কবিতার চিকিৎসা
কবিতার চিকিৎসা


নরখাদক দের অত্যাচার কবিতা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারে নি। অচেতন হয়ে পড়ে। তারপরও কিন্তু ওদের হাত থেকে কবিতার নিস্কৃতি মেলে নি।
অচেতন দেহের উপরেই চলতে থাকে ওদের পাশবিক উল্লাস।
ওদের হুঁশ ফিরলে ওরা ভাবে কবিতা মারা গেছে ওদের অত্যাচারে।
ওরা তখন সকলে মিলে রাতেই কবিতার অসাড় দেহ তুলে নিয়ে গিয়ে খরস্রোতা পাহাড়ি তিস্তার জলে ভাসিয়ে দেয়।
হিম শীতল তিস্তার স্রোতে কবিতার দেহ একটা পাতার মতো ভাসতে ভাসতে নিচের দিকে যেতে থাকে।
নিম্ন সিকিমের একটা গ্রামের কাছে নদীর তীরের দিকে একটা পাথরে কবিতার দেহ আটকে যায়।
গ্রামের এক যুবক সকাল বেলা নদীর দিকে কাজে এলে একটা দেহ পড়ে থাকতে দেখে।
এই গ্রামের মানুষ জনদের এইরকম দেহ পাওয়ার অনেক অভিজ্ঞতা আছে।
তাই ওরা নদীর তীরে আটকে থাকা এইরকম দেহ দেখতে পেয়ে কোন রকমভাবে উত্তেজিত হয় না বা খুব বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে না।
গ্রামের কেউ নদীতে ভেসে আসা এইরকম দেহ দেখতে পেলে ঘাবড়ে না গিয়ে অন্যদের খবর দিয়ে ডেকে নিয়ে আসে।
তিস্তার তীরের গ্রাম গুলিতে অনেক রকম দেহ ভেসে আসে।
অনেক ক্ষেত্রে যেমন খুন করে দেহ ভাসিয়ে দেওয়া হয় তেমনি অনেক সময় পাহাড় থেকে পা পিছলে কেউ নদীতে এসে পড়লে তার দেহ ভেসে আসে।
তাই প্রথমে এখানকার মানুষেরা বোঝার চেষ্টা করে মানুষটি বেঁচে আছে কি না।
বেঁচে না থাকলে ওরা পুলিসে খবর দেয়। পুলিশ এসে দেহ তুলে নিয়ে যায়।
আর যদি ওরা বুঝতে পারে মানুষটি বেঁচে আছে তাহলে ওরা পুলিসে খবর না দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। তারপর পুলিশকে বিষয়টি জানায়। কেননা, পুলিশ আসার পর চিকিৎসা শুরু করতে গেলে মানুষটি মারা যাবে।
ওরা বেশিক্ষণ দেরি না করে তাড়াতাড়ি করে কবিতার দেহ জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল বলে তিস্তার হিম শীতল জল কবিতার আঘাত ও ক্ষতের অনেক খানি চিকিৎসা করে শুশ্রূষা করে দিয়েছে।
কবিতা তখনও মারা যায়নি তবে জ্ঞানও ছিল না। গ্রামের
মানুষ ওর বিবস্ত্র দেহ তুলে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় পদ্ধতিতে জ্ঞান ফিরানোর চেষ্টা করতে থাকে।
দেহ তুলে নিয়ে গিয়ে প্রথমেই গরম কাপড়ে মুড়ে দেওয়া হয়। গরম দুধ ও ফলের রস একটু একটু করে খাওয়ানো হয়। প্রায় ঘন্টা দুয়েক এর চেষ্টায় কবিতার জ্ঞান ফিরে আসে।
গ্রামের কয়েকজন যুবক পুলিশে খবর দেওয়ার জন্য যায়,এবং কয়েকজন কবিতাকে স্থানীয় হাসপাতালে
নিয়ে যায়।
হাসপাতালে পুলিশ এসে ওদের নিয়ম মাফিক কাজ শুরু করে । ওই মানুষটির ছবি তুলে খবরের কাগজে দিয়ে যেখানে আছে সেখানকার ঠিকানা দিয়ে দেওয়া হয়। বাড়ির লোক দের যোগাযোগ করতে বলা হয়।
কবিতার ক্ষেত্রেও তার কোন ব্যতিক্রম হল না। পুলিশ কবিতার ছবি তুলে নিয়ে যায় ও সব খবরের কাগজে দেয়। আত্মীয়দের যোগাযোগ করার জন্য খবরের কাগজে ছবির নিচে ঠিকানা দিয়ে দেওয়া হয়।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কেউ কোন যোগাযোগ করে না। তাই কবিতার মতো আরো দুটি মহিলা এখনও ওই গ্রামেই পড়ে রয়েছে। তারা স্থানীয় ছেলেকে বিয়ে করে এখানেই বেশ সুখে সংসার করছে।
তাছাড়া পাশের গ্রাম গুলিতে আরো কিছু এইরকম মহিলা রয়েছে। তাদেরও একই অবস্থা।
এইসব মহিলাদের অনেকে আবার আগেকার কথা স্মরণ করতে চায় না। ওই জীবনে তাদের এতো দুর্বিসহ কষ্ট ভোগ করতে হয়েছে যে তারা তা স্মরণ করতে পারলেও স্মরণ করতে চায় না।
এখানে গায়ে গতরে খেটে দুবেলা দুমুঠো খেয়ে তারা অনেক সুখে আছে।
এইসব পাহাড়ি গ্রাম গুলোতে মহিলাদের স্বাধীনতা অনেক বেশি। ব্যবসা বাণিজ্য থেকে সংসার সব কিছুর দায়িত্ব তারাই সামলায়।
তাই সমতলের ওই কষ্টের মধ্যে থাকা পরাধীন মহিলারা আর আগের জীবনে ফিরে যেতে চায় না।
আজ প্রায় সাতদিন হলো কবিতা হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে। আগেকার কোন কথা যেমন মনে করতে পারছে না তেমনি কোন কথাও বলতে পারে না। শুধু ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।
আর কিছুক্ষণ এইভাবে চেয়ে থাকার পর দুই চোখ বেয়ে জল গড়াতে থাকে।
তবে ওই গ্রামের এক যুবক সেদিন হঠাৎ করে কবিতাকে দেখতে আসায় বড় বিপত্তি দেখা দিয়েছিল। অনেক কষ্টে সেই বিপত্তি সামাল দেওয়া গেছে।
আর সেই থেকে যুবক কোন ডাক্তার বা কোন কর্মচারী দেখলে আর্তনাদ করে উঠছে।
এখানকার ডাক্তারদের এই বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞতা আছে। তাই কবিতাকে চিকিৎসা করতে সচরাচর কোন আর যুবক ডাক্তার যায় না।
তাই এখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে অনেক বেশি সাবধান। কবিতার দিকে কোন পুরুষ এখন যেতে দেওয়া হয় না।
কবিতা যৌনাঙ্গের অভ্যন্তরে যে আঘাত পেয়েছে তা সারতে বেশ কয়েক মাস লেগে যাবে। অবশ্য যদি কবিতা মনের দিক থেকে নিজেকে সারিয়ে তুলতে সচেষ্ট হয় তবেই নইলে এই আঘাত সারতে আরো অনেক বেশি সময় লেগে যেতে পারে।
এখানকার ডাক্তারেরা কবিতার দেহের বিভিন্ন অঙ্গে যে সব আঘাত রয়েছে সেগুলো যেমন সারাবার চেষ্টা করছে তেমনি মনের আঘাত ও ভয় পাওয়াটা সারিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন।
কবিতা এখন অবশ্য ওর হাত ও পা নড়াচড়া করতে পারে তবে হাঁটা চলার মতো শক্তি এখনো ও মনে সঞ্চয় করতে পারে নি।
আজ প্রায় একমাস হলো কবিতা এই হাসপাতালে ভর্তি আছে। এখন ও অনেকখানি সুস্থ।
এখন কবিতা কথা বলতে পারে। আর সামান্য একটু হাঁটা চলা করতে পারে।তবে ওর আগের জীবনের কোন কথা মনে করতে পারছে না।
তাই আরো কিছু দিন হাসপাতালে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় ক
কর্তৃপক্ষ।
ইতিমধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দিক থেকে কবিতাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিল যে যুবক তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।
--ওই যুবক হাসপাতালে এলে বলা হয় আর কিছু দিনের মধ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কবিতাকে ডিসচার্জ করে দিতে চাইছে। কে ওকে নিয়ে যাবে? বন্ডে সই করতে হবে।
-- ডাক্তারবাবু আমি ওকে আমাদের বাড়ি নিয়ে যেতে ইচ্ছুক। কিন্তু, সেদিন ও আমাকে দেখে যেভাবে চিৎকার করে উঠেছিল তাতে করে মনে হয় ও আমাদের বাড়িতে থাকতে পারবে না।
-- না না, সেদিন যেভাবে চিৎকার করে উঠেছিল আজ সেভাবে চিৎকার করবে না, আশা করছি।
-- তবে ডাক্তার বাবু আমি সপ্তাহ দুয়েক পরে ওকে নিতে আসবো । আজকে আমি আসি ডাক্তার বাবু।
-- না না, এতদূর এলে রোগীর সাথে দেখা করে যাবে না তাই হয় না কি। চলুন একবার দেখে আসবেন কতটা সুস্থ হয়েছে কবিতা।
-- তাই চলুন ডাক্তার বাবু। পহান ডাক্তার বাবুর পিছনে পিছনে খুব ভয়ে ভয়ে কবিতার দিকে যেতে থাকে।
-- কবিতা, এই ছেলেটি তোমাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিল। তোমাকে দেখতে অনেক দূর থেকে এসেছে।
-- আজ আর কবিতা চিৎকার করে ওঠেনি। হতে পারে সঙ্গে ডাক্তারবাবু ছিলেন বলে।
-- কবিতা দুইহাত জোড় করে যুবককে প্রণাম করে। ওর দুই চোখে চাহনিতে আজ ফুটে ওঠে অপার এক কৃতজ্ঞতা।
-- পহানও দুই হাত জোড়া করে প্রতি নমস্কার করে।
-- কবিতার কাছ থেকে নিজের চেম্বারে ফিরে এসে ডাক্তার বাবু ওই যুবককে বলেন কবিতার মনে অনুভূতির সঞ্চার হচ্ছে।
-- কিভাবে বুঝলেন ডাক্তার বাবু?
-- তোমাকে কবিতা যখন প্রণাম করলো তখন তোমার দিকে তাকিয়ে ওর চোখ থেকে অশেষ কৃতজ্ঞতা ঝরে পড়ছিল। তাই খুব তাড়াতাড়ি ওকে আমরা হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে পারবো বলে আশা করছি।
-- আরো কতোদিন লাগতে পারে ডাক্তারবাবু?
-- আরো মাস দুয়েক তো লাগবেই।
-- মাস দুয়েক!