আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
ষষ্ঠ অধ্যায়
মিস শিউলি রায় সি টি ওতে ( সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিস)
একজন বুকিং ক্লার্ক । কাস্টমারদের সঙ্গে সরাসরি যোগ আছে । মেয়েটি একটি বামপন্থী ইউনিয়নের সক্রিয় সদস্যা । সুনেত্রাকে দলে টেনেছিল ওইই।
তখন সদ্য বাম আমল শেষ হয়েছে । বঙ্গ রাজনীতি নতুন কাণ্ডারীর হাতে তুলে দিতে হয়েছে স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। বাম রাজত্বে মৌখিক নির্দেশ ছিল কোন মিটিং মিছিদ বা ধর্মঘট হরতালে পুলিশ হস্তক্ষেপ করবে না ।
নতুন সরকারের নির্দেশে ধর্মঘট করা যাবে না এবং প্রয়োজনে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে ।
ভাড়া বৃদ্ধির দাবীতে বাস, মিনিবাস এবং ট্যাক্সি ধর্মঘটের দিন শিউলি দাঁড়িয়েছিল বাসস্ট্যাণ্ডে । কিন্তু যানবাহন না পেয়ে ফিরে আসছিল ।
হঠাৎ পিছন থেকে কে যেন বলে উঠল - দশ মিনিটের হাঁটা পথ ; চল গল্প করতে করতে চলে যাই ।
পশ্চাদ্দিকে চেয়ে শিউলি দেখল সুনেত্রা হাসিমুখে তার দিকে চেয়ে আছে । শিউলি সুনেত্রার চেয়ে পক্ষকালের সিনিয়ার। একই মাসেই জয়েন করেছে । তাই মোটামুটি ভালো সখ্যতা হয়ে গেছে ।
শিউলি বলল - না রে , আজ আর যাব না । ফেরার সময় গাড়ি না পেলে মুশকিলে পড়ে যাব । আমাকে তো আবার শিয়ালদা থেকে ট্রেন ধরে যেতে হবে !
সুনেত্রা বলল - অত চিন্তা করিস না তো ! আমি তো আছি। ঠিক ট্রেন ধরিয়ে দেব ।
অগত্যা শিউলিও হাঁটা শুরু করল ।
অফিসে যখন ঢুকছে অলরেডি আধ ঘন্টা লেট হয়ে গেছে ।
শিউলি বলেছিল - এই যে তুই বললি দশ মিনিটের হাঁটা পথ! এ তো দেখছি আধ ঘন্টা লেগে গেল ।
সুনেত্রা হাসল । বলল - একটু ঘুরপথে এলাম ইচ্ছে করেই। তোর সঙ্গে তো দেখাই হয় না । ইনস্ট্রুমেন্ট রুম থেকে বেরোতেই পারি না , জানিস ?
- কেন, কি এত কাজ ?
- কাজের কি শেষ আছে রে ! একটা সার্কিটে কাজ শেষ করে যেই একটু ক্যান্টিনে যাব বলে দাঁড়িয়েছি ; অমনি ব্রজদার হুকুম হল আসানশোল সার্কিটে অনেক ট্রাফিক জমে গেছে, যাও একটু হেল্প করে দাও মাণিক বাবুকে ।
- তো ? বলতেই পারিস একটু ঘুরে আসি, তারপর করে দেব। আমরা তো তাই করি । মানুষ জন লাইনে দাঁড়িয়ে আছে; দুম করে উঠে চলে গেলাম । মিনিট দশেক গল্পগুজব করে আবার এসে বসলাম ।
- পাব্লিক বিরক্ত হয় না ?
- বয়েই গেল । কেউ কিছু বলতেই পারে না । বলতে গেলেই পাশের কাউন্টারের সুখময়দা উঠে দাঁড়িয়ে বলে দেন " প্লীজ একটু ওয়েট করুন , দশ মিনিটের মধ্যেই চলে আসবে ।
- আমার তেমন সুযোগ নেই রে ! ব্রজদার হুকুম না মানলে সোজা সি এসকে গিয়ে নালিশ করে আসেন অমুক লোকটিকে স্যার এটা করতে বলেছিলাম শোনেনি।
- আরে সি এসের সঙ্গে তো তোর ভালো জানাশোনা আছে। ম্যানেজ করতে পারিস না ?
- ভীষণ ভয় করে রে ! উনি যা কড়া মেজাজের , মনে হয় ওনার সামনে দাঁড়ানোর চেয়ে ব্রজদাকে ম্যানেজ করা সোজা ।
- কাল তো তিনি বসে যাচ্ছেন । আজ একবার আয় না নীচে। গল্প করব । ভাইয়ের সোয়েটার বোনা শুরু করেছি, তোকেও শিখিয়ে দেব ।
- এই অফিসে বসে ?
- নয়তো কি ? আরে যখন ভীড় একটু কমে যায়; সীট ছেড়ে পালাই কমন রুমে । বেশ ঠাণ্ডা ঘর , বুঝলি ? ওখানে এক মনে সোয়েটার বুনি ।
সি এস মিঃ পুলক রায়চৌধুরী অনেকক্ষণ থেকে লক্ষ্য করছেন ওরা দু'জনে বেশ গল্পে মেতে আছে । সি সি টি ভিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দু'জনের কেউই ডিউটিতে বসছে না । ডাক দিলেন - রামদীন !
রামদীন সেলাম ঠুকে বলল - ফরমাইয়ে সাব ।
- যাও তো মিস সান্যালকে ডেকে আনো !
রামদীন আবার মুখের দিকে চেয়ে থাকে ।
মিঃ রায়চৌধুরী বলেন - আই আর এ কাজ করে মিস সুনেত্রা সান্যাল ...
রামদীন বলে - ডটার অফ ?
মিঃ রায়চৌধুরী হেসে ফেলেন ।
- দেহের তুলনায় তোর বুদ্ধিটা বড় পাকা রে রামদীন !
রামদীন চলে যায় এবং কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্যারকে জানিয়ে দেয় - মিস সুনেত্রা সান্যাল ডটার অফ লেট...
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মিঃ রায়চৌধুরী বলেন - হ্যাঁ হ্যাঁ, কোথায় সে ?
- সি ইজ এবসেন্ট টুডে । ব্রজদা টোলড ।
পুলক রায়চৌধুরীর মাথা গরম হয়ে যায় । - হারামজাদা!
ওই তো দাঁড়িয়ে গল্প করছে ?
- কাঁহা সাব ? টিভিকে অন্দর ?
- ঠিক দেখেছিস । যা ভেকে আন।
- নামুমকিন হ্যায় সাব ! ইতনা বঢ়া লাশ ক্যায়সে ঘুষাউঁ ?
এবার আপনারাই বলুন মাথা ঠিক থাকে ? অধৈর্য্য পুলক বাবু বললেন - হতচ্ছাড়া খোট্টা ! ইংরিজিগুলো তো গড়গড় করে বললি, এটা বুঝতে পারলি না বাঁদর; নীচে শিউলির সঙ্গে গল্পে মেতে আছে । যা ওখান থেকে ডেকে নিয়ে আয় ।
রামদীন লিফ্ট বেয়ে না নেমে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল ।
- এরা সবাই মিলে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে যেন। হারামজাদা রামদীন লিফ্ট ছেড়ে সিঁড়ি ধরল ? আমার যে সুনেত্রাকে ভীষণ প্রয়োজন !
- মেমসাব ! আপকো বড়া সাব নে বুলায়া ।
রামদীন সুনেত্রাকে বলল ।
শিউলি বলল - যা যা । আর দেরী করিস না । কি জানি আমার ডাক পড়ল না কেন ?
- মেমসাব, আপকো ভী বুলায়া - আইয়ে আপ দোনো ।
রামদীন সিঁড়ি দিয়ে নেমেছিল , ফের সেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগল ।
সুনেত্রা এবং শিউলি দু'জন বড় সাহেবের ঘরে ঢুকে বলল - সরি স্যার ! আজ বাস, ট্যাক্সি ধর্মঘট চলছে । আসতে দেরী হয়ে গেল । পায়ে হেঁটে এলাম কি না !
- সে তো দেখতেই পেয়েছি । আর মিস শিউলি , আপনি এসেছেন কেন ? আপনাকে তো ডাকিনি !
শিউলি বলল - রামদীন তো তাই বলল স্যার । আপকো ভী বুলায়া ।
হাঁফাতে হাঁফাতে এসে রামদীন বলল - উনলোগো নে কামমে থা। ইসলিয়ে...
দাঁত খিঁচিয়ে মিঃ রায়চৌধুরী বললেন - যা নাকে নস্যি লাগিয়ে নে ।
তারপর সুনেত্রাকে বললেন - কাজে ঢুকতে না ঢুকতেই এমন অভ্যাস তৈরী করে নিলে ভবিষ্যতে কপালে দুঃখ আছে । গল্প করতে হলে টিফিন টাইমে কোরো । আর আগামীতে কোনদিন যেন এমনটা না দেখি !
হেহে উঠল শিউলি, হাসল সুনেত্রাও ।
- কি হল ? এতে হাসির কি আছে ?
শিউলি হেহে হেসেই বলল - কিছু না স্যার ।
সুনেত্রা বলল - আপনি তো কালই অবসর নিচ্ছেন- না স্যার ?
পুলক বাবু হাসির কারণ বুঝতে পেরে বললেন - তোমরা তো সবে ঢুকেছ । এই সময় যা শেখার শিখে নাও। একজন একনিষ্ঠ কর্মীরূপে প্রতিন্ঠা পেলে তখন না হয় এক-আধটু ফাঁকি দিও ।
ওরা থ্যাঙ্কস বলে বেরিয়ে যাচ্ছিল । মিঃ রায়চৌধুরী সুনেত্রাকে বলদেন - ব্রজবাবুকে বলবে আমি ডেকেছিলাম । তোমাকে তো এবসেন্ট দেখিয়ে দিয়েছেন মনে হয় ।
পুলক বাবুর মনে হল আসল কথাগুলোই তো সুনেত্রাকে বলা হল না - যে জন্য তিনি ওকে ডেকেছিলেন। মাঝখানে শিউলি এসে ----- না না শিউলি নয় ; এই হতচ্ছাড়া উজবুক খোট্টাটা যত গোলমাল পাকিয়ে দিলে !
আবার ডাকলেন - রামদীন !
রামদীন ভেতরে এসে বলল - ফরমাইয়ে সাব !
- পতা লাগাও ওহি লড়কি কৌন হ্যায় ?
- কন লড়কি সাব ? শিউলি ম্যাম ইয়া সুনেত্রা ম্যাম?
( চলবে )