কুয়াশা পেরিয়ে
কুয়াশা পেরিয়ে
সকাল থেকে সানাইয়ের শব্দটা বিরক্তি লাগছে মিঠির।এটা একটা বিয়ে বাড়ি!দুর,অনন্যার বিয়েতে তিনদিন ধরে বিরাট লজ্ ভাড়া করা হয়েছিল।বিয়ের আগেরদিন আইবুড়ো ভাতের অনুষ্ঠানটাই তো বিরাট করে আয়োজন করেছিল।সেদিনি অনন্যা যে শাড়িটা পরেছিল তার যা দাম আমার আজ রাতে পরার শাড়িটার দাম তার অর্ধেক ও হবে না।ওদের লজটা সাজাতে যে টাকা লেগেছিল, হুম্ আমার বিয়েতে লোকজন খাওয়ানো হবে বোধহয় সেই টাকায়।
কিরে মিঠি জানালায় মাথা দিয়ে উদাস হয়ে বরের কথা ভাবছিস বুঝি?
দূর তোর কথাই ভাবছিরে অনন্যা।কখন আসবি সেটা।
হ্যাঁ হ্যাঁ আর কথা ঘোরাতে হবে না।
আর বলতো শাঁখটা কোথায়?মাসিমা নিয়ে যেতে বললেন।গায়ে হলুদ চলে এসেছে।
ঐ যে ঠাকুরঘরে নিয়ে যা।
বুকের ভেতরটা আরো টনটন করে উঠল মিঠির।কি সুন্দর একটা শাড়ি পরেছে অনন্যা।আর গা ভরতি গয়না।আর আজ আমার নিজের বিয়ে আমি একটা সস্তা তাঁতের শাড়ি পড়ে রয়েছি।গয়না তো মায়ের যে কটা ছিল।চোখ ফেটে জল চলে এল।
কিরে মিঠি কাঁদছিস কেন?পাগল মেয়ে মন খারাপ করতে নেই।বরের মুখ দেখে সব ভুলে যাবি।
না,না, ও কিছু না রে।হ্যাঁ রে অনন্যা সুমনদা আসেনি?
ওর সময় কোথায়!বিয়ের পর হানিমুন যাবার সময় হয়নি।শুধু রাতে খাবার সময় দেখা হয়।বিয়ের অষ্টমঙ্গলার পর আর শ্বশুরবাড়ি আসতে দেখেছিস?
ওসব কথা বাদ দে চল,বাইরে আশীর্ব্বাদে ডাকছে আর 'গায়ে হলুদ' এর কাপড়গুলো দেখবি চল।
গায়ে হলুদের জিনিস দেখে মিঠির মনে হল লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবে অনন্যার সামনে।অনন্যা আবার দেখো না কি আদেখলপনা দেখিয়ে সব নেড়ে ঘেঁটে দেখছে।যেন এমন আর দেখেনি।
অনন্যার কি যে দামি দামি গায়ে হলুদ এসেছিল মিঠি কি তা দেখেনি!আর এই গাঁয়ে হলুদ এর জিনিস তো নস্যি।
মিঠির কাছে বিয়েবাড়ি টাই যেন বিস্বাদ হয়ে উঠেছে।অনন্যা মরতে কেন যে ওর বন্ধু হতে গেল। মিঠির তো কত দিনের ইচ্ছা ছিল বিরাট করে ফুলে ফুলে বাড়িটা সাজানো হবে।অনেক লোক খাবে।প্রচুর গয়না আর দামি শাড়িতে অপরূপা হয়ে উঠবে আর ওর স্বপ্নের রাজকুমার ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকবে।
শুভদৃষ্টির কথা ভাবলেই কত বার ওর লজ্জায় চোখ বন্ধ হয়ে আসত।আর এখন শুভদৃষ্টির সময় ওর চোখ বন্ধ করে রাখতে ইচ্ছা হচ্ছে।কি বিচ্ছিরি দেখতে তার বরকে।ওদিকে সুমন দা কি হ্যান্ডু!তার সাথে কি ব্যক্তিত্ব।আর ওর বরটা একটা প্যাঙলা ছিঃ, একবার দেখেই তো বিরক্তি লেগে গেছে।জানিনা কি করে সারা জীবন থাকব।
বিকেল বিকেল অনন্যা সাজাতে শুরু করলো।মিঠির আয়নার দিকে তাকাতেও ইচ্ছা করছে না।অনন্যার বিয়ের একদিন আগে থেকে নামি পার্লারের সাথে কন্টাক্ট করা ছিল আর তার তাদের পাড়ার পার্লার এর লোককে নিয়ে আসবার ক্ষমতাতেও কুলালো না।অনন্যার হাতের মেহেন্দী করতেই তো 2000টাকা লেগেছিল।ধুর এটা একটা বিয়ে হচ্ছে তার!
কিরে মিঠি দেখ চুপ করে বসে আছিস পছন্দ হল তোর সাজানো টা?
হুঁ হয়েছে।
তোকে যা লাগছে না তোর বর চোখ ফেরাতে পারবে না।
ইস্ কি ক্যাবলাকান্ত বর তার হয়েছে।সবাই মজা করছে আর ও মিটিমিটি খালি হেসে যাচ্ছে।যত্ত সব।আর সুমনদা কি স্মার্টলি সবাইকে উত্তর দিচ্ছিল।সুমনদাকে জব্দ করতে এসে ওরাই জব্দ হয়ে গিয়েছিল।আর হবে নাইবা কেন,ডাক্তার আর ক্যাবলা প্রাইমারি স্কুলের মাষ্টার এর তফাত হবেনা?ছোঃ
আবার অনন্যা যাবার সময় বলে গেল তোর বর খুব ভদ্র আর ভাল মানুষ রে৷ কাটা ঘায়ে যেন নুনের ছিটে।
কটা বাজল?4.30.দুর আর শুয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে না।সবাই ঘুমাচ্ছে একটু ছাদে ঘুরে আসি।
একি মা বাবার ঘরে আলো জ্বলছে।ঘুমায়নি! কথাও তো শোনা যাচ্ছে।কি বলছে শুনি তো-মা কাঁদছে,বাবাও কাঁদছে।
মিঠির বাবা বলছে,'' -গিন্নি আমাদের আর কদিন।শুধু ধার গুলো মেটাতে পারলেই নিশ্চিন্তে চোখ বুজবো।একটাই দুঃখ তোমার গয়না বলতে আর কিছু রইল না।''
''সে যাক তাতে আমার দুঃখ নেই গো।ছেলে হীরের টুকরো,বিনা পণে একটাও দাবি ছাড়া মেয়ে নিয়ে যাচ্ছে।তবু একমাত্র মেয়েকে সাধ্যমত দিতে তো ইচ্ছা হয়।ইচ্ছা তো কত ছিল, কিচ্ছুই তো করতে পারলাম না।''
মিঠির আর কিছু শুনতে ইচ্ছা করছেনা।ছুটে ছাদে উঠে গেল।
কুয়াশা ঘিরে রয়েছে চারদিকটা।ভীষন কান্না পাচ্ছে মিঠির।ছিঃ,ছিঃ, আমি একবার ও বাপি মার কষ্টের কথা না ভেবে স্বার্থপরের মত নিজের চাওয়া পাওয়ার হিসাব নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম!আমার এই স্বল্প আয়োজন এর বিয়ের পেছনে বাপির কত কষ্টের ঘাম ঝরেছে।মায়ের কত ত্যাগ রয়েছে তা একবার ও ভাবলাম না!
দূরের তালগাছের মাথাটা কুয়াশা ঘিরে রয়েছে।এই রকম ভোরে ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে একবার পুরিতে গিয়ে সূর্যোদয় দেখেছিল,ঢেউগুলো ছুটে ছুটে পায়ের কাছে আছড়ে পড়ছিল।বাবা বলেছিল সূর্য আমাদের প্রানের উত্স,এইরকম তেজোময় থাকবি।কোনো লোভ, মলিনতা যেন তোর হৃদয়কে ছুঁতে না পারে।ঠিক ঐ রকম সমুদ্রের মত বিরাট একটা হৃদয় কর।দেখবি জীবনের ছোট ছোট পাওয়াই তোর মুখে তৃপ্তির হাসি এনে দেবে।সেদিন নিজেকে বড়ো সুখী মনে হবে।তোদের জীবনে হয়তো অনেক সম্পদের প্রাচুর্য্য দিতে পারিনি তবে আমার উত্তরসূরি হিসাবে তোর মাথা চিরকাল দৃঢ় রাখতে পারবি মা।কত কথা মনে পড়ছে আজ৷
ছোটবেলায় জ্বর হলে মা-বাবা সারারাত জেগে থাকতো।যতদিন ভাত খেতে পারতনা মা বাপি ও ততদিন ভাত খেতনা।মিঠির দুগাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।হঠাত্ একটা হাতের স্পর্শ তার চোখের জল মুছিয়ে দিল।
কেঁদোনা মিঠি।ফোন এ সবসময় তো মা-বাবার সাথে কথা বলবে।আর আমাকে বলবে মন খারাপ হলে আমি তোমায় নিয়ে আসব।
এই শালটা আগে গায়ে দাওতো।বোকা মেয়ে,এই ভোরবেলা ছাদে ঠাণ্ডা লেগে যাবেনা?আমার পাশ থেকে উঠে এলে কিছু না বলে ভাবলাম, ওয়াশ'রুমে যাচ্ছ।আর আসছোই না দেখে ছাদে এসে দেখি এখানে।কাল থেকেই তো গুম হয়ে আছ শরীর তো খারাপ হয়ে যাবে সোনা।
একটু দূরের নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে একটু একটু করে সূর্য উঠছে।কুয়াশাটা কেটে যাচ্ছে।পাখিগুলো কিচ়্কিচ়্ করে তাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।বাড়ির পাশের শিউলি গাছ থেকে অপূর্ব সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে।ভোরের অল্প আলো ছড়িয়ে পড়েছে তাদের মুখে।
মিঠি সেই আলোতে দেখল তার বরকে খুব সুন্দর দেখতে।
মিঠি অনুভব করলো তার প্যাঙলা স্বামীর বুকে রয়েছে এক অপার নির্ভরতার আশ্বাস।
আলতো করে কাঁধে মাথা রাখল মিঠি। এক স্বর্গীয় ভালবাসায় তার চোখ বুজে এল।
#love