত বুড়ো হয়ে যেতে হবে নাকি?
বুড়ি কিরে তোর তো রীতিমতো আর একটা বিয়ে দেয়া যাবে।
তাই ?তা করবে নাকি বিয়ে?-নিজের রসিকতায় নিজেই আর একদফা হেসে নেয় মুন্নিদেবী।
তারপর বলো এখানে তুমি?
অফিসের একটা প্রজেক্ট এর কাজে।তোর এখানে শ্বশুর বাড়ী শুনেছিলাম কিন্তু এই ভাবে যে দেখা হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি।আমি কিন্তু তোকে একচান্সেই চিনেছি।সেই রাগ রাগ মুখ করে দৌড়াচ্ছিলি।
এক সেকেন্ড দাঁড়াও, স্কুল-এ একটা ফোন করে নিই।আজ ডুব দেব।
এবার কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে ভদ্রলোকটি অথাৎ মুন্নিদেবীর সিধুদা।
সে কি রে কেন?এমা আমি বোধ হয় দেরি করে দিলাম।
এই তুমি ম্যা-ম্যা টা থামাও তো ।আজ স্কুলে এক্সাম আছে।আমার কিছু গার্ড টার্ড আজ নেই।আজ ডুব দিলে কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না।আজ তুমি আমার বাড়ি যাবে ব্যস।
এই না না অফিস আছে।
এই তুমি থামো তো, অফিসের কাজে এক দু ঘন্টা ডুব দিলে তোমার অফিস উচ্ছন্নে যাবে না বুঝলে?
দারুণ সাজিয়েছিস তো ড্রয়িংরুমটা!কবে থেকে এত গোছানো হলি রে?-মুগ্ধ গলায় সিধু দা বলেন।
কেন শুধু তোমার বউ বুঝি গোছানো হতে পারে?
কর্তা অফিসে বুঝি?আর ছেলে মেয়ে?
হ্যাঁ কর্তা অফিসে, নটায় বেরোন পাঁচটায় ঢোকেন।বউ ছাড়া পার্টি আ্যটেন্ড করেন না।টিপিকাল বউয়ের আঁচল ধরা পাবলিক।এক মেয়ে ক্লাস থ্রি'তে পড়ে।নামকরা ইংলিশ মিডিয়ামের ফাস্ট গার্ল।কেউ না বললেও পড়তে বসে, মোটকথা মায়ের মত পড়াশোনায় ফাঁকি দেওয়ার বদগুনের অধিকারী নয়।
আর কিছু?-ভুরু নাচিয়ে মজার গলায় বলেন মুন্নি দেবী।
না আর কি?
এবার তোমার কথা বল?তার আগে দাঁড়াও সিধুদা তোমার চিনি দুধ দিয়ে সেই স্পেশাল চা টা করে আনি।
চিনি দুধ দিয়ে চা আর খাই না রে,মধুমেহ মধুর মত নামটা বড্ড ভালবেসে ফেলেছে আমায়।হালকা চিনি দিয়ে “র” চা-ই কর।
কিচেনের আড়ালটা একটু প্রয়োজন ছিল মুন্নি দেবীর।প্রায় পনেরো বছর!এই তো যেন সেদিনের কথা মনে হচ্ছে….
“উ হু হচ্ছে না, হচ্ছে না মুন্নি।এতো ইমোশোনাল নয় চরিত্রটা।চোখে একটা আগুন চাই ।আগুনের তাপ আনার চেষ্টা কর।ক্যারেক্টারটা বোঝার চেষ্টা কর।
তাহলে তুমি একবার দেখিয়ে দাও সিধুদা!
নাঃ আমি দেখাবো না ।তোকে নিজেকেই করতে হবে।স্টেজ নাটক এত সহজ নয় রে ।একে গায়ে মাখতে হবে।খেতে হবে গুলে।ঘুমাতে হবে চরিত্রগুলোর সাথে।চরিত্রটা বোঝার চেষ্টা কর,একাত্ম হ।আমি শুধু তোকে বলতে পারি পারফেক্ট কিনা তুই।কিন্তু ইমোশন্ সেটা নিজের অন্তর থেকে ছাড়া অনুভব সম্ভব নয়রে পাগলী।
মুন্নি দেবীর মুখে বিষন্ন একটা হাসি খেলে যায়।
ইমোশান সেটাই তো বোঝাতে পারলামনা সিধুদা।তোমার সেই পাগল করে দেওয়া মুখ টিপে হাসিটার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকতাম।তোমার ব্যাক্তিত্ব,হাসি,চোখ,চলা,হাঁটা মোটকথা তোমার সমস্তটুকু শুধুই মুগ্ধ করতো এই মুন্নিকে।কিন্তু সিধুদা আমার মুগ্ধচোখের চাহনি বিনিময়ে পেত শুধু তোমার উদাসীন দৃষ্টির শীতলতা।তবু এক অদৃশ্য অধিকারবোধ ছিল তোমায় ঘিরে আমার।হঠাৎ হয়ত রিহার্সাল শেষে আমার অবদারেই তোমাকে ছুটতে হতো ফুচকার লাইনে আমার সাথে।হয়তো বা কখনও অফিস কেটে রাবীন্দ্রসদনে কোন নাটক দেখার সাথী হতে হতো তোমায়।ধীরে ধীরে তোমার অসংখ্য অনুরাগিনীদের মনে জমতে থাকল বিক্ষোভের কালো দানা।অনুরাগিনী তো কম ছিল না তোমার!মেয়েদের বুকে কাঁপন লাগানো হিরোইজম লুক।বিখ্যাত গ্রুপ'এর প্রধান অভিনেতা কাম নাট্যনির্দেশক। তোমার অনুরাগিনী তো থাকবেই।কিন্তু বিশ্বাস করো সিধুদা এসব কিচ্ছু না, আমায় শুধু তোমার ঐ নদীর মত স্বচ্ছ গভীর চোখ দুটো আর ঠোঁট টিপে হালকা হাসিটা ভাসিয়ে নিয়ে যেত।বুকের কোণ ছারখার করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিত।
আমি কিন্ত বেশ উপভোগ করতাম, তোমাকে আমাকে ঘিরে গড়ে ওঠা আশেপাশের ফিসফিস করে বলা গল্পগুলো।কিন্তু একদিন তোমার ভুরুতে দেখলাম ভাঁজ।
মুন্নি তুই বড়ো হচ্ছিস এভাবে তোর আমার…
না সিধু দা আর কিছু তোমাকে বলতে হয় নি।হঠাৎ করেই আমার পড়াশোনার চাপটা বেড়ে গিয়েছিল তারপর থেকে।সেদিন-এর পর থেকে গ্রুপ এর আশেপাশেও আমায় কেউ আর দেখেনি।
কি দেখছো অমন করে সিধু দা?
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে যেন মুন্নিদেবির সিধুদা।
না এই তোর সাথে তোর বরের ছবিটা ।খুব ভালো মানিয়েছে তোদের দুজনকে।তোকে সুখী দেখে আমার কি ভালো যে লাগছে।এটাই তো আমি চেয়েছিলাম।
কি চেয়েছিলে সিধু দা?-পলকহীন ভাবে সিধু দার মুখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে মুন্নিদেবী।
এই তোরা সুখী হ।অকারণেই নিস্তব্ধতা নেমে আসে দুজনের মাঝে।কথা হাতড়ায় বাচাল মুন্নি দেবী।
বিয়েতে এলেনা কেন সিধু দা?
কাজ ছিল রে।
বউদির কথা বল?তোমার তো একটা ছেলে?
হ্যাঁ এক বছরের।বউদি খুব ভালো রে।এই আগোছালো মানুষটাকে ঐ তো বেঁধে রেখেছে।
তুমি খুব ভাগ্যবান বল ?
হ্যাঁ,অস্বীকার করি না ।তবে তুইও তো ভাগ্যবতী।
হ্যাঁ বড্ড বেশিই ভাগ্যবতী।বড্ড ভালো মানুষ ও।বড্ড বেশিই নির্ভরতা আমার প্রতি ওর।আমার হাতের নুন ছাড়া তরকারিও ওর কাছে অমৃত।ফুচকা চাই কথাটাই শুধু খসাবার অপেক্ষা, সাথে সাথে হাজির।আমার অসুস্থতা ওকে পাগল করে তোলে।আমার সামান্য অনুপস্থিতি ওর চারধার শূন্য করে তোলে।
মাথায় হাত রাখেন মুন্নিদেবীর সিধুদা।কেঁপে ওঠে আবেগে থরথর ঠোঁট দুটো মুন্নিদেবীর।এবার আসি বুঝলি।ফোনে ইতিমধ্যে তাড়া শুরু হয়ে গেছে অফিস থেকে।
আবার আসবে তো সিধুদা?
নাঃ।থাক না শুধু এইটুকু ক্ষণ তোর আর আমার মধ্যে।
একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো সিধুদা?
কি?
সবটাই কি তোমার না বোঝা ছিল?
কেমন এক মলিন হাসি খেলে যায় মুন্নিদেবীর সিধুদার মুখে।
মাষ্টারমশাই আমায় বড় বিশ্বাস করতেন রে।বিখ্যাত চক্রবর্তী বাড়ির মেয়ে এই রয় পদবীর গলায় মালা দেবে এই আঘাতটা আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হয়নি তাকে।
এতক্ষণের বহু কষ্টে নুড়িপাথরে ঠেকানো বন্যা হঠাৎ ছাপিয়ে আসে মুন্নিদেবীর গাল বেয়ে।-তাই বুঝি আমায় বঞ্চিত করলে?
পরম মমতায় দুচোখের জল মুছিয়ে দিয়ে হেসে বলেন মুন্নি দেবীর সিধুদা
কোথায় বঞ্চিত হলি পাগলী?এই তো বেশ ভালো হল ,গ্যাসের বুকিং, বাচ্চার স্কুল, বাজারের ব্যাগে হারিয়ে গেল না আমাদের প্রেমটুকু।হয়তো কোন উদাসী বসন্ত বিকালে বা গ্রীষ্মের ফেরিওলা হাঁক পাড়া দুপুরে বা শীতের কুয়াশা ঘেরা সন্ধ্যায় অকারণেই তোর কাজের ভুল হয়ে যাবে।সব পাওয়ার পরেও কিছু একটা না পাওয়ায় বেদনা বুকের কাছে চাপ দিয়ে যাবে।অকারণেই উদাস আমার ঠোঁটে সিগারেট পুড়ে পুড়ে ছাই হবে ।জানবি সেই না পাওয়া টুকুতেই আমাদের প্রেম বেঁচে থাকবে চিরকাল।কোন হিসাব নিকাশ ছাড়াই, দেনা পাওনা ছাড়াই।সব পাওয়ার মাঝে এই না পাওয়াটুকুই বাঁচিয়ে রাখবে আমাদের নীরব প্রেমকে যেমন ঝিনুক আগলে রাখে বুকের মাঝে মুক্তার দানা।
কিছু দিয়ে যাবে না সিধুদা আমায়।
দুচোখ বন্ধ করে সিধুদা।ঘড়ির কাঁটার প্রতিটা সেকেন্ডের ঘোষণা বড্ড বেশি কানে বাজে মুন্নী দেবীর।
মুন্নিদেবির সিধুদার অবয়ব মিলিয়ে যেতে থাকে পথের বাঁকে।সিধুদার দেওয়া হয়তো বা শেষ কবিতাখানি ভিজতে থাকে।ভীষন ভাবে ভিজতে থাকে।ঝাপসা চোখ মুছে বারবার পড়তে থাকেন মুন্নিদেবী
“হয়তো কয়েক শতক পরে
যখন হাসিটা হারিয়ে গেছে জীবনের বাঁকে,
মধ্যবিত্ত জীবনে কড়ায় গন্ডায় মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার হিসেব।
যখন ভীষণ ইচ্ছা করে একলা হতে ঠিক আগের মত,
অন্ধকার চিলেকোঠার ঘরে বেদনাগুলো ভাসিয়ে দিতে অন্ধকারে জেগে থাকা একলা নক্ষত্র লোকে।
বুকের মাঝে অবিরত রক্ত ক্ষরণ।
দাম মেটানো জীবনে শুধুমাত্র মৃত্যুর আরতি।
হয়ত বা তখন দেখা হবে দুজনের ক্লান্ততার মুখোশ ছিঁড়ে নীরব দুটি চাহনি।
সেই ক্ষণে বলে যাবে অতীতের বলতে চাওয়া অনেক না বলা কথা।
বুকের মধ্যে সমুদ্রের ঢেউয়ের ওঠাপড়া।
ঝম ঝম বৃষ্টির তান
ভীষণ ভাবে ভিজিয়ে দেবে দুজনকেই।
শুধু সেই টুকু একান্ত ক্ষণ থাক তোমার আমার।
বাকিটুকু সকলের মাঝে বিকিয়ে যাক। “
#love