বেস্ট ফ্রেন্ড টু বিয়ে ফ্রেম
বেস্ট ফ্রেন্ড টু বিয়ে ফ্রেম
সকাল থেকে টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। হঠাৎ রবি-র মোবাইলটা বেজে উঠল। রবি ফোনটা রিসিভ করে বলল-
“ হ্যাঁ বল। “
“ তুই এখনও ঘুমোচ্ছিস্ ? “
“ হ্যাঁ। ঘুমোচ্ছি। কেন? তোর কোনো সমস্যা ? “
“ বাব্বা ! গতকাল রাতের রাগ বুঝি এখনও যায়নি? “
“ এই শোন্। আমার রাগ নিয়ে তোর এতো ভাবতে হবে না। আর তুই এই সকাল সকাল ফোন করে আমার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিলি কেন ? দরকারে তো নিশ্চয়ই ফোন করিসনি। “
“ ওহ্ ! আচ্ছা। তার মানে আমি শুধু দরকারেই তোকে ফোন করব তো? ঠিক আছে তাই করবো। “
এই বলে মিলি ফোনটা রেখে দিল। এর কয়েক সেকেণ্ড পরে মিলি রবির ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে বিছানার পাশের টেবিলটায় কফি মাগটা রেখে বেরিয়েই যাচ্ছিল এমন সময় রবি মিলির হাতটা ধরে ফেলে। মিলি পেছন ফিরতেই রবি বলে উঠল –
“ বাপরে ! তোর রাগ তো দেখছি আমার থেকেও বেশি। আর তুই এতক্ষণ আমার বাড়িতে থেকেই কথা বলছিলিস্? আবার এখন আমাকেই রাগ দেখিয়ে চলে যাচ্ছিস্? “
“ আমার রাগ নিয়ে তোরও ভাবতে হবে না। সকাল সকাল তোর ঘুম ভাঙানোর জন্য আর এই অসময়ে তোর বাড়িতে আসার জন্য সরি। “
“ আচ্ছা। সরি পরে হবে। তুই যখন এসেই পড়েছিস্ তখন আমার পাশে তোকে এখন বসতে হবে। “
মিলি কিছুতেই বসতে চাইছিল না। কিন্তু রবি জোর করে মিলির হাতটা ধরে পাশে বসিয়ে দিল। টেবিল থেকে কফি মাগটা নিয়ে রবি দেখল সেটায় ওর প্রিয় হট্ চকলেট কফি রয়েছে।
রবি মিলির দিকে তাকিয়ে বলল-
“ এই কফিটা বাড়ি থেকে বানিয়ে এনেছিস্ ? নাকি এখানে এসে বানালি? “
কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবুও কথা বলতে হচ্ছে এরকম একটা মুখের ভাব নিয়ে মিলি বলল-
“ না। বাড়ি থেকে বানিয়ে এনেছি। “
রবি coffee-টায় একটু চুমুক দিয়ে বলল-
“ আহ্! এই কফিটা তোর থেকে আর কেউ ভালো বানাতে পারে না। “
এরপর রবি কফিটায় কয়েকবার চুমুক দিয়ে পাশের টেবিলটায় কফি মাগটা রেখে দিয়ে বলল-
“ তুই এমনভাবে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে আছিস্ যেন মনে হচ্ছে আমার দিকে তাকানো বারণ।“
মিলি আরও বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রবি বলে উঠল-
“ ফ্রিজে স্ট্রবেরি আইসক্রীমটা রাখা আছে। যাওয়ার সময় নিয়ে যাস্। “
এই শুনে মিলির মুখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল। সে আবার ফিরে এসে রবি-কে একটু হাগ্ করে থ্যাঙ্ক ইউ বলে বেরিয়ে গেল।
. . . . .
রবি আর মিলি, দুজনের এক স্কুল, এক কলেজ বা একই বিষয় নিয়ে পড়াশুনো না হলেও দুজনেই একে অপরের বেস্ট ফ্রেন্ড। রবির যেদিন মাধ্যামিক পরীক্ষা শেষ হয় তার পরের দিন সে তার মা-বাবার সাথে জলপাইগুড়ি চলে যায় মাসির বাড়িতে। সপ্তাহখানেক সেখানে থাকার পর বাড়ি ফিরে এসে রবি দেখে তার বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে সদ্য তৈরি হওয়া নতুন ফ্ল্যাটের দোতলার বারান্দায় জামাকাপড় ঝুলছে। রবি বুঝতে পারে যে ওখানে একটা নতুন ফ্যামিলি এসেছে। একদিন দুপুর বেলায় রবি বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলার সময় দেখতে পায় সেই উল্টো দিকের ফ্ল্যাটের দোতলার বারান্দায় প্রায় ওর-ই বয়সী একটি মেয়ে জামাকাপড় মেলছে। রবি সেইদিকে ভ্রক্ষেপ না করে ফোনে কথা বলতে থাকে। হঠাৎ দুজনের মধ্যে চোখাচুখি হওয়ায় রবি একটু লাজুক ভাবে ঘরে চলে যায়। এরপর একদিন সকালবেলা রবি কফি খেতে খেতে বারান্দায় গিয়ে সেই মেয়েটাকে আবার দেখতে পায়। মেয়েটা তখন নিজের বারান্দায় রাখা গাছগুলোতে জল দিচ্ছিল। আবারও দুজনের মধ্যে চোখাচুখি হওয়ায় মেয়েটাই রবিকে দেখে হাত নাড়ায়। রবিও একটু ইতস্তত ভাবে হাত নাড়ায়। তারপর মেয়েটি হাতের ইশারায় বুঝিয়ে দেয় যে রবি যেন এক্ষুনি বাড়ির নীচে এসে দাঁড়ায়। মেয়েটা রবিকে কিছু বলতে চায়। রবি ৫ মিনিট পর বাড়ির নীচে এসে দেখে মেয়েটি ততক্ষনে এসে দাঁড়িয়ে আছে।
মেয়েটাই প্রথম কথা শুরু করে।
“ হাই! আমি মিনাক্ষী সেনগুপ্ত। তুমি? “
রবি তখনও এই ভাবে বাড়ির নীচে এসে একটা অচেনা মেয়ের সাথে কথা বলাটাকে ঠিক সহজভাবে নিতে পারছিল না। একটু ইতস্ততভাবেই রবি মেয়েটির প্রশ্নের উত্তর দিল।
“ আমি অর্জুন রায়। “
“ তুমি যখন আমার ইশারায় নীচে এসে আমার সাথে কথা বলছো তাহলে এটা বুঝে নেওয়া যায় যে আমারা একে অপরের বন্ধু হতে পারি। “
রবি এবারও একটু ইতস্ততভাবে বলল-
“ হ্যাঁ পারি। “
“ তাহলে তুমির জায়গায় তুই বলাটা ঠিক হবে। “
“ হ্যাঁ সেটাই ভালো। “
“ তুই আমায় মিলি বলে ডাকবি। আমার ডাক নাম মিলি। আর তোর ? “
‘তুই’ শব্দটা যেন একটা ম্যাজিকের মতো। এক নিমিষে মনের সব সংকোচগুলো দূর হয়ে যায়। রবি মুখে একটু হাসি নিয়ে বলল-
“ রবি। “
“ আচ্ছা। আর আজ আমার বার্থডে। তাই মা আজ কিছু স্পেশাল রান্না করছে। তুই আজ দুপুরে আমাদের বাড়িতে আসিস্। লাঞ্চটা আমাদের সাথেই করবি। “
এই শুনে রবি মিলির দিকে হাতটা বারিয়ে হ্যান্ডশেক করে মিলিকে উইশ করে বলল-
“ মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ্ দ্য ডে মিলি আর আমি অবশ্যই যাবো। “
“ ঠিক আছে। আসিস্ কিন্তু। “
এই বলে মিলি রাস্তা পার হয়ে উল্টো দিকের ফ্ল্যাটের মেইন গেটটা খুলে ভেতরে ঢুকে গেল। রবি তখনও দাঁড়িয়ে আছে আর ভাবছে সব কিছু যেন ঝোর হাওয়ার মতো এক নিমিষে হয়ে গেল। তবে রবির মিলিকে মন্দ লাগেনি।
. . . . .
রবি ঘরে বসে একটা ম্যাগাজিন পড়ছিল। রাত তখন ৯ টা বাজে। এমন সময় বাড়ির কলিং বেলটা বেজে উঠল। রবির মা দরজা খুলে দেখে মিলি এসেছে। রবিও ঘর থেকে মিলির গলার আওয়াজ শুনতে পায়। এর কিছুক্ষন পর রবির ঘরের দরজা ঠেলে মিলি ভেতরে ঢুকে একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। রবি ম্যাগাজিন থেকে চোখ দুটোকে একটু সরিয়ে মিলিকে দেখে নিয়ে আবার ম্যাগাজিনের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বলল-
“ কি রে! মনে হচ্ছে অফিস থেকে সোজা আমার বাড়িতেই এসেছিস্। “
এমন সময় রবির মা ঘরে এসে সরবতের গ্লাসটা মিলির হাতে দিয়ে বললেন-
“ ইশ! কিভাবে ঘেমে গেছিস্ তুই। সরবতটা খেয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নে। আর ডিনারটা এখান থেকেই করে যাবি।“
মিলি এক নিঃশ্বাসে ঢগ ঢগ করে সরবতটা খেয়ে নিয়ে বলল-
“ না না কাকিমা। রাতের খাবার আমাদের করাই আছে। মা বাবাও আর একটু পরেই চলে আসবে। একেবারে বাড়িতে গিয়েই ডিনার করে নেব। “
“ আজ আমি তোর কোনো কথা শুনব না। আমি তোর মা-কেও ফোন করে বলে দিচ্ছি ওনারা যেন সোজা আমাদের বাড়িতেই চলে আসেন। ওনারাও আজ আমাদের সাথেই ডিনার করবেন। “
“ কিন্তু কাকিমা খাবারে যদি কম পরে যায়। “
“ ওসব নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না। তুই এখন ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নে। “
“ ঠিক আছে। তাহলে চলো আমিও তোমাকে একটু হেল্প করে দিই। “
“ একদম না। তুই এখন শুধু রেস্ট নিবি। আমি রান্না ঘরে যাই। তোরা গল্প কর্। “
এই বলে রবির মা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এতক্ষন ধরে চুপ থাকার পর রবি বলে উঠল-
“ মিলি, মা কিন্তু ঠিকই বলেছে। এখন তুই ফ্রেশ হয়ে আয়। তোর সাথে কিছু কথা আছে।“
মিলি রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে একটু অগ্রাহ্যভাবেই বলল-
“ তোর দরকারি কথা মানেই তো তোর কোনো বন্ধুর বার্থডে গিফট্ কেনা নিয়ে কিংবা তোর কোনো বন্ধু তোর উপর রেগে আছে তার রাগ কি করে ভাঙানো যায় অথবা অফিসে কোনো প্রব্লেম হয়েছে সেটা কি করে সলভ্ করা যায়। এই তো? বলে ফেল্ এর মধ্যে কোনটা তুই বলতে চাস্? “
রবি এক্টু বিরক্ত হয়ে ভুরু কুচকে বলল-
“এই তোকে কে বলেছে রে যে আমি এইগুলো নিয়েই তোর সাথে কথা বলব? এই সব কিছুই না। অন্য একটা ব্যাপার। “
মিলি একটু অবাক হয়ে বলল-
“ তাই নাকি? তোর বন্ধু আর অফিস ছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারও যে তোর কাছে ইম্পর্টেন্ট সেটা তো জানা ছিল না।“
এই বলে মিলি হাত দিয়ে মুখ চেপে হাসতে থাকে। মিলির এই কথা শুনে রবি আরও রেগে গিয়ে বলে উঠল-
“ মিলি এখানে হাসার মতো কিছু হয়নি। আমার বন্ধু আর আমার অফিস ছাড়া আরও একটা বিষয় ইম্পর্টেন্ট হয়েছে। যেটা আগে ছিল না। কিন্তু এখন হয়েছে। আর তুই প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আয়। এরপর কাকু কাকিমা চলে আসলে কথাটা আর বলা হবে না। “
“ তাতে কি হয়েছে ? আজ না হলে কাল বলবি। “
“ না আমি আজকেই বলব এবং এখুনিই বলব। তুই কি ফ্রেশ হতে বাথরুমে যাবি ? নাকি আমি……”
এই বলে রবি বিছানা থেকে উঠে মিলির দিকে এগোতেই মিলি বলে উঠল-
“ না। তুই কিন্তু এক পাও এদিকে আসবি না। “
রবি মিলিকে জোর করে ঠেলে বাথরুমের দিকে নিয়ে গেল। এরই মাঝে মিলি বলে উঠল-
“ আরে দাঁড়া। এইভাবে ঠেলিস্ না। পরে যাবো তো। “
মিলি বাথরুমে ঢুকে যাওয়ার পর রবি হাসতে হাসতে বিছানায় এসে বসে পরে।
কিছুক্ষণ পর রবি শুনতে পেল মিলি গুন গুন করে গান করছে। রবি বলল-
“ এই যে মিস্ কোকিল কন্ঠী গান-টান পরে করবেন। আগে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এসে আমায় একটু উদ্ধার করুন। “
মিলি বাথরুম থেকে একটু উচ্চস্বরে বলল-
“ তুই আমায় যত বেশি তাড়া দিবি আমি কিন্তু তত বেশি দেরি করব। “
“ আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আর তাড়া দেব না। কিন্তু তুই প্লিজ্ একটু তাড়াতাড়ি কর মা। “
এর কিছুক্ষণ পর মিলি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বলল-
“ তুই আমায় এমনভাবে তাড়া দিচ্ছিস্ যেন মনে হচ্ছে বিশাল কিছু একটা ঘটে গেছে। “
“ এদিকে দেখ। তাহলেই বুঝবি কেন এতো তাড়া দিচ্ছিলাম। “
“ কি দেখব? “
এই বলে মিলি রবির সামনে যেতেই রবি মিলির হাতে দুটো ফটো দিয়ে বলল-
“ দেখতো এদের দুজনের মধ্যে কাকে দেখতে বেশি ভালো লাগছে? “
ফটো দুটো দেখে মিলি এতোটাই অবাক হল যতটা আগে কখনও হয়নি।
মিলি অত্যন্ত অবাকভাবে বলল-
“ এরা কারা রবি? এই দাঁড়া দাঁড়া, তার মানে তোর বিয়ের জন্য মেয়ে খোঁজা হচ্ছে? তুই বিয়ে করবি? “
এই বলে মিলি ভীষণভাবে হাসতে লাগল। মিলির হাসি দেখে রবি একটু অবাক হয়ে বলল-
“ এত হাসির কি হল? আমি কি বিয়ে করতে পারি না? “
মিলি কোনরকমে হাসি থামিয়ে বলল-
“ তুই করবি বিয়ে? আমি এখনও ব্যাপারটা ঠিক হজম করতে পারছি না। “
এই বলে মিলি আবার হাসতে লাগল। রবি এবার একটু বিরক্ত হয়েই বলল-
“ আমার বিয়ে টা কি খাবার জিনিস যে তুই হজম করবি? আর আমি এটা বুঝতে পারছি না যে এখানে এতো হাসির কি আছে? “
মিলি আবার হাসি থামিয়ে বলল-
“ তোর দ্বারা বিয়ে হবে না। “
“ কেন হবে না? “
“ দায়িত্ব বুঝিস্? “
“ মানে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু পরিস্কার করে বলবি? “
“ মানে তুই যে মেয়েটাকে বিয়ে করবি তার দায়িত্বটা তো সারাজীবনের জন্য তোকেই নিতে হবে। আর সেই মেয়েটাও কিন্তু তোর দায়িত্ব নেবে। “
“ বাপরে! এতো ভারী ভারী কথা কোথা থেকে শিখলি বলতো? আগে তো কাখনও তোর মুখে এমন কথা শুনিনি।“
“ তুই তো এই প্রথম বিয়ের কথা ভাবলি। যদি আগে ভাবতিস্ তাহলে তাখনও একই কথা আমার মুখে শুনতে পেতিস্। “
“ আচ্ছা বুঝলাম। কিন্তু তোর কেন মনে হচ্ছে যে আমি দায়িত্ব নিতে পারব না? “
“ কারণ তুই তো এখনও নিজের দায়িত্ব নিজেই নিতে শিখলি না। “
এই বলেই মিলি আবার মিট মিট করে হাসতে লাগল। রবি তখন আরও রেগে গিয়ে বলল-
“ মিলি তুই কিন্তু এবার একটু বেশি বেশি বলছিস্। “
“ কিচ্ছু বেশি বলিনি। তুই তো এখনও আ্যলার্ম দিয়ে সকালে সময় মতো উঠতেই পারিস্ না। রোজ কাকিমার ডেকে দিতে হয়। “
এই সময় রবির মা ঘরে এসে বললেন-
“ এই তোরা খেতে আয়। “
মিলি বলল-
“ কাকিমা… বাবা-মা এসে গেছেন? “
“ হ্যাঁ। ওনারা কিছুক্ষণ আগেই এসেছেন। “
“ ঠিক আছে কাকিমা আমারা আসছি। “
রবির মা বেরিয়ে যাওয়ার পর রবি বলল-
“ দেখলি তো মিলি। কখন থেকে বলছিলাম যে কোন মেয়েটাকে ভালো লাগছে বল্। কিছুইতো বললি না। খালি বাজে কথা বলে গেলি। “
“ আমি যখন বাজে কথা বলছি তখন তো তুই নিজেই পছন্দ করে নিতে পারিস্। আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছিস্?”
এই বলে মিলি মুখটা কাচুমাচু করে রবির দিকে পেছন ফিরে বসে পড়ল। রবি তখন মনে মনে ভাবল এই রে! মিলি যদি এখন রেগে গিয়ে ঠিক করে না খায় তখন মা আমাকেই বলবে যে আমি মিলিকে রাগিয়ে দিয়েছি।
রবি বলল-
“ আচ্ছা বাবা ঠিক আছে। এখন আর দয়া করে রাগ করিস্ না। মা ডাকছে খেতে চল্। “
রবি দেখল মিলি তখনও ঐভাবেই বসে আছে। রবি আবার বলল-
“ আরে বাবা! এই দেখ্ আমি কান ধরছি। দেখ্ একটু এদিকে তাকা। প্লিজ্……”
মিলি পেছন ফিরে রবির দিকে তাকাতেই হেসে ফেলে।
পরের দিন সকাল বেলায় মিলি ঘুম থেকে উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে হোয়াটসআ্যপ-টা অন্ করে দেখে সেখানে অনেকগুলো মেসেজের মধ্যে রবির নামেও তিনটে মেসেজ রয়েছে। রবির চ্যাট বক্সটা খুলে মিলি দেখে দুটো ছবি রয়েছে এবং তার নীচে লেখা রয়েছে – “ কাকে বেশি ভালো লাগছে বল্ “। মিলি মেসেজ আসার সময়টা দেখে মনে মনে ভাবল যে রাত ৩টের সময় মেসেজ আসা মানেই রবি সারা রাত ঠিক করে ঘুমোইনি। ছেলেটা কি বিয়ে পাগল হয়ে গেল? মিলি ছবি দুটো ডাউনলোড করে মেসেজে লিখে দিল- “ লাল শাড়ি পড়া মেয়েটাকেই বেশি ভালো লাগছে। “
সেইদিন মিলির বাড়িতে ছোট মাসি আর ছোট মেসো আসায় সারাদিন মিলির রবির ব্যাপারটা খেয়াল ছিল না। সন্ধ্যেবেলায় মাসি-মেসো বেরিয়ে যাওয়ার পর একটু রেস্ট নেওয়ার জন্য ঘরে গিয়ে বিছানায় বসে তার হঠাৎ মনে পড়ল রবির কথা। আর তখনি মোবাইলটা হাতে নিয়ে হোয়াটসআ্যপ-টা অন্ করে দেখে রবির মেসেজ। তাতে লেখা আছে- “কাল বিকেলে আমি লাল শাড়ি পড়া মেয়েটাকে দেখতে যাব। তোকে পরে কল করে সব বলব। “
পরের দিন মিলি রবির সাথে কথা বলে জানতে পারে যে রবির মেয়েটাকে বেশ পছন্দই হয়েছে।
. . . . .
এরপর সাত-আট মাস কেটে যায়। আজকাল মিলির মাঝে মাঝেই বেশ মন খারাপ হয়। কোথাও গিয়ে যেন মনের কথা বলার মানুষটাকে সে খুঁজে পায় না। এখন আর আগের মতো রবির সাথে বেশি কথাও হয় না। বলা ভালো মিলিই বরং রবির সাথে বেশি কথা বলতে চায় না। রবিও এখন আর আগের মতো নেই। অনেকটাই পালটে গেছে। আগে যতটা সময় মিলি রবির কাছ থেকে পেতো এখন আর সেটা পায় না। মিলিও মনে মনে ভাবে এটাই তো স্বাভাবিক। বিয়ের আগে একে অপরকে জানার জন্য রবির তো এখন মৌমিতাকেই বেশি সময় দেওয়া উচিৎ। দুজনকে পাশাপাশি বেশ মানায়। নাহ্ঃ মিলি কাখনও সামনাসামনি ওদেরকে দেখেনি। রবিই ছবি পাঠিয়েছিলো। সেদিন ওরা একটা রেস্টুরেন্টে খেতে যায়। রবি অবশ্য মিলিকে অনেকবার বলেছিল একদিন দেখা করতে, মৌমিতার সাথে আলাপ করিয়ে দেবে। কিন্তু মিলি প্রতিবারই কোনো না কোনো অজুহাত দেয় দেখা না করার জন্য। ওহ্! বলা হয়নি। মৌমিতাই হচ্ছে সেই লাল শাড়ি পড়া মেয়েটা। মিলিও অনেকসময় বুঝতে পারে না যে তার এই মন খারাপের কারণটা কি এতো বছরের চেনা বেস্ট ফ্রেন্ডকে ধীরে ধীরে পালটে যেতে দেখে নাকি অন্যকিছু?
একদিন রাত ১২টার সময় মিলিকে রবি কল করে। কলটা রিসিভ করে মিলি বলল-
“ কি রে? এতো রাতে কল করলি যে? সব ঠিক আছে তো? “
“ এই প্রশ্নটা করলি যখন তখন মনে হচ্ছে আমারই সুবিধা হবে। “
“ কি সুবিধা হবে? “
“ সেটা তো একটু পরেই বুঝতে পারবি। তুই আগে রান্না ঘরে গিয়ে ফ্রিজটা খুলে দেখ্। “
“ কেন? কি দেখার আছে ওখানে? “
“ উফ্! এত প্রশ্ন না করে যা বলছি তাই কর্। “
“ প্রেম করছিস্। কয়েকদিন পর বিয়েও করবি। তবুও তোর পাগলামিটা গেল না। “
রবি একটু হেসে নিয়ে বলল-
“ পাগলামিটা চলে গেলে যে বন্ধুত্ত্বটা থাকবে না। “
এর মধ্যেই মিলি ঘর থেকে বেরিয়ে রান্না ঘরে গিয়ে ফ্রিজটা খুলে যা দেখল তাতে সে ভীষণ অবাক হয়ে রবিকে বলল-
“ এসব কি রবি? কিসের জন্য? “
রবি তখন গানের সুরে বলতে লাগল-
“ হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থডে টু মিলি। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। “
এতো মন খারাপের মধ্যে হঠাৎ পাওয়া আনন্দে মিলির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। তার মনে হতে লাগল সে যেন সেই আগের রবিকে ফিরে পেয়েছে। সত্যি কথা বলতে এত দিন ধরে মনের মধ্যে চলা দ্বিধা-দন্দ্বের ঘেরাটোপে মিলি নিজের জন্মদিনের কথাটাই ভুলে গিয়েছিলো। যেটা আগে কখনও হয়নি।
মিলি ভীষণ আনন্দের সাথে বলল-
“ থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ রবি। অফিসের এতো কাজের চাপে আমার সত্যিই আজকের দিনটার কথা মনে ছিল না। কিন্তু তুই এই কেক, আইসক্রীম, চকলেট এইসব কখন….মানে আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।“
“ তোর কোনো মানে বুঝতে হবে না। আমি কিন্তু কাল সন্ধ্যেবেলায় তোর বাড়িতে আসছি। তোর কোনো আপত্তি নেই তো? “
“ তুই কি পাগল হয়েছিস্? তুই আসবি আর আমার আপত্তি থাকবে। এটা তুই ভাবলি কি করে? “
“ আসলে তুই তো আজকাল আমার সাথে বেশি কথা বলতে চাস্ না। ভীষণ ব্যাস্তও থাকিস্। যাই হোক। কাল তোর আর আমার দুজনেরই অফিস আছে। তাই আর এখন বেশি কথা বলব না। কাল দেখা হচ্ছে। গুড নাইট।“
“ আচ্ছা। গুড নাইট। “
. . . . .
পরের দিন মিলি অফিসের লাঞ্চ টাইমে বসে লাঞ্চ করছিল। এমন সময় ফোনে রবির নম্বর থেকে একটা কল আসে। ফোনটা রিসিভ করতেই ফোনের ওপার থেকে যেসমস্ত কথা শুনতে পায় তাতে মিলির হাত থেকে খাবারের চামচটা টেবিলের উপর পরে যায়।
দুপুর তখন দেড়টা বাজে। মিলি স্কুটি থেকে নেমে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে অটোমেটিক দরজাটা খুলে যাওয়ার পর ভেতরে ঢুকে ব্যস্তভাবে ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে একটা নম্বরে কল করে উত্তেজিতভাবে বলে উঠল-
“ হ্যালো কাকিমা…আমি এসে গেছি। তোমরা কোথায়? “
“ ওহ্! তুই এসে গেছিস। তাহলে তুই লিফট্-এ করে তিনতলায় উঠে ডানদিকে একটু এগোলেই আমাদের দেখতে পাবি।“
“ আচ্ছা আমি আসছি। “
এরপর মিলি লিফট্-এ করে তিনতলায় উঠে ডানদিকে একটু এগোনোর পর রবির মা-বাবাকে দেখতে পায়। তাদের সামনে গিয়ে মিলি বলল-
“ রবি এখন কেমন আছে? “
রবির মা শান্ত গলায় বললেন-
“ এখন তো সুস্থই আছে। সিরিয়াস কিছু হয়নি। তোকে ফোন করার কিছুক্ষণ আগেই ওর জ্ঞান ফিরেছে। তারপর থেকেই খালি বলছে মিলিকে ডাকো। তোর সাথে ওর নাকি ভীষণ জরুরি কথা আছে। কতবার বললাম মেয়েটা এখন অফিসে আছে। এই মুহূর্তে…………”
মিলির যেন আর কোনো কথাই কানে ঢুকছে না। মাথাটা কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে। মনের ভেতরটা কেরকম অস্থির লাগছে। রবিকে যতক্ষণ না নিজে চোখে দেখতে পারছে ততক্ষণ যেন মিলি আর স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।
কেবিন থেকে ডাক্তার বেরিয়ে আসার পর সাথে সাথেই কেউ কিছু বলার আগে মিলি ডাক্তারকে বলল-
“ ডাক্তারবাবু? আমি কি এখন ভেতরে যেতে পারি? “
ডাক্তার একটু অবাক হয়ে বললেন-
“ আপনার পরিচয়? “
মিলি এমন ব্যাস্তভাবে বলল যে এরকম ব্যাস্ততা ওর জীবনে আগে কখনও হয়নি। মিলি বলল-
“ আমি মিনাক্ষী সেনগুপ্ত। অর্জুনের বন্ধু হই। “
ডাক্তারের মুখের হাবভাব দেখে রবির মা বুঝতে পারলেন যে তিনি বুঝতে পারেননি মিনাক্ষীই যে মিলি। তাই রবির মা বললেন-
“ ডাক্তারবাবু ও মিলি। ওকে ভেতরে যেতে দিন। “
ডাক্তার এবার ব্যাপারটা বুঝতে পেরে একটু হেসে নিয়ে বললেন-
“ আচ্ছা…আপনই মিলি? তাহলে তো আপনার এক্ষুনি যাওয়া উচিৎ। “
মিলি আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে কেবিনের ভেতর ঢুকে গেল। এদিকে কেবিনের জানালার ধারে বেডের উপর শুয়ে রবি অধীর আগ্রহের সাথে মিলির জন্য অপেক্ষা করছিল। এমন সময় দেখল দরজা ঠেলে একজন ভেতরে ঢুকে এল। কিন্তু ভেতরে তো ঢুকল। তবে তার গতি দরজার সামনেই আটকে গেল। তাকে দেখে অসীম আনন্দের সামান্যতম প্রকাশ করে মুখে একটু হাসি নিয়ে রবি বলল-
“ কি রে? ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি? “
মিলি ধীর পায়ে রবির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। আর সাথে সাথেই হাসি মাখানো মুখে চোখ দিয়ে বেরিয়ে এল জল। বেডের পাশের চেয়ারটায় বসে রবির হাতে হাত রেখে চাপা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। রবি মিলির মাথায় হাত রেখে বলল-
“ আরে পাগলি কাঁদছিস কেন? আমার কিছু হয়নি। এই দেখ তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে। “
এই বলে রবি মিলির হাতে একটা ডায়েরি ধরিয়ে দিল। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে মিলি ভীষণ অবাক হয়ে যায়। মনে মনে ভাবল যে রবি ডায়েরিটা পেল কি করে? ও কি তাহলে সবটা জেনে গেল? এরকম অনেক প্রশ্ন মিলির মনে ঘোরাফেরা করতে লাগল।
রবি মিলির মনের অবস্থাটা বুঝতে পেরে বলল-
“ ভীষণ অবাক হয়ে গেলি? ভাবছিস্ আমি তোর ডায়েরিটা কিভাবে পেলাম? সেটার উত্তর না হয় পরে দেব। আগে এটা আমায় বল্তো তুই কবে থেকে ডায়েরি লেখা শুরু করলি? আমি তো জানতাম তোর নাকি ডায়েরি লিখতে ভালোই লাগে না। “
মিলি কিছুই বলতে পারছে না। ডায়েরিটাকে উত্তেজনায় শক্ত করে ধরে মাথা নিচু করে বসে আছে। আর মনে মনে ভাবছে রবি কি তাহলে সবটা জেনে গেছে? ও কি তাহলে আমার সাথে আর কথা বলবে না?
রবি আবার বলল-
“ এতদিন ধরে কথা গুলো বলিসনি কেন? “
মিলি এবার বেশ সংকোচের সাথে বলল-
“ আমি যখন জানি যে তুই মৌমিতাকে বিয়ে করবি সেখানে কি করে তোকে কথা গুলো বলতাম? ভেবেছিলাম যে…..”
মিলির গলা কান্নায় বুজে আসছে। সে আর কিছু বলতে পারছে না।
রবি বলল-
“ আর তুই ভেবেছিলিস্ যে আমি তোকে খারাপ ভাব্ব। এত বছেরের বন্ধুত্বটা ভেঙ্গে দেব। এটাই তো? একটা মজার বিষয় কি জানিস? তোর মতো ঠিক এরকমই একটা ভাবনা মনের মধ্যে নিয়ে এতদিন আমি ভুল পথে হাঁটছিলাম। তোকে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারিনি। “
মিলি মুখ তুলে কান্না ভেজানো লাল চোখে রবির দিকে তাকাল। এতক্ষণ ধরে চলা কান্নার পেছনে যে কান্নাটা আরও অনেক আগে থেকেই লুকিয়ে ছিল যেটা কখনও প্রকাশ করতে পারেনি হয়তো সেটা প্রকাশ করার মতো সময় এসে গেছে।
রবি মিলির মুখের দিকে চেয়ে বলল-
“ তোর মতন গতকাল আমিও অবাক হয়ে গিয়েছিলাম যখন তোর বাড়ি থেকে এই ডায়েরিটা পাই। অফিস থেকে হাফ্ ছুটি নিয়ে তোকে সারপ্রইজ দেব বলে ঐসব কেক, আইসক্রীম আর একটা গিফট্ কিনে নিয়ে যখন বাড়িতে গেলাম তখন তোর ঘরে গিফটটা রাখতে গিয়ে দেখি স্টাডি টেবিলে একটা ডায়েরি রাখা। ডায়েরিটা খুলে দেখলাম তোর হাতের লেখা এবং ডায়েরির প্রথম পাতাটা পরে বুঝলাম যে লেখাগুলো আমাকে উদ্দেশ্য করেই লিখেছিস্। মনে মনে ভাবলাম যে মেয়েটা কোনোদিন ডায়েরি লেখে না। কিন্তু আজ সে ডায়েরি লিখছে। আবার লেখার মূল বিষয় হলাম আমি। তখনই বুঝে গেছিলাম যে ডায়েরির লেখা গুলো তুই নিজে মুখে আমায় কোনোদিন বলবি না। মনে হল এই ডায়েরিটা আমার পড়া উচিৎ। আর সেই জন্যই ডায়েরিটা সাথে করে নিয়ে চলে যাই। তারপর বাড়িতে গিয়ে ডায়েরিটা পুরোটা পড়ার পর যতটা সারপ্রইজ হয়েছি সেটা গতকাল রাতে আমার থেকে পাওয়া তোর সারপ্রইজ হওয়ার থেকেও বেশি। ভেবেছিলাম আজ এই বিশেষ দিনে তোর বাড়িতে গিয়ে এই ডায়েরিটা তোর হাতে দিয়ে আর এতদিনের না বলা কথা গুলো বলে তোকে সারপ্রইজ দিতাম। কিন্তু বিনা নেমন্তন্নে এই অ্যাক্সিডেন্টটা হাজির হয়ে আমার সব প্ল্যানে জল ঢেলে দিল। “
মিলি সবটা শোনার পর সংকোচের সাথে ক্ষীণ স্বরে বলল-
“ তাহলে মৌমিমাতার কি হবে? ও তো খুব কষ্ট পাবে। “
“ সত্যি কথা বলতে কি মিলি কষ্ট পাওয়ার মতো সেই সম্পর্ক আমাদের মাঝে এখনও তৈরি হয়নি। আর কোনোদিন হবেও না। যেমন নদীর দুটো পার কখনও একে অপরের সাথে মিশতে পারে না। “
এমন সময় মিলি রবির বুকে মাথা রেখে রবির হাতের উপর নিজের হাতটা রাখল। রবি মিলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল-
“ মিলি নদীর পার দিয়ে আমি একাই হাঁটছি। তুই কি হাঁটবি আমার সাথে? “
এই সময় রবির বাবা হটাৎ ঘরে ঢুকে ওদের দুজনকে অপ্রস্তুত করে দিয়ে বললেন-
“ অবশ্যই হাঁটবে। আগামী মাসেই আমি তোদের এই পথ চলার শুভ সূচনার ব্যবস্থা করব। হ্যাপি যার্নি ফ্রম বেস্ট ফ্রেন্ড টু বিয়ে ফ্রেম। কি অসুবিধা নেই তো? “
এই বলে রবির বাবা হো হো করে হাসতে লাগলেন।