Nikhil Mitra Thakur

Classics

4  

Nikhil Mitra Thakur

Classics

নন্দলাল

নন্দলাল

5 mins
28


ঝালকাঠি একটি পাহাড়ি শহর। সারাবছর এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে। হোটেল ও খাবার দোকান আছে প্রচুর। তবে পৌরসভার কর্মী ও নাগরিক দের যৌথ প্রচেষ্টায় শহরের রাস্তা ঘাট সব সময় স্বচ্ছ ও পরিস্কার থাকে।

নন্দলাল পৌরসভার একজন সাফাই কর্মী। ওর কাজ ভোর বেলা পৌরসভার কিছু নির্দিষ্ট রাস্তা ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করা। ও সারাদিন এখান ওখান ঘুরে বেড়িয়ে রাতে আকন্ঠ মদ গিলে বাড়ি ফিরে আসে। নন্দলাল ঘরে ফিরছে টের পেলেই মেয়েগুলো ভয়ে সিটিয়ে শুয়ে থাকে। আর বৌ এর কপালে মারধোর ও গালিগালাজ নিত্য দিনের রেশন বরাদ্দ।

নন্দলালের বৌ নমিতা বেশ সংসারী। নমিতা সকাল ও সন্ধ্যে তিন চারটে বাড়িতে কাজ করে। ফিরে এসে বাড়িতে রান্না করে মেয়েদের খাওয়ায়। এর মাঝে সময় পেলে কাগজের ঠোঙ্গা বাঁধে। খুব কষ্ট করে মেয়েদের মুখে দুবেলা দুমুঠো ভাত তুলে দেয়। কাজের বাড়ি থেকে ছেঁড়া জামা কাপড় যা পায় সেগুলো সেলাই করে মেয়ে দেরকে পরতে দেয়। তবে এখন ওর ভয় হয়। মেয়েগুলো বড়ো হচ্ছে। বস্তির ছেলেরা কেমন যেন চোখ করে ফিরে ফিরে তাকায় ওদের দিকে।

নন্দলালের মতো অতটা সকালে না হলেও সূর্য ওঠার আগেই নন্দলালের বৌ কেও ঘর থেকে বের হতে হয়। বড় দুটো মেয়ে সামনে একটা অবৈতনিক স্কুলে পড়ে। একটা পাঁচ ক্লাসে ,আর একটা তিন ক্লাসে পড়ে। গত বছর মাস্টার মশাই ঘরে এসে বলেছিল স্কুলে গেলে দুপুরে খেতে পাবে, জামাকাপড় ও জুতো পাবে। নমিতা দেখে একবেলা অন্ততঃ দুজনের চাল বাঁচবে। তাই মাস্টার মশাইয়ের সঙ্গেই সেদিন থেকে স্কুলে পাঠিয়ে দেয়।

মিড-ডে-মিলের জন্যই মূলত মেয়ে গুলো কে স্কুলে পাঠায় নমিতা। এর পরেও মেয়েরা পড়াশোনা করছে ভেবে নমিতা ভিতরে ভিতরে একটা আনন্দ উপভোগ করে। অন্ততঃ মেয়েগুলো ওর মতো অশিক্ষিত হবে না। মাতালের সাথে বিয়ে হবে না। স্বপ দেখে মেয়েগুলো একদিন পড়াশোনা করে চাকরি করবে ,ওদের পাকা বাড়ি হবে।

কুয়াশা ঢাকা শীতের এক ভোরবেলা। নন্দলাল রাস্তা ঝাঁট দিয়ে জড় করে রাখা আবর্জনা রাস্তার ধারে রাখা ডাস্টবিনে ফেলতে গিয়ে দেখে ভিতরে নিথর একটা সদ্যজাত বাচ্চা পড়ে আছে। আবর্জনা ঢাকা পড়ে গেলে ভিতরে পঁচে গন্ধ ছাড়বে। এলাকায় দূষণ ঘটাবে। তাই বাচ্চা টার প্রতিকার করা দরকার।

নন্দলাল বাচ্চাটা হাতে নিয়ে দেখে বাচ্চা টার বুকের কাছটা ওঠানামা করছে,মানে ও বেঁচে আছে। তৎক্ষণাৎ ছুটে ঘরে নিয়ে যায়। ঘরে তখন শুধু ছোট দুটো মেয়ে আছে। নমিতা কাজের ঘরে। নন্দলাল মেয়েদের বলে শীঘ্রই মাকে ডেকে নিয়ে আয়। বাচ্চাটাকে পরিস্কার করতে হবে ,খাবার খাওয়াতে হবে।

অসময়ে পতি দেবতার গৃহে আগমনের খবরে একদিকে ভয়ে নমিতার বুকে ভূমিকম্প হওয়ার উপক্রম, আবার অন্যদিকে বহুদিন পর পতি দেবতাকে দিনের আলোয় দেখতে পাওয়ার আনন্দে দিশেহারা।

খবর পেয়ে সে তড়িঘড়ি বাড়ি এসে হাজির। "ওমা এ তো রাজপুত্র গো, কোথায় পেলে? যেমন রঙ তেমন মিষ্টি মুখ।"

আগে ওকে পরিস্কার করো গায়ে কতো নোংরা লেগে আছে দেখো।

নমিতা গরম জলে হলুদ ফেলে গায়ের যতো নোংরা পরিস্কার করতে থাকে। আসলে জন্মের পরেই কেউ ফেলে দিয়ে গেছে। বাচ্চা জন্মানোর সময় জেলির মতো গায়ে যা লেগে থাকে তার সঙ্গে ডাস্টবিনের নোংরা চিটিয়ে গেছে। তবে খুব বেশিক্ষণ হয়নি বলে কোন রকম সংক্রমণ হয়নি।

শীতের সকাল তাই পরিস্কার করার পরে নিজের কাপড় মুরে নমিতা বাচ্চা কে নিয়ে ধিকিধিকি আঁচে চুলোর পাশে বাচ্চা টা নিয়ে বসে।

কিন্তু, এই টুকু বাচ্চাকে কি খাওয়াবে ? কি ই বা পরতে দেবে? কিছুই তো নেই ওদের। তাই নন্দলাল ওকে পুলিশ থানায় জমা দেওয়ার কথা বলে।

নমিতা বলে, আমার এতোগুলো মেয়ে কে তুমি কি খেতে দিয়েছো শুনি? তাদের যখন বাঁচাতে পেরেছি একেও পারবো। আমি কোনমতেই পুলিশ থানায় জমা দিতে দেবো না।

নন্দলালের বহুদিনের সখ ছিল ছেলে নেওয়ার। আর ছেলে ছেলে করে হয়েছে চার চারটি মেয়ে। ভগবান যেন এতদিনে ওর ডাক শুনেছেন। আর ঘরে এই ছেলে কে পাঠিয়েছেন। তাই ওর ও ইচ্ছা নেই বাচ্চা ফেরত দেওয়ার।

কিন্তু গিন্নি, ভয় লাগে এই নিয়ে যদি কোন গোলমাল বাঁধে!

গোলমাল বাঁধে মানে? এত সুন্দর একটা বাচ্চা কেউ ওই নোংরায় ফেলে দিয়ে যেতে পারে,আর আমরা কুড়িয়ে এনে মানুষ করলে দোষ!

তবে গিন্নি কি খাওয়াবে ওকে?

আজ থেকে ছুটি আর বুকের দুধ পাবে না। ওই দুধ রাজপুত্র খাবে।

আসলে, নমিতার ছোট মেয়ের বয়স দুবছর। ও এখনও পর্যন্ত বুকের দুধ খেয়ে বেঁচে আছে।

নন্দলাল আনন্দে আটখানা। তবে গিন্নি শীতের পোশাক কি আছে?

যা আছে ছেঁড়া ফাটা তাই আমি সেলাই করে নেবো খন। ও নিয়ে তুমি চিন্তা করো না। বাচ্চাটা খেয়ে একটু ঘুমিয়ে পড়লেমি সেলাই করে নেবো। তুমি শুধু দয়া করে কাউকে ছেলে পাওয়ার কথা বলো না। পাঁচ কান হলে সমস্যা বাড়বে।

নন্দলাল ঘর থেকে বের হয়ে আবার নিজের কাজে চলে গেল। এখনও অনেকখানি রাস্তা ঝাঁট দিতে বাকি আছে ওর। নন্দলালের আজ আর কোন কাজেই মন বসছে না। শুধু ছেলেটার মিষ্টি মুখটা মনে পড়ে।

আসল কারণ লুকিয়ে নানা ফন্দী ফিকির করে নন্দলাল এক বন্ধুর কাছে কিছু টাকা ধার করে। সেই টাকা দিয়ে বাচ্চা টার জন্য বেশ কিছু কাপড় জামা কিনে নিয়ে ঘরে ফিরে আসে সূর্য ডোবার আগে।

নমিতা যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। শেষ কবে সূর্য ডোবার আগে নন্দ ঘরে ফিরে এসেছিল মনে নেই নমিতার। বিয়ের পরে পরে বছর তিনেক হবে ও আসতো আজকের মতো এই সময়ে। দ্বিতীয় মেয়ে হবার পর আর নন্দকে স্বাভাবিক অবস্থায় ঘরে পায়নি নমিতা। মাতাল হয়ে ঘরে ঢুকতো।

নমিতা মনে মনে ভাবে যাক বাবা তুমি শিশু হয়ে এসেছো এই আশীর্বাদ করো আমায়! নন্দ যেন আবার সংসারী হয়।

ঘরে ফিরে নন্দ বেশ কিছুক্ষণ বাচ্চা কোলে নিয়ে থাকে। মেয়েরাও এক এক করে কোলে নিয়ে আদর করতে থাকে।

এইভাবে রাত্রি গভীর হয়। সকলে শুয়ে পরে। ঘুম থেকে উঠে দেখে এক নতুন সকাল।

মদ খাওয়া ছেড়ে না দিলেও আর আগের মতো সারাদিন খায় না। মদ খেয়ে ঘরে ঢোকে না নন্দ।

দেখতে দেখতে এইভাবে কয়েকটা বছর কেটে গেল। চার মেয়ে ও এক ছেলে কে নিয়ে নন্দর সংসার বেশ বড়। তাই এই সংসার চালাতে নন্দ কে হিমশিম খেতে হয়। ঝাড়ুদারের কাজের সাথে সাথে অন্য আরও কাজ করতে থাকে নন্দ। সংসার ও তাই একটু একটু করে সচল হতে থাকে।

এমনই শীতের সকালে নন্দ যখন রাস্তা ঝাঁট দিচ্ছে তখন একটা গাড়ি এসে ওকে ধাক্কা মেরে ছিটকে ফেলে দিয়ে চলে যায়।

আসলে বড়লোক বাড়ির বখে যাওয়া কয়েকটা ছেলে সারারাত পার্টিতে নাচগান করে ভোররাতে নিজেদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় ভারসাম্য হারিয়ে ধাক্কা মারে নন্দলালকে।

সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করতে পারলে নন্দলাল হয়তো বেঁচে যেতো। শীতের ওই ভোরে রাস্তায় কোন

মানুষ ছিল না। আর বয়সের ভারে নন্দও বেশিক্ষণ যুঝে উঠতে পারেনি। প্রাণবায়ু নন্দ কে ছেড়ে চলে যায়।

প্রাতভ্রমণে বের হয়ে মানুষ জন যখন নন্দলাল কে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তখন সে

মারা গিয়েছিল।

তবু তারা লোকজন ডেকে,গাড়ি জোগাড় করে নন্দলাল কে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে ডাক্তারবাবুরা পরীক্ষা করে বলেন অনেকক্ষণ আগেই নন্দলাল রোগ মারা গেছে।

হাসপাতালে পুলিশ কেস হয়। পৌরসভা খুললে পৌরসভার হাতে শব দেহ তুলে দেওয়া হয়।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics