STORYMIRROR

Nikhil Mitra Thakur

Crime

3  

Nikhil Mitra Thakur

Crime

অভয়া

অভয়া

5 mins
205


অভয়া

নিখিল মিত্র ঠাকুর 

১৬/৯/২৪


মৃণ্ময় ও অনিমা দেবীর পরিবার একটি নিম্ন মধ্যবিত্ত ছোট্ট সুখী পরিবার। তাদের একমাত্র মেয়ে অভয়া। মেয়ে জন্মানোর পর থেকে তাদের আনন্দের সীমা নেই এবং পরিকল্পনার শেষ নেই। জীবন বৃত্তের কেন্দ্রে ওই একরত্তি মেয়ে। মেয়েকে ঘিরেই ওদের সব চাওয়া পাওয়া,আর যতো আশা আকাঙ্খা। 

ওরা থাকে গ্রামে। তবে ওটা গ্রাম হলেও অজ পাড়া গ্রাম নয়। গ্রামের পাশ দিয়ে পাকা রাস্তা চলে গেছে বিহার পর্যন্ত,অধুনা ঝাড়খণ্ড পর্যন্ত। গ্রামে ঢোকার মুখে রাস্তার ধারে একটা বাসস্ট্যান্ড আছে। লোক ওঠানামা কে কেন্দ্র করে ওখানে বেশ কিছু দোকান গড়ে উঠেছে। গ্রামে একটা বাংলা মাধ্যম কো-এড উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল আছে। গ্রামের সব ছেলে মেয়ে এখানেই পড়াশোনা করে। একটা পোস্ট অফিস আছে। গ্রামীন ব্যাংকের একটা শাখা আছে। একটা ছোট্ট হেলথ সেন্টার আছে।

গ্রামের বাস রাস্তার মোড়ে মৃণ্ময়বাবুর, মানে অভয়ার বাবার আছে একটা ছোট্ট টেলারিং দোকান আছে। মৃণ্ময় বাবু দোকান থেকে যা রোজগার করেন তাতে খেয়ে মেখে সংসার বেশ চলে যায়। মেয়ে বেশ ছোট। এখনও স্কুলে ভর্তি হয়নি। তাই পড়াশোনার জন্য কোনো খরচ হয় না। কিন্তু,মেয়ে কে ভালো ভাবে পড়াশোনা করাবে বলেই ওদের যতো পরিকল্পনা। আসলে অভাব না থাকলেও বিলাসিতা করার মতো টাকা পয়সা ওদের পরিবারের নেই। 

অভয়ার মা,মানে অনিমা দেবী উচ্চ শিক্ষিত না হলেও একেবারে নিরক্ষর নয়। অনিমা দেবী উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে আর পড়াশোনা করেন নি। অনিমা দেবী কোনো চাকরি না করেন না ঠিকই তবে গুছিয়ে সংসারটা করেন। অর্থাৎ অনিমা দেবী হলেন একজন গড়পড়তা গ্রামীন গৃহবধূ। ওই যাকে বলে লক্ষী গৃহবধু । অনিমা দেবী একটা লক্ষী ভাড় নেন,আর সময় সুযোগ মতো কিছু টাকা ওটাতে ফেলে দেন। একটা ভাড় ভরে আবার একটা নিয়ে আসেন। এইভাবে উনার অনেকগুলো ভর্তি লক্ষ্মীর ভাড় আছে, যেগুলো মেয়ের পড়াশোনার জন্য হটাৎ করে লাগতে পারে বলে রাখা।

মৃণ্ময় ও অভয়ার বেশ হাসি খুশি একটা ছোট সংসার। কোনো অশান্তি ঝগড়া মনমালিন্য নেই বললেই হয়। মৃণ্ময় বাবু সারাদিনে দুপুরে একবার খাওয়া দাওয়া করতে বাড়িতে আসেন। আবার রাতে প্রায় নটা বেজে যায় দোকান বন্ধ করে বাড়ি ফিরতে। তাই সংসারের সব দায় দায়িত্ব অনিমা দেবী একা হাতে সামলে থাকেন। মৃণ্ময় বাবু সংসারের ব্যাপারে নাক গলান না বা নাক গলানোর সময় পান না। 

রাতে বাড়ি ফিরে মৃণ্ময়বাবুর সময় কাটে মেয়ের সাথে খেলা করে,গল্প করে। প্রয়োজন পড়লে পড়াশোনায় একটু আধটু সাহায্য করে। এই সময়ে অনিমা দেবী বাড়ির রান্নার কাজ বা আরো অন্যান্য কাজ সেরে নেন। এইভাবেই চলতে থাকে ওদের তিনজনের সংসার। বড় হতে থাকে মেয়ে। ওদের দুজনের চিন্তা ভাবনা ও আনন্দ উল্লাসের ওই একটাই কেন্দ্র, ছোট্ট সুন্দর ফুটফুটে এক রত্তি মেয়ে। মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করতে হবে সেই স্বপ্নে ওরা থাকে বিভোর। 

নিজের সখ ও আহ্লাদ কাট ছাঁট করে মৃণ্ময়বাবু দোকান থেকে নানান স্কিমে একটু একটু করে সঞ্চয় করতে থাকেন ভবিষ্যতে মেয়ের পড়াশোনার জন্য প্রয়োজন পড়তে পারে বলে। এদিকে মেয়েও ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। স্কুলে ভর্তি করার সময় এসে পড়ে। গ্রামের, যেটা ওদের পাড়াতেই আছে, প্রাথমিক স্কুলে অন্যান্য সম বয়সী ছেলে মেয়ের সঙ্গে ভর্তি হয় অভয়া। 

একেবারে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা ও হাতের লেখার জন্য সকলের দৃষ্টি অভয়ার উপর পড়ে। ওদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না হওয়ার জন্য সামাজিক অবস্থান ছিল দুর্বল। কিন্তু অভয়ার সর্বাঙ্গীন বিকাশের জন্য ধীরে ধীরে সমাজে ওদের পরিবারের অবস্থান কিছুটা ভালো হয়, পাড়ার অন্য সকলে অবজ্ঞা ভুলে ইদানিং একটু আধটু ভালোবাসা ও মর্যাদা দিতে থাকে।

প্রাথমিক স্কুল থেকে অভয়ার সঙ্গে পড়ে অনুভব পাল। একই গ্রামে ও পাড়ায় ওদের বাড়ি। খেলাধুলা ও পড়াশোনা

দুই দিক থেকে ওরা দুইজনের বেশ ভালো বন্ধুত্ব। অনুভব দের বাড়ির অবস্থা বেশ ভালো। ওর বাবা পাশ্ববর্তী গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাই ওদের বাড়িতে পড়াশোনা ও ভালো রেজাল্ট করার ব্যাপারে প্রথম থেকে অনুভবের উপর একটা চাপ দেওয়া হতো। তাই ছেলে ফার্স্ট না হতে পারার জন্য প্রথম দিকে অনুভবের বাবা ও বাড়ির লোকেরা অভয়ার উপর হিংসা করতো। একটা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর মেয়ে ফার্স্ট হয়ে যাচ্ছে সেখানে শিক্ষকের ছেলের সেকেন্ড হওয়া একটু অমর্যাদাকর মনে হতো। 

একদিন অভয়া খেলতে যায় অনুভবের বাড়ি। অনুভবের বাবা সেদিন বাড়িতেই ছিল। তাই খেলার ছলে বেশ কিছু বিষয়ে ওদের দুজনের পরীক্ষা নেন সুবোধ বাবু এবং বুঝতে পারেন অনুভবের চেয়ে অভয়া অনেক এগিয়ে আছে। এরপর থেকে অভয়ার প্রতি অনুভবের বাড়ির লোকেদের ধারণা বদলে যায়। অভয়ার প্রতি হিংসার পরিবর্তে ওদের একটা মায়া ও সহানুভূতি কাজ করতে থাকে।

অভয়া মূলত মায়ের কাছে পড়াশোনা করে। তবে সময় সুযোগ করে সন্ধ্যার সময় মৃণ্ময়বাবু মেয়েকে এক আধটু পড়িয়ে দেন। তবে বেশিরভাগ দিন মৃণ্ময়বাবু এতখানি ক্লান্ত থাকেন যে অনিমা দেবী অভয়া কে বই নিয়ে উনার সামনে বসতে দিতেন না।

কিন্তু,সারাদিন পরে বাবাকে পেয়ে খেলার ছলে মেয়ের নানা আবদারের মধ্যে পড়াশোনার কিছু বিষয় অবশ্যই থাকতো। তাই অল্প কিছুক্ষণ সময় মেয়ে এটা ওটা বাবার কাছে পড়ে নিত। অভয়া বাবার কাছে অংক করতে বেশি পছন্দ করতো। তাই মৃণ্ময়বাবুও নিয়ম করে অংকটা মেয়েকে শিখিয়ে দিতেন।

এইভাবে অভয়ার পড়াশোনা চলতে থাকে। চোখের পলক পড়ার মতোই তিন চারটে বৎসর কখন যে পেরিয়ে গেল। এই সেদিন পর্যন্ত যে মেয়ে আধো আধো স্বরে কথা বলতো সে আজ প্রাথমিকের গন্ডি পেরিয়ে হাইস্কুলে ভর্তি হতে চলেছে।

বাবা মায়ের কপালে বলিরেখার ভাঁজ বেশ গভীর হয়ে ওঠে। এতদিন তো নিজেরাই মেয়েকে পড়িয়েছে। কোনো টিউশন দিতে হয়নি। আর তো নিজেরা পড়াতে পারবে না। এখন পড়ানো ওদের ক্ষমতার বাইরে। টিউশন দিতেই হবে। তাই কত টাকা লাগবে কে জানে? তার চেয়েও বড় কথা এতদিন মেয়ে ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয়নি। টিউশন দিয়ে সেরকম পড়াশোনা হবে কি না? মেয়ে আগের মতোই ভালো রেজাল্ট করতে পারবে কি না? নানা প্রশ্ন ওদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

এছাড়াও আছে বইপত্র কেনার খরচ। উঁচু ক্লাসে খাতাও অনেক লাগবে। মাঝে মধ্যেই কিনতে হবে। আবার পেন পেন্সিল,পড়াশোনা করার জন্য আরো কিছু সরঞ্জাম লাগে। সেগুলোও কিনে দিতে হবে। 

যাইহোক প্রশ্ন অনেক,চিন্তাও অনেক। তবু ওরা দুজনে দাঁতে দাঁত চেপে প্রতিজ্ঞা করে যে যেমন করেই হোক একমাত্র মেয়ে অভয়া কে যথার্থ শিক্ষা পাওয়ার সুযোগ ওরা করে দেবে। মানুষের মতো মানুষ হওয়ার শিক্ষা দিতে হবে।

অভয়া দের গ্রামের হাইস্কুলে পাশ্ববর্তী পাঁচ ছয়টি গ্রাম থেকে ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করতে আসে। তাই প্রাথমিক স্কুলে যেখানে সর্বসাকুল্যে একশো ছেলে মেয়ে ছিল হাইস্কুলে সেখানে এক একটা ক্লাসে একশো জনের বেশি ছেলেমেয়ে পড়ে। পঞ্চম শ্রেণীতে একশোর অনেক বেশি ছাত্র ছাত্রী ভর্তি হয়েছে। 

পঞ্চম শ্রেণীর তিনটে বিভাগে ছাত্র ছাত্রীদের ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। অভয়া আছে ক-বিভাগে। ওর রোল নম্বর হয়েছে এক। কিন্তু,অনুভব হয়ে গেছে খ বিভাগ। ওর রোল নম্বর হয়েছে পাঁচ। তাই ওদের দুজনের বেশ মন খারাপ। ওরা প্রায় পাঁচ বছর একসঙ্গে একঘরে বসে পড়াশোনা করছে। ওরা একে অপরের খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছে। হাইস্কুলে ছেলে মেয়ে দের আলাদা বসতে হয় সেটা ওরা জানতো, কিন্তু ওদের আলাদা আলাদা ঘরে বসতে সেটা ওরা চিন্তা করতে পারে নি।

অনুভবের বাবা এসেছিলেন হাইস্কুলে। প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দেখা করে অনুভব কে ক-বিভাগে ক্লাস করতে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। কিন্তু,প্রধান শিক্ষক বলেছেন সেটা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। পরের বছর আপনার ছেলে ভালো নম্বর রেজাল্ট করতে পারলে ক-বিভাগ হয়ে যাবে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Crime