রীতার নিখোঁজ রহস্য
রীতার নিখোঁজ রহস্য


রীতার বাবা রতন বাবু সরকারে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা।
বর্তমান সময়ে যে কোন রাজনৈতিক নেতার মতোই তার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থান এখন আঙ্গুল ফুলে কলা গাছের মতো হয়েছে।
বড় প্রাসাদ আকারের বাড়ি হয়েছে। গোটা দুয়েক দামী দুচাকা ও একটা বেশ দামী চারচাকা গাড়ি তার বাড়ির সামনে সর্বদা দাঁড়িয়ে থাকে।
হাতে বেশ মোটা সোনার ব্রেসলেট ও গলায় মোটা বাপি লাহিড়ী মার্কা মোটা সোনার হার। বৌয়ের ও মেয়ের জন্যেও মাঝে মাঝেই হার,বালা,বাউঠি বাড়িতে চলে আসে।
আর চেলা চামুন্ডা হাতে গোনা যায় না। যতো অশিক্ষিত ও অর্ধশিক্ষিত বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো মাতাল ছেলে আছে সবার উনি ভাইজান। ওরা বেঁধে দেওয়া নিজের এড়িয়ায় যা তোলে তার পঁচিশ শতাংশ রেখে পঁচাত্তর শতাংশ ভাই জানকে দিয়ে যায়।
বাজারের দোকান ও হাটের দোকান থেকে তোলা আদায় তো আছেই। এছাড়া শহরে যতো বালি, পাথর ও ইটের গাড়ি ঢোকে সব গাড়ি থেকে রতন ট্যাক্স তোলা হয়।
এখন রতন ভাইজানের পুলিশ মহলে প্রভাব আছে, যে কোন সরকারি অফিসে প্রভাব আছে।
মাথায় কোলকাতার বড় বড় নেতাদের আশীর্বাদ আছে।
কিন্তু, এহেন রতন ভাইজানের একটা জিনিসের বড় অভাব রয়ে গেছে। সেটা এখনো মিটাতে পারে নি। সেটা হল শিক্ষার অভাব।
আর এটার অভাবের কারণেই মানুষের মূল্য ওর কাছে কমে গেছে। আর ওর ইগো খুব শক্ত হয়ে ওঠে মাঝে মধ্যে এবং এসবের জন্য উনাকে জন্য ক্ষতিও স্বীকার করতে হয়।
রতন জোয়ারদার সরস্বতী পুজোর রাতে বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখেন মেয়ে তখনও বাড়ি ফিরে আসেনি।
সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন চেলা চামুন্ডাকে স্কুলের অনুষ্ঠানের জায়গায় খোঁজ নিতে পাঠিয়ে দেন।
তারা গিয়ে দেখে স্কুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রাত্রি ৯টার সময় শেষ হয়ে গেছে। এখন সেখানে কেউ নেই।
চেলাদের ফোনে একথা জেনে রতন বাবু দলবল নিয়ে থানায় যান। মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারে এফ আই আর করেন। পুলিশকে আল্টিমেটাম দেন যে মেয়েকে আগামীকালের মধ্যে খুঁজে বের দিতে হবে।
থানা থেকে বের হয়ে নিজের চেলা চামুন্ডাদের নিয়ে শহরের বিভিন্ন জায়গায় খোঁজা খুঁজি শুরু করেন।
কোথাও কোন ভাবে মেয়ের খোঁজ না পেয়ে গভীর রাতে রতনবাবু বাড়ি ফিরে রিন্টুর বাবার ফোন থেকে জানতে পারেন মেয়ে ওদের গ্রামের বাড়ি চলে গেছে।
রতন বাবু ফোনে একদফা রিন্টুর বাবা ও মাকে বিছ্রি ভাষায় হুমকি দিয়ে শান্ত হন।
পরের দিন সরস্বতী পুজোর জন্য স্কুলে খিচুড়ি খাওয়ানো হবে বলে ঠিক ছিল। সমস্ত ছাত্র ছাত্রী স্কুলে এসেছে। আজ স্কুলে অনেক অভিভাবক ও অভিভাবিকাও এসেছেন ।
রতন বাবু এমন একটা দিনে দলবল নিয়ে স্কুলে এসে প্রধান শিক্ষককে গালিগালাজ করেন ও হুমকি দেন যে রীতার কোন ক্ষতি উনিও প্রধান শিক্ষককে ছেড়ে দেবেন না।
গন্ডোগোলের আওয়াজ শুনে অন্যান্য কিছু শিক্ষক ও শিক্ষিকা ছুটে আসেন। তারা রতন বাবুকে বোঝাবার চেষ্টা করেন যে গতকাল স্কুলে এত লোক হয়েছিল যে আমাদের পক্ষে কে স্কুলে এসেছিল,আর কে আসেনি
তা দেখা সম্ভব ছিল না।
একথা শুনে রতন বাবু আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। শিক্ষক দের উদ্দেশ্য করে বলেন আপনারা সামলাতে না পারলে
স্কুলে অনুষ্ঠান করতে যান কেন?
ইতিমধ্যে বেশ কিছু ছাত্র ও ছাত্রী অফিসের দিকে আসতে থাকে। সেটা দেখে এক চেলা কানে কানে বলে বশ আর এখানে থাকা ঠিক হবে না। ছাত্র ছাত্রীরা গর্জে উঠলে পালাবার পথ পাবেন না।
আবার, ওদের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পরলে তা খবরের কাগজে ও খবরে প্রচার পেয়ে যাবে। সেটা হলে উপর মহল থেকে আপনার উপর চাপ আসবে।
তাই বশ এখন তাড়াতাড়ি আমাদের স্কুল থেকে বেরিয়ে যাওয়া উচিত।
চেলাদের কথায় আর দেরি না করে রতনবাবু স্কুল ছেড়ে বেরিয়ে যান। তখনকার মতো স্কুল চত্বর ঠান্ডা হয়।
বেলা বারোটা নাগাদ স্কুলে পুলিশ আসে। পুলিশ এসে বেশ কিছুক্ষণ প্রধান শিক্ষককে নানা বিষয় জিজ্ঞেস করে।
ওই মেয়েটির বিশেষ কোন সম্পর্কের কথা প্রধান শিক্ষকের জানা আছে কি না?
এর আগে কোন শিক্ষক বা ছাত্র-ছাত্রী মেয়েটির বিষয়ে তাকে কিছু জানিয়েছিল কি না?
ওইদিন কোন কোন শিক্ষক/ শিক্ষিকা অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন?
প্রধান শিক্ষক দুইজন শিক্ষকের নাম করে বলেন ইনারা ওই দিন দায়িত্বে ছিলেন।
পুলিশের পক্ষ থেক
ে ওই শিক্ষকদের ডেকে দেওয়ার কথা বলা হয়।
প্রধান শিক্ষক জানান ওই দুইজন শিক্ষককে আজ ছুটি দেওয়া হয়েছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে আগামীকাল ওই দুইজন শিক্ষককে থানায় দেখা করতে বলা হয় এবং তারা স্কুল থেকে চলে যায়।
প্রধান শিক্ষক আজকের ঘটনায় বেশ খানিকটা ভেঙে পড়েন। একজন পিয়নকে বলেন যদি রাজা স্কুলে এসে থাকে তাহলে একবার ডেকে নিয়ে এসো।
পিয়ন দেখে রাজা তখন বাচ্চা দের খিচুড়ি পরিবেশন করছে। রাজাকে ডেকে বলে তোমাকে প্রধান শিক্ষক একবার ডাকছেন।
প্রধান শিক্ষক ডাকছেন শুনে রাজা হাত ধুয়ে ছুটে আসে প্রধান শিক্ষকের অফিসে।
স্যার আমাকে ডাকছেন?
হ্যা রে বাবা। স্কুলে তো খুব বড় ঝামেলা হয়ে গেছে! রীতা নামের এক ছাত্রী কোথায় পালিয়ে গেছে। তুই কি ওর ব্যাপারে কিছু জানিস বাবা।
না, স্যার। আমি রীতাকে চিনি। ও প্রথম থেকে আমাদের স্কুলে পড়ে। তবে পালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে কিছু জানি না।
দেখ বাবা যদি কোন সন্ধান পাওয়া যায়। মেয়েটির বাবা তো এলাকার বড় নেতা। অনেক কথা স্কুলে এসে বলে গেল।
তাছাড়া,পুলিশ এসেছিল। ওরা তো ওদের মতো খোঁজ খবর করবে। তাই বলছিলাম তুই যদি কোন খোঁজ দিতে পারিস।
রতন বাবু স্কুল থেকে ফেরার পথে থানায় গিয়ে এখন আপাতত মেয়ের ব্যাপারটা নিয়ে বেশিদূর না এগোতে অনুরোধ করেন।
কিন্তু,রাজা প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে দায়িত্ব পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে নিজের মতো করে খোঁজ নিতে থাকে। কলা বিভাগে রীতার দুই বান্ধবী খিচুড়ি খাওয়ার জন্য স্কুলে এসেছিল।
রাজা ওদের সাথে কথা বলে জানতে পারে কলা বিভাগের রিন্টু নামের একটি ছেলের সঙ্গে রীতা বেশ কিছু দিন হলো প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে ছিল।
রাজা খোঁজ নিতে শুরু করে দ্বাদশ শ্রেণির কলা বিভাগের রিন্টু নামের ছেলেটি আজ স্কুলে এসেছে কি না?
কলা বিভাগের সব ছেলেরাই বলে ওকে আজ স্কুলে দেখেনি।
রাজা বুঝতে পারে ডাল মে কুছ কালা হ্যায়। ওদেরকে রিন্টু কোথায় থাকে তা জিজ্ঞেস করে।
ওদের মধ্যে একজন বলে শরৎপল্লীর একটা মেসে থাকে শুনেছি।
রাজা এক বন্ধুর সাথে শরৎ পল্লী পৌঁছে যায়। ওর প্রথম লক্ষ্য এই পাড়ায় কতগুলো মেসবাড়ি আছে সেটা জেনে নেওয়া।
মোড়ের মাথায় একটা চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে রাজা খুব সহজভাবে জিজ্ঞেস করে এই পাড়ায় কয়টা মেসবাড়ি আছে?
চায়ের দোকানের মালিক বলে এই পাড়ায় চারটি মেস বাড়ি আছে। এগুলোর মধ্যে একটা শুধু মেয়েদের। আর বাকি তিনটি ছেলেদের। আপনারা কজন আছেন?
আমি একাই আছি। মেসবাড়ি গুলোর ঠিকানা যদি দিতেন তাহলে দেখে নিয়ে ঠিক করতাম কোন মেস বাড়িতে থাকবো।
চায়ের দোকানের মালিক তিনটি মেসে বাড়ির ঠিকানা বলে দিলেন। রাজা একটা কাগজে লিখে সেদিনের মতো বাড়ি চলে আসে।
পরের দিন সকালে ব্রেকফাস্ট খেয়ে রাজা বাস ধরে এসে নামে শরৎ পল্লীর সেই মোড়ে। সন্তর্পনে চা দোকান এড়িয়ে একটা মেস বাড়ির দিকে এগোতে থাকে।
প্রথম মেস বাড়ি পৌঁছে রাজা মেসের একটা ছেলের সাথে কথা বলে জানতে পারে এখানে রিন্টু নামে কেউ ছিল না। আর মেসের সবাই মেসেই রয়েছে।
রাজা এবার দ্বিতীয় মেস বাড়ির ঠিকানায় এগোতে থাকে। ওখানে গিয়ে বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারে রিন্টু এখানেই থাকতো।
বাড়ি মালিক আরো বলেন, অন্যসব ছেলেরা সরস্বতী পুজোয় বাড়ি চলে গিয়েছিল। রিন্টু প্রথমে বলেছিল ও গ্রামের বাড়ি যাবে না। কিন্তু, সরস্বতী পুজোর দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ করে বলে আমি বাড়ি যাচ্ছি।
রাজা আর কথা না বাড়িয়ে রিন্টুর গ্রামের ঠিকানা নিয়ে ফিরে আসে।
পরের দিন সকাল বেলায় বের হয়ে ট্রেনে ও বাসে চেপে সন্ধ্যা নাগাদ রিন্টুর বাড়িতে পৌঁছায়।
রীতা ও রিন্টু ওকে দেখে চিনতে পারে। ওর আসার কারণ জানতে চায়।
রাজা বলে প্রধান শিক্ষক আমাকে পাঠিয়েছেন খবরটা সত্য কি না জানার জন্য। গল্পের ছলে রাজা জানতে চায় হঠাৎ করে ওদের বিয়ে করার কারণ কি? রাজা জানতে পারে রীতার পেটে বাচ্চা এসে যাওয়ার জন্য ওরা এইভাবে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে।
রাতে ওখান থেকে ফিরে আসার কোন সুযোগ নেই। তাই রাজা বাধ্য হয়ে রিন্টুদের বাড়িতে রাত কাটিয়ে সকালে বাড়ি ফিরে আসে এবং সেদিনই স্কুল ফিরে গিয়ে প্রধান শিক্ষককে ঘটনা সবিস্তারে রিপোর্ট করে।