STORYMIRROR

Nikhil Mitra Thakur

Crime

3  

Nikhil Mitra Thakur

Crime

অভয়া

অভয়া

5 mins
246

প্রাথমিক স্কুলে আমার ছেলে সেকেন্ড হতো,আর অভয়া নামের মেয়েটি ফার্স্ট হতো। ওকে ক-বিভাগ করা হয়েছে অথচ আমার ছেলে অনুভব কে খ-বিভাগ করে দেওয়া হলো। 

প্রধান শিক্ষক বলেন অনুভব সেকেন্ড হলেও যে মেয়েটি ফার্স্ট হয়েছে তার সঙ্গে নম্বরের ফারাক অনেক বেশি। তাই ওকে খ-বিভাগ করতে হয়েছে। 

এত ছেলে মেয়ের মাঝে প্রথম বৎসর অভয়া একটু ঘাবড়ে যায়। ক-বিভাগে ফার্স্ট পজিশন ধরে রাখতে পারে না,থার্ড হয়ে পড়ে। আর তিনটে বিভাগ মিলে অনেকখানি পিছিয়ে সপ্তম হয়ে পড়ে। রেজাল্ট বের হওয়ার দিন বাড়ি ফিরে কান্না কাটি শুরু করে।

বস্তুত, হাইস্কুলে ওদের ক্লাসের প্রায় সব ছেলে মেয়ের দুটো তিনটে করে গৃহশিক্ষক আছে। 

আর, অভয়া এখন একজন শিক্ষক কাছে টিউশন পড়তে যায়। উনি সব বিষয় একাই পড়িয়ে দেন। মাসিক ফিজও বেশ কম। মূলত, গরীব ঘরের ছেলে মেয়েরা উনার কাছে পড়তে যায়।

অভয়া বোঝে ওর বাবার পক্ষে অন্যদের মতো দুটো তিনটে গৃহশিক্ষক রাখা সম্ভব নয়। তাই রেজাল্ট খারাপ হওয়ার পর থেকেই অভয়া মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যেমন করেই হোক পরিশ্রম করে আগামী বৎসর থেকে ওকে ফার্স্ট পজিশন উদ্ধার করতে হবে।

অনুভব এই বৎসর বেশ ভালো রেজাল্ট করেছে। তাই ওর নাম উঠেছে ক-বিভাগে। অনুভবের বাবা মা বেশ খুশি। 

নিজের রেজাল্ট খারাপ হলেও অনুভবের রেজাল্ট ভালো হয়েছে। তাই অভয়া বেশ খুশি হয়েছে। আবার ওরা এক ঘরে বসে ক্লাস করতে পারবে। 

এখন অভয়া ও অনুভব এক ঘরে বসে ক্লাস করে। যদিও আলাদা আলাদা দিকে বসতে হয়। তবে স্কুলের কোনো পড়া আটকে গেলে দুজনে আলোচনা করে নেয়। আর পড়াশোনার ব্যাপারে কোনো সমস্যা দেখা দিলে সমাধান করতে ওরা একে অপরকে সাহায্য করে। 

অনুভব এখন অনেকগুলো গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে। তাই গৃহশিক্ষক দের পড়ানো খাতা পত্র অভয়া কে দিয়ে সাহায্য করে।

সপ্তম শ্রেণীতে ওঠার পরীক্ষায় অভয়া আবার নিজের ফার্স্ট পজিশন উদ্ধার করে নেয়। বস্তুত,কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনার মাধ্যমে নিজের পজিশন ছিনিয়ে নিয়ে আসে।

যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা না পেলেও অভয়া প্রথম থেকে স্কুলে নিজের ক্লাসে যেমন প্রথম স্থান অধিকার করতো এখনও তেমনি একের পর এক ক্লাসে প্রথম স্থান অধিকার করতে শুরু করে।  

দেখতে দেখতে অভয়া ও অনুভব অনেকখানি বড় হয়ে যায়। এখন ওদের সম্পর্ক যে নিছক বন্ধুত্বকে ছাপিয়ে গেছে সেটা ওরা দুজনে বুঝতে পারে,অনুভব করতে পারে। কিন্তু,কেউ কাউকে কিছু বলতে পারে না, প্রকাশ করতে পারে না। 

এখন ওরা প্রতিদিন দুজনে টিফিন ভাগ করে খায়। একদিন কেউ কোনো কারণ বশত স্কুলে না এলে অন্যজন তার অভাব বোধ করে।

এইভাবে দেখতে দেখতে কিভাবে ও কেমন করে যেন চার চারটে বৎসর কেটে গেল।এখন অভয়া ও অনুভব দশম শ্রেণিতে পড়ে। এই বৎসর ওরা দুজনে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে।

ফাস্ট গার্ল তাই স্কুলের দিদিমনি ও স্যারদের প্রত্যেকে যেমন অভয়া কে ভালোবাসে তেমনি ওর উপর আশা আকাঙ্খা অনেক বেশি।

ব্লকের মধ্যে এই স্কুলটির যথেষ্ট সুনাম আছে। কিন্তু,বেশ কয়েক বৎসর মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক কোনো পরীক্ষা তেই ব্লকের মধ্যে ফার্স্ট পজিশন অধিকার এই স্কুল থেকে কোনো ছাত্র বা ছাত্রী করতে পারেনি। এই ব্যাপারে স্কুলের সব শিক্ষক,শিক্ষিকা ও স্কুল কর্তৃপক্ষ বেশ চাপে আছে। তাই অভয়া কে ঘিরে সকলের আশা এবার এই স্কুল অবশ্যই ফার্স্ট পজিশন ছিনিয়ে নিতে পারবে।

শিক্ষক ও শিক্ষিকাগণ প্রায়ই সেই কথা অভয়াকে মনে পড়িয়ে দেন এবং উৎসাহিত করেন ব্লকের মধ্যে ভালো ফল করার জন্য। 

বাৎসরিক ক্রিয়া প্রতিযোগিতার দিন স্কুলের প্রধান শিক্ষক অভয়াকে কাছে পেয়ে সামনে মাধ্যমিক পরীক্ষা আছে সেকথা মনে পড়িয়ে দিয়ে সাবধানে খেলাধুলা করতে বলেন,আর এটাও মনে করিয়ে দেন যে অভয়াকে ঘিরে উনাদের প্রত্যাশা কতটা।

এবার স্কুলের বাৎসরিক ক্রিয়া প্রতিযোগিতায় বেশ কয়েকটি পুরস্কার অভয়া পেয়েছে। পুরস্কার নিতে উঠলে স্কুলের সভাপতি আসন্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় অভয়ার সাফল্য কামনা করে একটা পজিশন ছিনিয়ে আনতে বলেন।

অভয়ার বাবা এবং মায়ের ওর প্রতি এক সলজ্জ উচ্চ আকাঙ্খা রয়েছে। মেয়ে কে উপযুক্ত সুযোগ সুবিধা দিতে না পারার অন্তর কুন্ঠায় তারা নিজেদের কাছে নিজেরা সেই উচ্চ আকাঙ্খা স্বীকার করেও স্বীকার করতে পারেন না।

ফেব্রুয়ারি মাসে সরস্বতী পূজার আগে থেকে এই বৎসর বেশ গরম পড়েছে। রোজ সকাল হতে না হতেই অভয়া দের বাড়ির অ্যাসবেসটস ছাদ বেয়ে লঙ্কার রাক্ষুসে গরম নেমে আসছে মেঝেতে। সিলিং ফ্যান চালানো যাচ্ছে না।ফ্যানের হাওয়ায় গরম যেন গাজনের আনন্দে আরো লাফিয়ে লাফিয়ে নীচে নেমে আসছে। এই গরমে ঘরের মধ্যে কোনো মানুষের থাকাই দুস্কর হয়ে পড়েছে। আর পড়াশোনা করা তো দূর অস্ত। 

এই দুঃসহ গরমের মধ্যেও অভয়া জেদ করে পড়াশোনা করে যাচ্ছে। তাই ওর শরীর স্বাস্থ্য একটু ভেঙে পড়েছে এই কয়েক দিনের মধ্যে। কি হচ্ছে,আর কি হচ্ছে না সেদিকে ওর কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। ওর মনে এখন শুধুই পড়া আর পড়া।

মেয়েটার কষ্ট অনিমা দেবী ও মৃণ্ময়বাবু আর চোখ চেয়ে দেখতে পারছেন না। কিন্তু, এক্ষেত্রে ওদের কি বা করার আছে? নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে মেয়ে দের কঠোর পরিশ্রম করে পড়াশোনার মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় নেই। 

ওদের বাড়িতে অভাবের মধ্যেও বরাবর দেবী সরস্বতীর মূর্তি আসে এবং পূজা হয়। অভয়া যখন খুব ছোট্ট প্রাথমিক স্কুলে সবে ভর্তি হয়েছে তখন থেকে অভয়া যাতে ভালোভাবে পড়াশোনা করতে পারে ও প্রতি বৎসর যাতে ওর রেজাল্ট ভালো হয় সেই মনস্কামনা নিয়ে অনিমা দেবী পূজো শুরু করেছিলেন। 

অভয়া হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে সরস্বতী পুজো আয়োজনের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেয়। দেব দ্বিজে মেয়ের ভক্তি ও আগ্রহ দেখে অনিমা দেবী ভীষণ খুশি হন। সানন্দে সব দায়িত্ব মেয়ের উপর ছেড়ে দিয়ে আড়াল থেকে লক্ষ রাখতেন। সেই থেকে অভয়া নিজে পূজোর সব আয়োজন করে থাকে। আর এখন ও নিজে পুজো আয়োজনে দক্ষ হয়ে উঠেছে।

জাঁকজমক খুব বেশি করতে না পারলেও ওদের উৎসাহ বা উদ্যমের কোনো ঘাটতি থাকে না। পুজোর রাতে ওই পাড়ার সব ছেলে মেয়েদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খিচুড়ি খাওয়ানো হয়। অনুভব ছোট্ট থেকে ওইদিন রাতে অভয়া দের বাড়িতে অন্য সব ছেলে মেয়েদের সঙ্গে খিচুড়ি খেতে আসে। মেয়ে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আড়ম্বর একটু আধটু বেড়েছে এবং খরচও বেড়েছে। তবুও সেই ধারা আজও ওদের বাড়িতে বজায় আছে।

সরস্বতী পুজো এসে পড়ায় মৃণ্ময়বাবু ও অনিমা দেবী মেয়েকে একটু রিলিফ দেবে বলে মনস্থির করে। আর সেই মতো ওরা অভয়াকে প্রস্তাব দেয়। কিন্তু অভয়া স্পষ্ট বলে দেয় সরস্বতী পুজোর সব আয়োজন ও নিজেই করবে এবং তাতে ওর পড়াশোনার কোনো ব্যাঘাত ঘটবে না। 

অনিমা দেবী ও মৃণ্ময়বাবু ভাবে যাক্ অনন্ত দুটো দিন মেয়েটা বই খাতা থেকে মুখ তুলে একটু আনন্দ করবে। কিন্তু,অভয়া একদিকে সরস্বতী পুজোর আয়োজন করতে থাকে আর অন্যদিকে নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকে। শুধু পুজোর দিন সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত বই খাতা খুলে কোনরকম পড়াশোনা করেনি। কিন্তু,ওকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছিল ফাঁক পেলেই ও মনে মনে পড়া স্মরণ করে যাচ্ছে ।

এই বছর পুজোর একটা বিশেষ দিক হল পুজোর দিন সকাল থেকে অনুভব ওদের বাড়ি এসে অভয়াকে হাতে হাতে সাহায্য করছে। ওদের বন্ধুত্ব দেখে অনিমা দেবী ও মৃণ্ময়বাবুর দুচোখ জুড়িয়ে যায়। ওদের অন্তরে আনন্দের ফল্গুধারা বইতে থাকে।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Crime