বিসর্জন
বিসর্জন
বিসর্জন
৯/১/২৪
নিখিল মিত্র ঠাকুর
রাজার সাহচর্য পেয়ে অনিমা ইদানিং বেশ পড়াশোনায় মন দিয়েছে।
ওর মা অন্যের বাড়িতে কাজ করলেও মেয়েকে সকাল সন্ধ্যে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে দেখে ভীষণ খুশি ও আনন্দিত।
অনিমার বাবা অবশ্যই খুশি হয় নি। উল্টে অনিমার হালফিল আচরণে বেশ ক্ষিপ্ত। কি হয়েছে ঠিক জানে না তবে বাপি এখন ওকে মদ খাওয়ানো বন্ধ করে দিয়েছে। আর তাতেই মেয়ের প্রতি বেজায় ক্ষেপে আছে। রাত্রিতে বাড়ি ঢুকে বৌয়ের পরিবর্তে মেয়েকে এক প্রস্থ গালিগালাজ করে তবেই ঘুম আসে।
অনিমা এখন আর সেভাবে বাপির ডাকে সারা দেয় না। স্কুল থেকে ফিরে রাস্তার মোড়ে পার্কে বাপির কাছে গল্প করতে যায় না। এতে করে বন্ধু মহলে বাপি কে বেশ টিজিং শুনতে হয়।
বাপি ভিতরে ভিতরে রাজার প্রতি প্রতিশোধ নিতে ক্ষেপে ওঠে। কিন্তু রাজা যেহেতু ছাত্র তাই বশের নিষেধে ওকে কিছু করতে পারে না। রাজাকে কিছু করলে সমাজে বড় এফেক্ট পড়বে। ওদের চোরা চালান কারবারে অসুবিধা হবে।
রাজা আর ঠিক থাকতে না পেরে একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় সব ছেলে মেয়ের সামনে বাপির সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ে।
রাজা চোখে চোখ রেখে বাপির সাথে তর্ক করতে থাকে। সেদিন থেকে বস্তির ছেলে মেয়েদের রাজার প্রতি ভয় ভেঙে যায়।
ঘটনার কথা বাপির বশের কানে যায়। বশ বাপিকে ডেকে আবার সাবধান করে দেয়।
সবাই দেখেছে বাপি মুখে তর্জন গর্জন করলেও দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও রাজার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস দেখাতে পারে নি।
অনিমা আরো বেপরোয়া হয়ে রাজার সাথে মেলামেশা করতে থাকে। ওরা একসাথে স্কুলে যায় ,আবার একসাথে আসে।
দেখতে দেখতে দুবছর কেটে যায়। রাজা বেশ ভালো রেজাল্ট করে নবম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণিতে উঠে গেছে।
এবার রাজা মাধ্যমিক ফাইনাল পরীক্ষা দেবে। তাই পড়াশোনা একটু বেশি করতে হচ্ছে। বাড়ি থেকে খুব বেশি বের হতে পারে না। অনিমার সাথে দেখা হয় না সবদিন।
এদিকে বশ বারবার সাবধান করার পরেও বাপি রাজার প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ক্ষেপে ওঠে। রাজা ও অনিমার সাথে পেরে না উঠে ওর এখন নজর পড়ে রাজার বড় দিদি কবিতার উপর।
কবিতার গায়ের রঙ কালো হলেও ও বেশ স্বাস্থ্যবতী।সুঠাম চেহারা। ২২-২৩ বছরের পূর্ণ যৌবনা এক নারী। প্রথম দেখাতেই যে কোন পুরুষের কামনার পাত্রী হয়ে উঠা স্বাভাবিক।
বস্তির বিবাহিত,অবিবাহিত অনেক পুরুষের এখন কামনার বিষয় কবিতা।
কবিতা যখন সকাল বেলায় অন্যের বাড়িতে কাজে যায় তখন ওকে একপলক দেখার জন্য অনেকে রাস্তায় অপেক্ষা করে।
রাজার মা ওর বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। কিন্তু গরীব ঘরের মেয়ের কি এত সহজে বিয়ে হয়?
সকাল বেলায় কাজে যাওয়ার সময় রাস্তা আটকে বাপি ভালোবাসার প্রস্তাব দেয় অনিমা কে।
বাপি সমন্ধে কবিতার ধারণা ভালো ছিল না। উপরন্তু রাজার সাথে ঝামেলার ব্যাপারটা কবিতা জানতো। তাই বেশ রূঢ়ভাবে বাপিকে প্রত্যাখান করে।
বাপির মধ্যে তখন প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে। তাই এমন কিছু কথা বলে কবিতা কে ভয় দেখায় যে কবিতা কয়েকদিন পরে বাপির সাথে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়।
বেশ কিছুদিন লুকিয়ে চুরিয়ে বাপি ও কবিতার সম্পর্ক চলতে থাকে।
কবিতা প্রথম থেকেই বিয়ের জন্য জোর দেয়। ওর ইচ্ছা ছিল বিয়ে করে বাপিকে ভালো পথে ফিরিয়ে নিয়ে আসা।
কেননা কবিতা ছোট থেকেই বস্তিতে বাপি দের মতো ছেলেদের মতলব দেখে আসছে। এরা নেশাভাঙ করে, বস্তির উঠতি মেয়ে গুলোকে নিয়ে বেশ কিছু দিন ফূর্তি করে। তারপর,হয় কোন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং শবদেহ হয়ে বেরিয়ে আসে। না হয় কোন গন্ডোগলে জড়িয়ে বোমার আঘাতে মারা যায়। অথবা পুলিশের ভয়ে ফেরার হয়ে অন্য কোথাও চলে যায় এবং সেখানেই অন্য মেয়েকে বিয়ে করে ঘর সংসার করতে থাক
ে।
আর এইসব কোন না কোন কারণে বস্তির মেয়েদের কপাল পোড়ে। তাই বস্তির বহু মেয়ে কে যেমন আত্মহত্যা করতে হয়েছে তেমনি বহু মেয়েকে খুন হতে হয়েছে।
আর অন্য দিকে বাপি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কবিতা কে ভোগ করে ছেড়ে দেওয়ার জন্য ভালোবাসার অভিনয় করতে থাকে।
রাজার তখন মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। বাড়ির সকলের দৃষ্টি সেই দিকে। রাজাও এক চিলতে কুঁড়ে ঘরের বাইরে যায় না সারাদিন।
নমিতা কাজের বাড়ি থেকে বেশ কয়েকটা দিন ছুটি নিয়েছে। সময়ে দুটো গরম ভাত ছেলের মুখে তুলে দেওয়ার জন্য। আর এসব কাজের মধ্যে ডুব দিয়ে নমিতা তখন প্রায় স্বর্গ্যোদ্যানে পৌঁছে গেছে।
বাপি কয়েকজন বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে দূরে পাহাড়ের কোলে একটা নির্জন গ্রামে কবিতা কে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে রেখেছিল।
সুযোগ বুঝে বাপি কবিতাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ওরা পালিয়ে পাহাড়ের কোলে নির্জন ঝুলুং গ্রামে ঘর বাঁধবে বলে জানায়।
কবিতা জানতো ওর মা এবং রাজা এই বিয়ে মানবে না। ওদের অমতে এখানে থেকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। তাই বাপির সাথে এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব কবিতা লুফে নেয়।
রাজার পরীক্ষার শেষ দিনে কবিতা বাপির সাথে পালিয়ে যায়।
রাজা শেষ পরীক্ষা দিয়ে এসে জানতে পারে কবিতা দুপুরে ঘরে ফিরেনি। রাতেও না ফিরে আসায় পরের দিন থানায় নিখোঁজ ডায়েরি করা হয়।
কবিতা ঝুলুং পৌঁছে বুঝতে পারে বাপির অভিসন্ধি খুব খারাপ। ওখানে আগে থেকে বাপির বেশ কিছু বন্ধু এসে হাজির হয়ে আছে। ওরা আগে এসে এখানে জাল বিছিয়ে রেখেছিল। কবিতা এখন শুধু ওই জালে ফেঁসে গেছে।
এখন আর ওর কিছু করার নেই বললেই হয়। এই দুর্গম পাহাড়ি এলাকা থেকে ওর পক্ষে এতগুলো ছেলের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালিয়ে যাওয়া কোন ভাবেই সম্ভব নয়। খুব কপাল ভালো হলে বা অতি আশ্চর্য কিছু ঘটলে এখান থেকে উদ্ধার পেতে পারে।
দিনের বেলাতেই যে কোন মানুষের এখানে একা থাকতে ভয় লাগবে। আর সন্দেহভাজন দের সাথে থাকা প্রতিমুহূর্ত আরো দুর্বিসহ।
যাইহোক সন্ধ্যা নামতেই বাপি দের চাল চলন, ভাবভঙ্গি থেকে কবিতা বুঝতে পারে এদের হাত থেকে আর ওর রক্ষে নেই। তবু ওদের বুঝতে দিতে চায় না কবিতা। ওরা বুঝে গেলে ওর বাঁচার কোন পথই থাকবে না। তাই মনে মনে নিজেকে প্রটেক্ট করার নানা কৌশল চিন্তা করতে থাকে। রাত টুকু কাটাতে পারলে সকালে হয়তো কোন ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
জানলা বিহীন একটা ছোট ঘর,তার একটাই দরজা। তাই পালাতে হলে দরজা দিয়ে পালাতে হবে। পালিয়ে রাতের অন্ধকারে পাহাড়ের জঙ্গলে গা ঢাকা দিতে পারলে হয়তো প্রাণে বাঁচা যেতে পারে।
এইসব চিন্তা করতে করতে কবিতা দেখে বাপি দের সাথে দুজন পাহাড়ি সন্ডা মার্কা লোক যোগ দিয়েছে। সবাই মিলে মদ আর মাংস খাচ্ছে। কবিতা কে যে খাবার দিতে হবে সেসব চিন্তা ওদের মাথায় নেই।
একটু রাত হতেই কবিতা দেখে ছয়টা নরখাদক ঘরের দিকে আসছে। কবিতার শরীরের সব রক্ত এক লহমায় জল হয়ে আসে। তবু সে দরজা আটকে রাখে। সেই প্রতিরোধ কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেঙে পড়ে। ঘরের দরজা ভেঙে ওরা ঢুকে পড়ে।
কবিতা ওদের ছাড়িয়ে ছুটে বাইরে জঙ্গলে পালাবার চেষ্টা করে। কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তির পর সকলেই অল্প বিস্তর আহত হয়। কবিতা জঙ্গলে কিছুদূর গিয়ে ধরা পড়ে। ওরা টেনে হিঁচড়ে কবিতা কে ঘরে নিয়ে আসে।
ঘরের মধ্যে রাখা খাটে কবিতার রক্তাক্ত অর্ধচেতন দেহ শুয়ে দেয় ওরা। লোভের রসে সিক্ত জুলু জুলু চোখে ওরা কবিতার দেহ দেখতে থাকে। এরপর সবকটা নরখাদক আদিম উল্লাসে ঝাঁপিয়ে পরে কবিতার উপর। ওরা কবিতার দেহ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খায়।
এক সময় কবিতা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কবিতার অচেতন নগ্ন দেহ ওরা রাতের অন্ধকারে পাহাড়ি খরস্রোতা নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়।
ইহ জীবনে হাজার কবিতার মতোই আজ রাতে আর এক কবিতার বিসর্জন ঘটে গেল।