উত্তরণ
উত্তরণ
মাননীয় অধিকর্তা,
জাতীয় সংগ্রহশালা,
কলকাতা।
মহাশয়,
আমি দিন কতক আগে আমার দিদা শ্রীমতী ব্রজবালা রায়ের হাতে লেখা একটি ডায়রি পাই যেটি আমার মতে ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ নথি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আমি এই বিষয়ে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার হেতু গোটা ঘটনাটি সাধ্যমত বিবৃত করছি।
গত সপ্তাহে আমি উলুবেড়িয়ায় আমার মামার বাড়ি গিয়েছিলাম। সেখানে বর্তমানে আর কেউ থাকেন না। দীর্ঘকাল আমার মামা মামী প্রবাসী। আমার মা এবং বাবাই মোটের ওপর দেখভাল করেন বাড়িটি। মাসে মাসে একবার করে যান সেখানে। এছাড়া সব সময়ের জন্য রয়েছেন বহু দিনের পুরনো এবং বিশ্বস্ত কেয়ারটেকার রঘু দাদু।
পড়াশোনার জন্য আমিও বিদেশে থাকি। তাই দেশে বছরে একবারের বেশি আসা হয় না। এলেও সময় বিশেষ থাকে না। এইবার একমাসের ছুটি মঞ্জুর হওয়ায় বহুদিন পর মামারবাড়ী যাই। সেখানে একদিন চিলেকোঠার ঘরে ঘুরতে ঘুরতে বইপত্র ঠাসা একটি পুরনো সেগুন কাঠের দেরাজ আলমারি আমার নজরে আসে। সেখানেই এই চামড়ায় বাঁধানো ডায়রিটি পাই।
ডায়রিটির অবস্থা একেবারেই ভালো নয়। পাতাগুলো বেশিরভাগই ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। তবু যেটুকু পড়া গেলো তার বেশিরভাগই স্বদেশীদের কর্তব্য, বিভিন্ন পরিকল্পনা, দলীয় সভার কার্যবিবরণী ইত্যাদি নিয়ে লেখা। প্রত্যেকটি তথ্যই ইতিহাসের পুনঃনির্মাণের ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে বলে আমার ধারণা।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে আমার দিদা শ্রীমতী ব্রজবালা রায় গোপনে স্বদেশী কাজকর্ম করতেন এবং অনেক বড় বড় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সাথে তাঁর আলাপ পরিচয় ছিল। সরকারি চাকুরে হয়েও দিদিমার কাজে দাদুর যথেষ্ট সমর্থন ছিল। তেমনটি না হলে তখনকার দিনে দিদিমা সংসার সামলে এই দুঃসাহসিক কর্মযজ্ঞে নিজেকে যুক্ত করতে পারতেন না । যাক সে কথা। বরং আসল কথায় আসি।
এই ডায়রি পড়ে আমি এমন একটি তথ্য জানতে পারি যেটি স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল ধারার ইতিহাস চর্চাকে নতুন দিশা দেখাতে পারে। এ এক ব্যতিক্রমী নিম্নবর্গীয় নারীর কথা যিনি তার কাজের জন্য সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছিলেন অনেক আগেই । তবে তার পরবর্তী জীবনে নিজেকে তিনি যে স্তরে উত্তরিত করেছিলেন, এটি তারই গল্প। না তিনি ব্রজবালা রায় নন। তাঁর নাম বিন্দি বাগদি। আপনারা সকলেই তাকে চেনেন। বিদ্রোহী কবির কলম তাকে আপামর জনগণের সঙ্গে বহু আগেই পরিচয় করিয়েছে ' রাক্ষুসী ' গল্পে।
দিদার ডায়রি পড়ে জানতে পারলাম ১৯২৬ সালে দাদু প্রমথনাথ রায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বীরভূমের সিউরিতে বদলি হন। দিদা দাদুর সাথে সেখানে যান। সেখানে তিনি যথারীতি জড়িয়ে পড়েন ইংরেজ বিরোধী নানান কাজে। সেই সময় সিউড়ি, দুবরাজপুর, লাভপুর, আমোদপুর, জাজিগ্রাম, ভালাসের মতো বিভিন্ন শহর এবং গ্রামে দাউদাউ করে জ্বলছে বিপ্লবের লেলিহান শিখা। গ্রামের সাধারণ মহিলাদের তখন রুখে দাঁড়ানোর সাহস যোগাচ্ছেন বিপ্লবের ভূতপূর্ব নেত্রী দুকড়িবালা দেবীর প্রতিবাদী কর্মকাণ্ডের ইতিবৃত্ত।
এই পটভূমিতেই দিদা সিউড়িতে শুরু করেন স্বদেশী কাজকর্ম। গোপনে যোগাযোগ করেন কংগ্রেসীদের সঙ্গে। অচিরেই তিনি স্থানীয় সংগঠনের একজন সক্রিয় সদস্যা হয়ে ওঠেন। তার উপর দায়িত্ব বর্তায় গ্রামে গ্রামে অকুতোভয় বেশ কিছু মহিলাদের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় ভাবে সামিল করার। সেই কাজে দিদা ঘুরতে থাকেন গ্রামে গ্রামে, পাড়ায় পাড়ায়, মহল্লায় মহল্লায়। যদিও লোকসমক্ষে তিনি ছিলেন মাস এডুকেটর যাঁর কাজ ছিল গ্রামের দরিদ্র নিরক্ষর মানুষ বিশেষত মহিলাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা। কিন্তু গোপনে তিনি গ্রামের মহিলা এবং যুবকদের দীক্ষিত করতে থাকেন বিপ্লবী মন্ত্রে।এই সময়েই তার সাক্ষাৎ ঘটে সেই বাগদি বউটির সাথে যাকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন সেই মর্মস্পর্শী ছোট গল্প।
তত দিনে সেই গল্প পড়া হয়ে গেছে দিদার। তিনি তার সংগঠনের সূত্রে আরো জানতে পেরেছেন যে সেই মেয়ে সিউড়ির অদূরে পূরন্দরপুর নামে একটি গ্রামে বাগদি পাড়ায় থাকে। নাম তার বিন্দি বাগদি। যতই শিক্ষিত সমাজ তাকে প্রতিবাদী নারীর মর্যাদা দিক না কেনো, পল্লীসমাজের চোখে সে বরাবরের মতই অচ্ছুত, অপয়া, সমাজচ্যুত রাক্ষসী মাত্র। কারণ সে আর পাঁচজন গ্রাম্য বালিকার মত নির্বিবাদে মেনে নেয়নি স্বামীর লাম্পট্য। স্বামীকে যখন হাতে পায়ে ধরেও ব্যর্থ হয়েছে বোঝাতে, তখন বাধ্য হয়ে সংসারকে বাঁচাতে, নিজের হাতে চরম শাস্তি দিয়েছিল তাকে। তেমন কাজের উদাহরণ পল্লী সমাজে শুধু বিরল বললেও কম বলা হয় বরং উল্টোটাই ছিল অনেক বেশি স্বাভাবিক। বিন্দি স্বামী হত্যার দায় স্বীকার করে ভোগ করেছিল নিয়মমাফিক কারাবাসের যন্ত্রণা। কিন্তু সমাজের এজলাসে তারপরেও চলেছিল তাঁকে নিয়ে কাঁটা ছেড়া। সমাজের নজরে সে ছিল আজীবনের জন্য দাগী আসামী। একজন স্ত্রী হয়ে এমন নারকীয় হত্যাকাণ্ড সমাজের চোখে মোটেই মনুষ্যচিত ছিল না। তাই তাকে ডাইনি, রাক্ষসী কোনো অপবাদ দিতেই ছাড়ে নি গাঁয়ের বাগদি সমাজ। ছেলে ছেলের বউ নিয়ে একঘরে হয়েছিল গোটা পরিবার।
দিদা যেদিন বাগদি পাড়ায় যায় সেদিন এই বিন্দি বাগদি ঘাট থেকে কলসিতে জল নিয়ে ফিরছিল ঘরে আর কতগুলো ছেলে দূরে একটা কৃষ্ণচূড়ার মগডালে বসে ঢিল ছুড়ছিল আর যথারীতি ' ডাইন মাগী , ডাইন মাগী ' বলে খেপাচ্ছিল। সেই বিন্দি বাগদিও ছেড়ে কথা বলবার পাত্র নয়। শাপ শাপান্ত করতে করতে আপন মনে হাঁটছিল। চুলে পাক ধরলেও তখন তার শরীরে বাসা বাঁধেনি মেদ বা জরা।ধনুকের জ্যার মতই টানটান তাঁর শরীর। গায়ে গতরে রোজ খেটে খেতে হয়, সেটা মালুম হচ্ছিল ভালই। দিদা বিন্দিকে ইতিপূর্বে কখনো দেখেননি। তবে এইসব দেখে আঁচ করেছিলেন এই হয়ত সেই দুঃখিনী যাকে নিয়ে গল্প লিখেছেন বিদ্রোহী কবি। দিদা নিছক কৌতূহল বশেই নিজের গরজে খুঁজে খুঁজে পৌঁছে গেছিলেন বিন্দির বাড়ি। গায়ের শেষ মাথায় জোড়া দীঘির গা ঘেঁষে ছিল তার ছোট্ট কুটিরখানি।
বিন্দি সেদিন দুপুরবেলায় নিজের দাওয়ায় বসে শোনাচ্ছিলেন সেই দুঃখের দিনগুলোর কথা । দুলির ছেলে পাঁচু বাগদীর সাথে সদরে সেরেস্তায় কাজের সুত্রে নাকি একদিন আলাপ হয়েছিল কবির। কবিকে তখন সে কথায় কথায় বলেছিল, তাদের দুঃখের কথা, তাদের দুঃখিনী মায়ের কথা। কিছুদিন আগেই বিন্দি শুনেছে কাজী নজরুল নামে সেই মস্ত বড় কবি নাকি দরদ দিয়ে লিখেছে তার পোড়া কপালের কথা। দিদা সেদিন তাঁকে স্বান্তনা দিয়ে বলেছিলেন - " দুঃ
খ করো না বিন্দি। সিউরির মাঠে জানো তো গান্ধীজি এসেছিলেন দিন কতক আগে। তিনি সেখানে সভায় বলেছেন মানুষে মানুষে এমন ভাগাভাগি না করতে, আপদে বিপদে সব ভুলে মানুষের পাশে দাঁড়াতে। দেখো একদিন লোকে ঠিক বুঝবে তোমায়।"
বিন্দি সেদিন সে কথা শুনে মনে বল পেয়েছিল কিনা জানা নেই তবে দিদা ঠিক করেছিলেন বিন্দিকে তিনি যুক্ত করবেন দেশের কাজে। তার আর কিছু হারানোর নেই। বরং দুলির মধ্যে যে ক্ষোভের বারুদ জমা হয়েছে তাকে সঠিক কাজে লাগাতে পারলে সে হয়ে উঠতে পারে দলের সম্পদ। আর সেটিই হবে সমাজের সকল বঞ্চনার বিরুদ্ধে তার যোগ্য জবাব। বিন্দিও দিদার প্রস্তাবে রাজী হতে দ্বিতীয় বার ভাবেনি। বলেছিল - " বুন, তুই আমারে একবার বাঁচবার সুযোগ দে। "
দিদা বিন্দি আর তার পরিবারকে নিয়ে চলে এসেছিলেন শহরে। সেখানে দলেরই কর্মী, স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষিকা প্রতিমা মাইতির বাড়িতে তাদের নতুন জীবন শুরু হয়েছিল। দিদা বিন্দিকে নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন, দিয়েছিলেন প্রয়োজনীয় অস্ত্র শিক্ষা , শিখিয়েছিলেন লাঠি খেলা। তারপর দলের নিয়মানুসারে সকল পরীক্ষায় কৃতকার্য হলে দিদার এই ছাত্রীকে দলের নেতা প্রভাত কুমার ঘোষ বোধন করেছিলেন দেশ মাতৃকার অগ্নিমন্ত্রে। এই দিনগুলোর কথা বেশ সবিস্তারে গুছিয়ে লেখা আছে ডায়রিতে।
তারপর কেটে গেছে মাঝে অনেকগুলো বছর। দাদুও পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথমে রাজশাহী, মেদিনীপুর হয়ে পুনরায় বদলি হয়েছেন বীরভূমে। ততদিনে বীরভূম পরিণত হয়েছে একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গে।
দিদা সেখানে কিছু দিনের মধ্যে থিতু হবার পরই যোগাযোগ করলেন পুরনো বিপ্লবীদের সাথে। তাঁদের মুখেই শুনলেন বিন্দির কথা। গায়ের পাঁচ ঘর মানুষের লাথি ঝ্যাটা খেয়ে বেঁচে থাকা হতভাগিনী এখন নাকি সামলাচ্ছে পনেরো বিশজনের এক মহিলা দলকে, সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে তাদের। কখনো বিপ্লবীদের চোরা গোপ্তা আন্দোলনে সামিল হচ্ছে অস্ত্র হাতে, কখনো ঘরের চালে লুকিয়ে রাখছে বিপ্লবীদের লুঠ করে আনা কার্তুজ, পিস্তল, কখনো কাছারিতে ডাকাতি করে আসা দলের লোকেদের আড়াল করছে পুলিশি তল্লাশির সামনে।
দিদা মনে মনে সব শুনে হাসলেন। বুঝলেন মানুষ চিনতে তিনি ভুল করেন নি।
দিদার ডায়রীতে লেখা আছে, ১৯৩১ সালের এপ্রিল মাসে হালসুত গ্রামে স্বাধীনতা সংগ্রামী সরোজিনী দেবীর বাড়িতে বিপ্লবী গোষ্ঠীর এক গোপন বৈঠক আয়োজিত হয়। বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি সহ বেশ কিছু জাতীয় এবং আঞ্চলিক বরেণ্য নেতা উপস্থিত ছিলেন বৈঠকে। এই বৈঠকে বিন্দি ও তার মেয়েরা পরিবেশন করেন রক্ত গরম করা বিদ্রোহী কবির সেই গান -
'কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।..'
বিপ্লবী গোষ্ঠী তাঁদের সমিতির নামকরণ করেন – নিউ সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান এসোসিয়েশন।
দিদার লেখা ডায়রির পাতাগুলো এরপর বেশ খানিকটা জায়গা বেশ অপাঠ্য, ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। হাতে নিতেই পাউডারের মত গুড়ো গুড়ো হয়ে যাচ্ছে। আপনারা আশা করি এই লেখাগুলো উদ্ধারের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারবেন। আমি পাতাগুলোর মাঝে একটা সেই সময়কার প্যামফ্লেট দেখতে পেলাম। এর হালও অত্যন্ত শোচনীয়। বিস্তারিত পড়ার উপায় নেই। শুধু কোনরকমে কিছু অক্ষর পাজল খেলার মত মিলিয়ে যেটুকু পড়া গেল তাতে বোঝা গেল নামটা - 'Ethics of Individual Murder' ।
ডায়রির শেষের মোটা পাতার লেখাটি কোনো রকমে টিকে আছে এখনো। হয়ত পাতাটি বাকি পাতার তুলনায় মোটা হওয়ায় এখনো পড়া যাচ্ছে বেশ। আমি দিদার বয়ানেই তুলে দিলাম বাকি লেখাটি।
" এই খাতাটির প্রয়োজন ফুরাইয়াছে। আমার স্বামী শ্রী প্রমথনাথ রায় বর্তমানে গুরুতর অসুস্থ। তার সুস্থ হইবার জন্য দীর্ঘ মেয়াদি চিকিৎসা এবং শুশ্রূষার প্রয়োজন। এছাড়া ডাক্তার মেরিল রস আমাকে পরীক্ষা করিয়া জানিয়েছেন যে আমার গর্ভসঞ্চার হইয়াছে। সেই কারণে আমি কালই কলিকাতা ফিরিয়া যাইতেছি। দেশের কাজে সক্রিয় ভাবে যুক্ত থাকা আমার পক্ষে এখন আর সম্ভব নয়। দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনের দায়িত্ব যাহারা নিজের জীবন তুচ্ছ করিয়া রক্ষা করিতেছেন তাদের সকলের প্রতি রইল আমার সস্রদ্ধ প্রণাম । আমার স্থির বিশ্বাস তাহারা তাদের লক্ষ্যে সফল হইবেই। বন্দে মাতরম। ইতি ব্রজবালা দাসী। তারিখ - ৪ঠা জৈষ্ঠ্য, ১৩৩৮ বঙ্গাব্দ।"
ডায়রিটা বন্ধ করতে গিয়ে চোখে পড়ল ডায়রির কভারে গুজে রাখা আনন্দবাজার পত্রিকার একটা বিশেষ প্রতিবেদন - 'গত মাসে দুটি নিষিদ্ধ পুস্তক যথাক্রমে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা 'বিষের বাঁশী ' এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা 'পথের দাবী ' এবং সেই সাথে' Ethics of Individual Murder' প্রচারপত্র গোপনে বিলি করার সময় সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের অভিযোগে বিপ্লবী জয়গোপাল চক্রবর্তী ধরা পড়িয়াছিলেন। তিনি রাজসাক্ষী হন। তাঁর বক্তব্যের ভিত্তিতে পুলিশ খানা তল্লাশি চালা়ইয়া একে একে জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে আরো বিয়াল্লিশ জন বিপ্লবীকে আটক করিয়াছিলেন। এক মহিলা সহ আরো দুই জন পালাইতে গিয়া পুলিশের গুলিতে নিহত হন। মহিলার নাম বিন্দি বাগদি এবং বাকি দুজনের নাম সনাতন হাঁসদা এবং জগন্নাথ মুর্মু। পুলিশ ধৃতদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা, সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ সহ একাধিক অভিযোগের ভিত্তিতে ফৌজদারি বিধি মতে বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করিয়াছেন।' উপরে তারিখটা দেখলাম ১৭ই জুন, ১৯৩৩।
ডায়রিটা সযত্নে গুছিয়ে তুলে রাখলাম। সারা শরীরের প্রতিটি রোমকূপে তখনও অনুভব করছি শিহরণ। দিদাকে আমি পাইনি। মায়ের মুখেই শুনেছি তাঁর কথা। আজ যেনো নিজের অজান্তেই নতুন করে আবিষ্কার করলাম তাকে আর জন্ম দিলাম ইতিহাসে চির উপেক্ষিত এক নিম্নবর্গীয় নারী চরিত্রকে যে কিনা সারা জীবন ধরে লড়াই চালিয়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে। সমাজ তাকে রাক্ষুসী বললেও আমার কাছে তিনি কালোত্তীর্ণা।
আমার বক্তব্য আমি এখানেই শেষ করছি। বাকি আপনাদের বিবেচ্য। আমি এই সম্পদটি আপনাদের হাতে তুলে দিতে চাই। আপনাদের সুচিন্তিত মূল্যবান মতামতের অপেক্ষায় থাকলাম।
ধন্যবাদ
পুনশ্চ - সব চরিত্র কাল্পনিক। বাস্তবের কোনো ঘটনার সাথে এর মিল একান্তই অনভিপ্রেত। সমকালীন ইতিহাসকে এই কাহিনীর আধার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র। বিদ্রোহী কবির একটি যুগোত্তীর্ণ চরিত্রকে আমি নিজের মত করে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সম্মানিত করতে চেয়েছি মাত্র। বিদ্রোহী কবির প্রতি এ আমার শ্রদ্ধার্ঘ।