অগ্নিকন্যা ননীবালা গুহ
অগ্নিকন্যা ননীবালা গুহ
ননীবালা গুহ (১৮৮৪-১৯৯০)
১৮৮৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী ইন্দাসের সমৃদ্ধশালী আকুই গ্রামের রক্ষিত পরিবারে ননীবালা রক্ষিত জন্ম গ্রহণ করেন। ১৮৯৩ সালে মাত্র ন’বছর বয়সে গ্রামের জগৎদুর্লভ গুহের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। কিন্তু ঠিক দু’বছর পরেই স্বামীকে অকালে হারিয়ে তিনি বিধবা হন। বিধবার পোশাক পরেই এগারো বছরের সেই বালিকা বিপ্লবী দলে নাম লেখান। এলাকার বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী জগবন্ধু দত্তের হাত ধরে স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি আত্মনিয়োগ করেন।
এই মহীয়সী নারী বৈধব্য যন্ত্রণা কাটিয়ে তৎকালীন নারী উপেক্ষিত সমাজে নিজেকে দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনে উৎসর্গ করেন। কোন বাধাই সেই সময় তাঁর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। দুর্বার গতিতে তিনি
দেশের কাজে এগিয়ে চলেন।
এলাকায় ট্রাঙ্ককল বন্ধের মাধ্যমে তাঁর বিপ্লবী জীবন শুরু হয়। ১৯৩০ সালে গান্ধীজির আইন অমান্য আন্দোলন তিনি যোগ দেন। সবরমতী আশ্রম থেকে ডাণ্ডী পর্যন্ত যে অভিযান শুরু হয়েছিল তিনি ইন্দাস এলাকায় সেই অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন । সেইসময় ডান্ডী আন্দোলনের আদলে বাঁকুড়া থেকে কাঁথি পর্যন্ত পদযাত্রার আয়োজন করা হয়। তাঁর নেতৃত্বে বাঁকুড়া থেকে কাঁথি পর্যন্ত পদযাত্রায় অসংখ্য গ্রামীণ মহিলা পথ হাঁটেন। বিলিতি দ্রব্য বর্জন, পিকেটিং, ইন্দাসে বি.ডি.আর রেল লাইন উপড়ে ফেলা, বিষ্ণুপুর আদালতে জাতীয় পতাকা তোলা এইসব বৈপ্লবিক কাজকর্মে তিনিই নেতৃত্বে দিয়েছিলেন।
ননীবালা গুহের সহজ সরল জীবন যাপন,মানুষের সাথে সহজেই মিশতে পারা,নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা ইত্যাদি কারণে তিনি এলাকার অসংখ্য মহিলাকে স্বাধীনতা আন্দোলনে একত্রিত করতে পেরেছিলেন। তাঁর নির্দেশে বাঁকুড়ার অসংখ্য গ্রাম সেদিন ইংরেজ সরকারকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দেয়। খাজনা বন্ধ করে দেওয়ার কারণে ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে।
ইংরেজ পুলিশ বেশীদিন তাকে কারাগারে আটকে রাখতে পারেনি। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি আবার স্বাধীনতা সংগ্রামে নিয়োজিত হন।১৯৩৯ সালে গ্রামে গ্রামে নারী শিক্ষার উদ্দেশ্যে একটি পাঠশালা স্থাপন করেন। ১৯৪৬ এ সেই পাঠশালা সরকারী স্বীকৃতি লাভ করে। একই সঙ্গে তিনি নিজের বসতবাড়িটিও স্কুলকে দান করে দেন।
এইভাবে সেই ছোট্ট ননীবালা একদিন বিপ্লবের মহীরুহ হয়ে ওঠেন। জীবন ব্যাপী বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের জন্য এই মহিয়সী স্বাধীনতা সংগ্রামী ‘ইন্দাসের গান্ধীবুড়ি’ নামে খ্যাত হন । বাঁকুড়ার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ননীবালা গুহের নাম চিরস্মরণীয় ওঠে।
ইন্দাসের গণ্ডী ছাড়িয়ে সাদা থান, সাদা জামা, সাদা চাদর আর পায়ে কালো চটি পরে পায়ে হেঁটেই সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে শাসপুর থেকে শ্রীপুর পর্যন্ত তিনি স্বাধীনতার বীজমন্ত্র ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। বাড়ির মহিলাদের তিনি কড়জোড়ে আবেদন করেন স্বদেশী আন্দোলনের বীর সৈনিকেরা সাহায্যের জন্য নিয়ে এলে তাঁদের যেন ফিরিয়ে দেওয়া না হয়। বাড়িতে যা থাকবে সাধ্যমতো তাই দিয়েই যেন সাহায্য করেন। তাঁর আবেদনে সাড়া দিয়ে বাড়ির মহিলারা সেইসময় স্বদেশী আন্দোলনে মুক্ত হস্তে সাহায্য করেন।
ননীবালা দেবীকে শুধু একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী বললে বোধহয় কম বলা হয়। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ সমাজ সংস্কারক। তাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তাঁর কর্মকাণ্ড থেমে যায়নি। তিনি শুরু করেন নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য আন্দোলন।
নিজে স্কুলের গণ্ডী ছোঁয়ার সুযোগ পাননি। তথাপি গ্রামের মেয়েরা নিরক্ষর থাকবে এটা মেনে নিতে পারেননি তিনি। তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে গ্রামের মেয়েদের নিজের বাড়িতে এনে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেন।গ্রামের মানুষের অকৃত্রিম সহযোগিতায় তিনি ১৯৫৯ সালে গড়ে তুললেন "আকুই ননীবালা বালিকা বিদ্যালয়।" তাঁর বহুদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হল।১৯৭১ সালে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ানোর অনুমোদন দেন।
১৯৭২ সালে ভারত সরকার তাঁকে স্বাধীনতা সংগ্রামের স্বীকৃতি স্বরূপ তাম্র পত্র সহ পেনশান প্রদান করে। স্থানীয় ব্লক ও পঞ্চায়েত সমিতির উদ্যোগে তাঁর একটি আবক্ষ মূর্তি তৈরি স্থাপন করা হয়। ১৯৯০ সালের ১৭ এপ্রিল ননীবালা দেবীর জীবনাবসান ঘটে।
