STORYMIRROR

Nikhil Mitra Thakur

Action

4  

Nikhil Mitra Thakur

Action

অগ্নিকন্যা সরলা দেবী চৌধুরানী

অগ্নিকন্যা সরলা দেবী চৌধুরানী

4 mins
370

সরলা ঘোষাল (চৌধুরী) ( ১৮৭২- ১৯৪৫) 

১৮৭২ সালের ৯ সেপ্টেম্বর কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে সরলা ঘোষালের জন্ম হয়। তাঁর পিতা ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জানকীনাথ ঘোষাল। তিনি ছিলেন নদীয়ার জয়রামপুরের জমিদার এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।  রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিদি স্বর্ণকুমারী ঘোষাল ছিলেন সরলা দেবীর মা। তিনি ছিলেন সাহিত্যিক। তার মামা ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই জন্ম থেকে তিনি যেমন রাজনৈতিক ধ্যান ধারণা পেয়েছেন তেমনি পেয়েছেন সাহিত্য চর্চার পরিমন্ডল।

পিতার বিদেশ যাত্রার কারণে সরলা দেবীর শৈশব কাটে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। তিনি ১৮৮৬ সালে বেথুন কলেজ থেকে এন্ট্রাস পাস করেন। সেই বেথুন কলেজ থেকেই ১৮৯০ সালে ইংরেজি অনার্স সহ বিএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়ে তিনি "পদ্মাবতী স্বর্ণপদক" লাভ করেন। দক্ষিণভারত বেড়াতে গিয়ে তার সাথে মহীশূরের দেওয়ান নরসিংহ আয়েঙ্গারের পরিচয় হয়।নরসিংহবাবু তাকে মহীশূরের মহারাণী গার্লস কলেজে এর সুপারিনটেনডেন্ট পদে যোগদান করার জন্য আহ্বান জানান। সরলাদেবী রাজী হন এবং চাকরিতে যোগদান করেন।

১৮৯৫ সাল থেকে তিনি সেই সময়ের বিখ্যাত পত্রিকা, 'ভারতী' পত্রিকার সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৮৯৯ থেকে ১৯০৭ সাল পর্যন্ত একক হাতে 'ভারতী' পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই পত্রিকাকে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন।

সরলা দেবী ছিলেন খুব দক্ষ একজন সঙ্গীতজ্ঞা। তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতারাম সংগীতের দ্বিতীয় পঙতির পরের অংশটির সুর দিয়েছিলেন। এই গানটি ছিল সেই সময় স্বদেশী বিপ্লবীদের বীজ মন্ত্র। এছাড়াও তিনি রবীন্দ্রনাথের বহু গানের সুর দিয়েছিলেন। লেখালেখি তো ছিলেন তিনি বেশ পারদর্শী। তিনি 'নববর্ষের স্বপ্ন',

'জীবনের ঝরাপাতা', 'শিবরাত্রির পূজা' ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।

মহীশূর থেকে ফিরে তিনি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি ১৯০৩ সালে ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’ 'শিবাজী উৎসব' ও ‘বীরাষ্টমী ব্রত’ পালন করেন। যতীন্দ্রমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে গুপ্ত বিপ্লবী দল গঠনে তিনি সহায়তা করেন। ১৯০৪ সালে স্বদেশী আন্দোলন অংশ গ্রহণ করেন। তিনি তাঁতবস্ত্র প্রচার ও প্রথম লক্ষ্মীর ভান্ডার স্থাপন করেন। 

১৯১০ সালে দুস্থ বাঙালি নারীদের রোজগারের ব্যবস্থা করার জন্য তিনি এলাহাবাদে "ভারত স্ত্রী মহামন্ডল" প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই সংস্থা ছিদ নারীদের কল্যাণের জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রথম সর্বভারতীয় একটি সংস্থা।দিল্লি,করাচি,অমৃতসর, লাহোর,কানপুর, বেনারস,প্রভৃতি বিভিন্ন জায়গায় এই সংস্থার শাখা ছিল। জাতি- ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে এই সংস্থায় সকল নারীদের শিক্ষা দেওয়া হতো এবং হাতের কাজ শেখানো হতো। 

১৯১৩ সালে পন্ডিত রামভূজ দত্তচৌধুরীর সাথে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি পাঞ্জাবে চলে যান। স্বামী পন্ডিত রামভূজ দত্তচৌধুরীর ছিলেন লাহোর থেকে প্রকাশিত উর্দু পত্রিকা হিন্দুস্থান-এর সম্পাদক। তিনি ছিলেন আইনজীবী,সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। তিনি ছিলেন দয়ানন্দ সরস্বতী প্রতিষ্ঠিত আর্যসমাজের পাঞ্জাবের নেতা। 

সেইসময় বিয়ের সূত্রেই সরলাদেবী (চৌধুরানী) পাঞ্জাবের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে পর্দানশীন মহিলাদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী হয়েছিলেন। এখানেই বিধবাদের জন্য "বিধবা শিল্পাশ্রম" গড়ে তুলেছিলেন। এখানে বিধবাদের শিক্ষা দেওয়া হতো এবং হাতের কাজ শেখানো হতো। তাদের একমাত্র পুত্র ছিলেন দীপক দত্ত চৌধুরী। তিনি পরবর্তীকালে গান্ধীজীর নাতনী রাধাকে বিয়ে করেছিলেন।

অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়ার জন্য সরলা দেবীর স্বামী রামভুজ দত্ত চৌধুরীকে ইংরেজ পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এই ঘটনার পর থেকে গান্ধীজীর সঙ্গে সরলা দেবীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলন যোগ দেন। তিনি সারা ভারতবর্ষ

ঘুরে স্বাধীনতা আন্দোলনের স্বপক্ষে বক্তৃতা দিতে থাকেন। স্বদেশী জিনিস ব্যবহারের জন্য ভারতবাসী কে উৎসাহিত করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করেন।

বাঙালি ছেলেদের ইংরেজ সৈরবাহিনীতে যোগদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য ইংরেজ সরকার থেকে তাকে একটি সম্মানীয় ব্যাজ দেওয়া হয়। তিনি ১৯১৯ সালে তিনি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে সেই ব্যাজ ফিরিয়ে দেন। এরপর একটা সময়ে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে সরলা দেবীর যোগাযোগ তৈরি হয়।নেতাজী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি মনে করেন একমাত্র সশস্ত্র বিপ্লবী ভারতবর্ষে স্বাধীনতা আনতে পারবে। এর ফলে তার সঙ্গে গান্ধীবাদী স্বামী রামভুজের দূরত্ব তৈরি হয়। তিনি স্বামীর আশ্রয় ছেড়ে আশ্রমে চলে যান।

১৯২৩ সালে সরলা দেবীর স্বামী রামভুজ দত্ত চৌধুরী অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি অসুস্থ স্বামীর সেবা করার জন্য মুসৌরিতে চলে যান। এই বছরেই অসুস্থ রামভুজ দত্ত চৌধুরী মারা যান। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি দীর্ঘদিন একক হাতে হিন্দুস্তান পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

১৯৩০ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসেন। এখানে ফিরে তিনি 'ভারত স্ত্রী মহামন্ডল'এর অনুরূপ একটি প্রতিষ্ঠান কলকাতায় ‘ভারত স্ত্রী শিক্ষাসদন’ গড়ে তুলেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠান থেকে মহিলাদের তরবারি চালনা, লাঠি খেলা ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়া হতো। এই সময় তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য একটি গুপ্ত সমিতি গড়ে তোলেন যার সাথে বহু তরুণ বিপ্লবী যুক্ত ছিলেন।জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সূত্রে সরলা দেবীর সাথে লালা লাজপত রায়,গোপালকৃষ্ণ গোখলে, বালগঙ্গাধর তিলক,মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ ব্যক্তিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ তৈরি হয়।

১৯৩৫ সালে জনজীবন থেকে অবসর নিয়ে তিনি ধর্মীয় জীবনে ফিরে আসেন। প্রথম জীবনে তিনি থিওসফিক্যাল সোসাইটি এবং পরে রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ জীবনে তিনি বৈষ্ণব গুরুদেব বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্মার কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন। 

এই বীরাঙ্গনা অগ্নিকন্যা ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট ৭৩ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Action