ভালোবাসার কুঁড়ি থেকে ফুল
ভালোবাসার কুঁড়ি থেকে ফুল
শিরোনামঃ ভালোবাসার কুঁড়ি থেকে ফুল
নিখিল মিত্র ঠাকুর
ভীড়ের মাঝে অনিমাকে দেখতে পেয়ে রাজা হাত ধরে ঘরের ভিতরে নিয়ে আসে।
পাড়াপড়শি উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে যায় রাজার কান্ড দেখে। অনিমা গ্রামের মেয়ে হলেও রাজাদের পাড়ার নয়।
ঝালকাঠি গ্রামের উত্তর পাড়ায় অনিমাদের ঘর। আর রাজা দের ঘর পূর্ব পাড়ায়।
গ্রামে নিজের পাড়ার মা কাকিমা দের সামনে কোন মেয়েকে হাত ধরে ঘরের ভিতরে নিয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক বৈ কি!
কিন্তু,কিশোর মনে যদি কোন পাপবোধ না থাকে বা নিজের কাজ সঙ্গত মনে হয় তবে তারা সমাজের বস্তা পঁচা নিয়ম কানুনকে খুব সহজেই বুড়ো আঙুল দেখিয়ে থাকে। রাজার ক্ষেত্রেও সেদিন তাই ঘটেছিল।
কালীপদবাবু সরকারী অফিসে চাকরি করেন। অনামিকা ও একমাত্র ছেলে রাজাকে নিয়ে উনার বেশ সুখী ও স্বচ্ছল পরিবার।
রাজা পড়াশোনায় বেশ ভালো। দেখতে শুনতেও বেশ ভালো। পাড়ার সকলেই ওকে খুব স্নেহ ও আদর করে।
হটাৎ ওদের পরিবারে নেমে আসে বিপর্যয়। অনামিকার শরীরে দুরারোগ্য রোগ বাসা বাঁধে। দেশের নাম করা সব হাসপাতালে ভালো ভালো ডাক্তার দেখানোর পরে মাস ছয়েক আগে জানা যায় অনামিকার ক্যানসার হয়েছে ।
কেমো নিতে নিতে অনামিকার শরীর আর সহ্য করতে পারছে না। অনামিকা এখন বিছানায় শুয়ে থাকে। উঠতে বসতে পারে না।
কালীপদবাবু বাড়ির সব কাজ করার জন্য একজন কাজের লোক রেখেছেন। এই গ্রামেরই বয়স্ক এক মহিলা। তিনি অনামিকাকে বেশ যত্ন করেন।
কালীপদবাবু অফিস থেকে ফিরে রাতের দিকে অনামিকা দেবীকে দেখভাল করার কাজ নিজেই করেন।
বয়েস কম হলেও রাজা পড়াশোনা করার ফাঁকে মায়ের যথেষ্ট খেয়াল রাখে।
আজ অনামিকাদেবী ইহ জগতের সব মায়া ও বন্ধন ত্যাগ করে বৈকুণ্ঠ ধামের দিকে যাত্রা করেছেন।
পাড়ার সব মহিলা ও পুরুষ রাজাদের বাড়িতে শেষ দেখা দেখতে এসেছেন।
পুরুষেরা শেষকৃত্য করার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় করতে ব্যস্ত।
রাজার সঙ্গে পড়াশোনা করার সূত্রে অনিমা ছোট থেকেই রাজাদের বাড়ি আসা যাওয়া করে। অনামিকাও ওকে খুব স্নেহ করতেন।
অনিমা গরীব পরিবারের মেয়ে বলে অনামিকাদেবী ওকে রাজার সঙ্গে ভালো মন্দ খাওয়াতেন।
বাস্তবিকপক্ষে, অনামিকাদেবী ও কালীপদবাবু দুই কিশোর ও কিশোরীর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতেন।
অনামিকাদেবী ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতেন যেন এই রকম ভালোবাসা ওদের মধ্যে সারাজীবন থাকে। তাই ঘরের মেয়ের মতোই অনিমা এই বাড়িতে আসা যাওয়া করতো ।
দুঃসংবাদ পেয়ে অনিমা ছুটে এসেছে অনেকক্ষণ আগেই। কিন্তু ভীড় ঠেলে ভিতরে ঢুকতে পারে নি।
ভিতরে গিয়ে অনিমা রাজাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে। অনামিকা দেবীর মরদেহের গলা জড়িয়েও কাঁদতে থাকে।
পাড়াপড়শি যতো মহিলা 'কি বেহায়া মেয়ে রে বাবা!' বলতে বলতে বাড়ি ফিরে যায়।
কালীপদবাবু খবর পেয়ে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে এসেছেন। অনিমা দেবীর একমাত্র বোন পরিবার নিয়ে পৌঁছে গেছে। আর তেমন কোন আত্মীয় আসার নেই। তাই এবার শেষকৃত্য করার ব্যবস্থা করতে হবে।
পাড়ার বয়স্ক মানুষেরাও তাড়া দিচ্ছেন শেষকৃত্য করার জন্য শশ্মানে নিয়ে যেতে। বেশি রাত্রি হলে নদী ঘাটে অসুবিধা হতে পারে।
রাজা শেষকৃত্য করতে চলে যাওয়ার পর অনিমা ধীর পায়ে বাড়ি চলে যায়।
অনিমার বাবা নেই। মা সাবিত্রী দেবী মুড়ি ভেজে বিক্রি করে খুব কষ্টে সংসার চালান।
অনিমার চোখ মুখের অবস্থা দেখে সাবিত্রী দেবী বুঝতে পারেন রাজার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়। তাই নিজের মেয়েকে বোঝাতে থাকেন যে আমরা গরীব। কোন রকম কলঙ্কের দাগ লাগলে আর কোন ছেলে বিয়ে করতে চাইবে না। ওদের বাড়ি যাওয়া ছেড়ে দেওয়ায় ভালো হবে।
অনামিকাদেবীর শ্রাদ্ধ শান্তির কয়েকদিন পরেই রাজা ও
অনিমার মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়।
রাজার রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছে। অনিমা মোটামুটি পাশ করেছে।
যে স্কুলে পড়তো সেখানেই রাজা বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছে।
অনিমার মা স্পষ্ট বলেছে আর পড়াতে পারবে না। বরং অনিমা মুড়ির ব্যবসায় সাহায্য করলে কিছু টাকা পয়সা জমিয়ে এক দুই বছরের মধ্যে বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারবে।
অনিমা কয়েকদিন বাড়িতে না আসায় কালীপদবাবু রাজার কাছে কারণ জানতে চান।
রাজা বলে ওর মা পড়াতে পারবে না বলেছে। তাই অনিমা স্কুলে ভর্তি হয়নি। ঘরের বাইরেও আসে না।
কালীপদ বাবু সেই দিনই অনিমা দের বাড়ি যায়। আর সাবিত্রী দেবীকে বলেন অনিমা আমার মেয়ের মতো। ওর পড়াশোনার যাবতীয় দায়িত্ব আমার।কালকে ওকে স্কুলে ভর্তি করতে চাই।
সাবিত্রী দেবী বলেন আমরা গরীব। পড়াশোনা করে কি হবে? বেশি পড়াশোনা করলে বিয়ে দেওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।
দেখুন অনামিকা বেঁচে থাকতেই আমরা অনিমাকে নিজেদের মেয়ের মতো ভালোবাসতাম। তাই ওর বিয়ের যাবতীয় দায়িত্ব আমি নিলাম। আপনি চিন্তা করবেন না।
কালীপদবাবু তার পরের দিন অনিমাকে রাজা যে স্কুলে ভর্তি হয়েছে সেখানে ভর্তি করে দেন। সব বইপত্র কিনে দেন। টিউশন ঠিক করে টিচার বলে দেন ফিজ আমি যথাসময়ে পাঠিয়ে দেবো।
পাঁচ ছয় বছর ধরে নিজের কন্যার মতো অনিমার দেখভাল করেছেন কালীপদবাবু। এই বছর অনিমা বি এ পরীক্ষা দিয়েছে।
রাজা বি এস সি পাশ করে একটা সরকারী অফিসে চাকরি করে। শনি ও রবিবার বাড়িতে আসে।
বছর খানেক হল অনিমাও বি এ পাশ করেছে। চাকরির জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা দিচ্ছে।
সাবিত্রী দেবী মেয়ের বিয়ের জন্য ছেলে দেখা শুরু করেছে।
খবর পেয়ে কালীপদবাবু অনিমাদের বাড়ি গিয়ে সাবিত্রী দেবীকে রাজার সঙ্গে অনিমার বিয়ের প্রস্তাব দেন।
কালীপদ বাবুর কথা শুনে সাবিত্রী দেবী আনন্দে কেঁদে ফেলেন। রাজার মতো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া তো আমাদের ভাগ্যের ব্যাপার।
আমি আর দেরি করতে চাই না। বুঝতেই পারছেন আমার শরীরের অবস্থা খুব খারাপ। যে কোনদিন যে কোন কিছু হয়ে যেতে পারে।
আগামী ফাল্গুন মাসে ওদের বিয়ে দিতে চান কালীপদ বাবু। সেই মতো সাবিত্রী দেবীর সঙ্গে কথা বলে বিয়ের একটা দিন ঠিক করে নেওয়া হলো।
হাতে মাস ছয়েক সময় আছে তাই গুছিয়ে বাজার পত্র করবে বলে কালীপদবাবু চিন্তা ভাবনা করেন।
কালীপদবাবু অনিমাকে সঙ্গে নিয়ে দুই বাড়ির যাবতীয় প্রয়োজনীয় বাজার সেরে নিয়েছেন।
অনিমা একদিকে হবু বৌমা,অন্যদিকে কন্যা রূপে কালীপদবাবুর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বিয়ের সমস্ত ব্যবস্থা করছে।
বিয়ের আর মাত্র মাস খানেক বাকী আছে। মাঘ মাসে এই কদিন খুব শীত পড়েছে। গ্রামের অনেক বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা মারা যাচ্ছে। একদিন রাতে হঠাৎ সাবিত্রী দেবী মারা গেলেন।
মেয়েটা অনাথ হয়ে গেল। কিভাবে একটা বছর পার করা যাবে? একবছর না পার হলে বিয়ে দেওয়া যাবে না। মেয়েটা রাত্রে কিভাবে বাড়িতে একা থাকবে?
অনেক চিন্তা ভাবনা করে কালীপদবাবু একজন বৃদ্ধাকে এক বছরের জন্য রাত্রে অনিমাদের বাড়িতে শোয়ার জন্য রেখে দিলেন।
অফিস থেকে সময় পেলেই কালীপদবাবু ফোনে অনিমার খোঁজ নেন। সন্ধ্যায় বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসেন।রাজাও প্রত্যেক দিন ফোনে খোঁজ নেয়।
শনি ও রবিবার অনিমা সকাল থেকে রাজাদের বাড়িতে আসে। খাওয়া দাওয়া করে রাতে বাড়ি যায়।
এইভাবে এক বছর কেটে গেল। ফাগুন মাস এসে গেল। আজ রাজাদের বাড়ি ঢোকার মুখে সুদৃশ্য গেটে লেখা জ্বলজ্বল করছে," রাজা ওয়েডস অনিমা"।
দুই যুগ ধরে দুটি হৃদয়ে ধরে থাকা ভালোবাসার দুটি কুঁড়ি আজ গোধূলি লগ্নে ফুল হয়ে ফুটে উঠবে।
অনিমাদের উঠোনের পলাশ গাছটা এক শরীর লাল ফুলে সেজে প্রধান পুরোহিত হয়ে বিয়ের কাজ সারতে প্রস্তুত হয়ে আছে।