আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
দশম অধ্যায়
বাড়ী ফিরতে রাত দশটা বেজে গেল । বর্ধমান স্টেশনে নেমে বাস ধরতে চলেছি বড়দা আর আমি। মল্লিকপুরের শেষ বাস নাকি একটু আগেই ছেড়ে গেছে। কাজেই একটা টোটো ধরে কোনমতে পৌনে এগারোটা নাগাদ বাড়ী পৌছালাম।
বড়দা বললেন - নে এবার হাতমুখ ধুয়ে নে । রাত হল ; খেয়ে নিয়ে গল্প করব ।
আমি ব্যাগ থেকে উপহার সামগ্রী বের করে দেখাচ্ছি। দাদা নিবিষ্টচিত্তে দেখে চলেছেন । একেকটা জিনিস দেখছেন আর ' বাহ্ খুব সুন্দর ' বলে নামিয়ে দিচ্ছেন ।
এ ভাবে দেখতে দেখতে একটা খাম হাতে নিয়ে তা' খুলে দেখলেন । একটা ছোট্ট চিঠি ।
পূজনীয় বাবা ,
তোমাকে শেষ দেখা দেখে নিলাম। তোমার প্রশান্তি যেন চিরকাল অটুট থাকে । আর হয়তো কোনদিন দেখা হবে না । কারণ তোমার আর কলকাতা আসার প্রয়োজন নেই। সবই তো এখন অনলাইনে হয়ে যায় ! আশা করেছিলাম আমার চিরকুটগুলো দেখে তুমি অন্তত একবারের জন্য হলেও মাকে দেখে যাবে । তাও তো হল না ! বিদায় !
ইতি তোমার বুকুন।
এক নি:শ্বাসে চিঠিখানা পড়ে ফেললেন বড়দা । তারপর তা' যথারীতি ভাঁজ করে খামে ভরে দিলেন । আর ওটা যেখানে যে অবস্থায় ছিল রেখে দিলেন । আমি হাত পা ধুয়ে খাবারের আসনে বসলাম ।
দু'টো থালায় ফেন ভাত, আলুসেদ্ধ, আর ডিমের ওমলেট নামিয়ে বসে পড়লেন।
বড়দা কোন কথা বলছেন না দেখে প্রশ্ন করলাম - আপনাকে কেমন গম্ভীর দেখাচ্ছে কেন ? এই তো একটু আগেই কত কথা বলছিলেন !
বড়দা প্রত্যুত্তরে বললেন - শরীরটা ভালো নেই রে ভাই । ক'দিন হল একটু কমজোরী ফিল করছি ।
- সে কি ? বলেননি তো ! ব্লাড প্রেসার চেক করিয়েছেন ?
- সময় কোথা' বল ! ঘরবাড়ী সামলাব না নিজেকে দেখব বল তো ? কতদিন পর একসাথে খাচ্ছি তাই না ভাই ?
বড়দা প্রসঙ্গ বদলাতে চাইছেন দেখে জলদি খাওয়া দাওয়া সেরে বি পি মিটার বের করে ওই অবস্থায় প্রেসার মেপে দেখলাম ১০০/৬৫ ।
বড়দা বললেন - কালও তাই ছিল । ভেবেছিলাম লো প্রেসার ; একটু খাওয়া দাওয়া করলেই নরমাল হয়ে যাবে।
বললাম - আহা মরি কিছু করেননি। ডাক্তার দেখানো উচিৎ ছিল ।
বলে ডাক্তার সমরেশ দত্তকে ফোন করলাম । ডাক্তার বাবু বললেন - সর্বনাশ ! প্রেসার তো হেভি লো । আমি আসছি ওষুধপত্র নিয়ে । আগে ভালো করে চেক আপ করি তারপর ওষুধ দিয়ে আসব । ভেবো না পুলক! আমি এলাম বলে ।
ডাক্তার দত্ত মানুষ হিসাবে মহান । ডাক্তারীর বড় বড় পদ ছেড়ে গ্রামেই পড়ে রইলেন জনসেবার জন্য । তবে কখনো কখনো বর্ধমান মেডিকেল কলেজে লেকচার দিতে যান ।
বড়দা যেন ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে পড়ছেন । আমি ব্যাকুল হয়ে ডাক্তারের অপেক্ষা করছি ।
বড়দা বললেন - অত অস্থির হোস না তো ! আমার তেমন কিছু হয়নি । আটাত্তর পেরোল ঠিক; এখনও কয়েক বছর হেসে খেলে পার করে দেব । আচ্ছা ভাই ! একটা কথা বলব? সঠিক জবাব দিবি তো ?
- প্রশ্নটা তো করুন। সঠিক বেঠিক আপনিই বিচার করবেন ।
ডাক্তার বাবু দরজা থেকে ডাকলেন - কই হে উৎসব ? দরজা খোল , আমি এসেছি।
এক দৌড়ে দরজা খুলে ডাক্তার দত্তকে নিয়ে এলাম ভেতরে। দেখুন স্যার, ভালো ভাবে চেক করে , ওঁর শারীরিক অবস্থা কেমন আছে !
তিনবার প্রেসার চেক, নাড়ি টিপে, মুখ, জিভ এবং চোখ দেখে তিনি বুকে স্টেথো বসিয়ে দেখলেন ।
- প্রেসার তো তেমন লো নয় ! এই যে বললে ১০০/৬৫ ?
তোমার প্রেসার মেশিনে ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেছে তাহলে।
যাক চিন্তা নেই । একটু বেশী বেশী প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট খাও । আমি সালফারের একটা ট্যাবলেট দিচ্ছি - প্রতিদিন একটা করে পাঁচ দিন খেও । আর ভালো ভালো খাবার খেলেই নরমাল হয়ে যাবে ।
ডাক্তার দত্তকে বিদায় করে বড়দার পাশে বসলাম।
বললাম - এই যে বলছিলেন গল্প করব ! তো বলুন কি বলবেন ?
- তুই বিয়ে করেছিস নাকি ?
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম যেন ।
- বুকুন নামে একটা মেয়েও আছে ?
এবার আমার বুক দুরু দুরূ করতে লাগল । বুকুনের কথা তিনি জানলেন কি ভাবে ? তবে কি লঙ্কেশ্বর এতদিনে আমার সংবাদ পেয়ে গেছেন?
বড়দা খামটা আমার হাতে তুলে দিয়ে বললেন - এটা তোর ব্যাগে ছিল ।
আবার বুকুন ! কোথা থেকে এল সে ? এখানেও পৌঁছে গেছে দেখছি । খামটা হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলাম । বিষয়বস্তুও পড়লাম । কিন্তূ বড়দাকে কি জবাব দেব ভেবে পেলাম না ।
বানিয়ে কিছু একটা বলে দিতে পারতাম । কিন্তু যার দাদার নাম উৎসব রায়চৌধুরী তাঁর ভাই হয়ে মিথ্যে বলতে ঘৃণা হল ।
বললাম - আপনার পা ছুঁয়ে বলছি বড়দা যা যা বলব সব সত্যি । এক বর্ণও মিথ্যে বলব না । এই বুকুনকে আমি এখনও চোখে দেখিনি । সুনেত্রা সান্যাল নামে একটি মেয়ে দিন পলের কুড়ি আগে আমার অফিসে জয়েন করে । সার্ভিস বুকে ওর জন্ম তারিখে কাটাকুটি দেখে ওখানে একটা সই করে দিতে বলেছিলাম অথেন্টিসিটির জন্য । মেয়েটি করে দিল । জয়েন করিয়ে চেম্বারে ফিরে এসে দেখি একটা চিরকুট টেবিলে নামানো । সেখানেও সম্বোধন ' বাবা ' বলে । অথচ চিরকুটে আমার নাম স্পষ্ট লেখা শ্রীযুক্ত পুলক রায়চৌধুরী সমীপেষূ ।
আর একদিন এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটে । মিস শিউলি রায় নামে এক কমবয়সী মেয়ে চেম্বারে এসে বলে ' স্যার এক ভদ্রমহিলা আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী । আমি বিজি ছিলাম বলে তখনই ডাকতে পারিনি । তারপর সেটা ভুলেও গেছি । ভদ্রমহিলা দেখা না পেয়ে নাকি চলে গেছেন বলে জানায় ওই শিউলি রায় । আর তারপরই পাই আর একটা চিঠি। সেখানেও ' বাবা ' সম্বোধন এবং ' ইতি বুকুন ' লেখা। এখনও তাই দেখছি।
বড়দা বললেন - তার মানে তুই বিয়েটিয়ে করিসনি ?
আমি হতভম্বের মত বলি - দাদা ! আমি বিয়ে করব; আপনাকে না বলে ! একথাও আমাকে শুনতে হল ?
- দেখ ভাই ! রাগ অভিমানের কথা নয় ; চিঠিটা আমি পড়েছি বলেই সন্দেহ হল ।
- আর তাই আপনার বি পি লো হয়ে গেল ?
বড়দা হো হো করে হেসে উঠলেন ।
আমি বললাম - এই বুকুনকে নিয়ে আমার মাথাব্যথার শেষ নেই ।
- কেন ভাই ? তোর কি মনে হয় বুকুন কোন পাগলামি করছে ?
- কি জানি দাদা ! বুকুন বলে কোন মেয়েকে তো দেখিনি ; তবে একটা অদ্ভুতুড়ে গন্ধ পাচ্ছি । আচ্ছা দাদা ! এটা কারও মস্তিষ্কপ্রসুতও তো হতে পারে । আমাকে চঞ্চল করে তুলতে এ ধরণের ...
তাই বা কেন হবে ?
বড়দা বললেন - এ নিয়ে আর গবেষণা করতে হবে না । তবে হ্যাঁ, তুই বলেছিস না অবসর পরবর্তী জীবন টিকটিকিগিরি করবি ? আমার মনে হয় সে সুযোগ তোর সামনে এসে গেছে। খুঁজে বের কর বুকুনকে। তার চিঠি লেখার কারণ - সব । তবে জানব গোয়েন্দাগিরিতে তোর ভবিষ্যৎ কেমন হবে ।
- সে তো ঠিক। তবে দাদা ! প্রয়োজনে বুদ্ধিটা ধার দেবেন তো ?
- আরে শেষ বয়সে ধার দেব কি ! আমারই তো দেখছি বুদ্ধিভ্রম হচ্ছে মাঝেমধ্যেই।
( চলবে )