Nityananda Banerjee

Action Fantasy Thriller

3  

Nityananda Banerjee

Action Fantasy Thriller

তারানাথ তান্ত্রিক (৩)

তারানাথ তান্ত্রিক (৩)

5 mins
371


তারানাথ কাপালিক । তন্ত্রবিদ্যায় সিদ্ধ। এমনই তাঁর দশা যে তিনি নিজের পূর্ব পরিচয় সবিশেষ বিস্মৃত হয়েছেন। পুরাণো দিনের বা বাল্যকালের কোন কথাই তাঁহার মনে নাই। জিজ্ঞাসা করলে বলতেন -' ছাড় তো ও সব। পুরণো কাসুন্দি ঘেঁটে কি হবে? ও সব আর একদম মনে নেই ।'

বুঝতে পারি আগের কথা সত্যিই তিনি বেমালুম ভুলে গেছেন। চুপ করে যাই। ও নিয়ে আর কথা বাড়াই না। মনে যদি পড়ে নিজেই বলবেন।

গুহার বাইরে স্বহস্তে লাগানো বটের গাছটি এখন মহীরুহ। তার চাতাল বাঁধানো থাকায় দর্শনার্থীদের খুব সুবিধা হয়েছে। প্রখর গ্রীষ্মের দুপুরেও বেশ শীতল স্নিগ্ধ পরিবেশ। নীচে খটখটে শুকনো ডাঙরা নদী । বালি খুঁড়লে অবশ্য পানীয় জলটুকু দেদার পাওয়া যায়। নিকটবর্তী গ্রামের লোকেরা বালি খুঁড়ে রোজ সকাল বিকেলে জল নিয়ে যায়। সে কারণে জায়গাটা নিরিবিলি হলেও দিনের বেলায় বিশেষ করে গরমের সময় কোন না কোন লোকজন থাকেই। তবে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হতেই আবার শুনশান হয়ে যায়। তখন একমাত্র অধিবাসী তান্ত্রিক তারানাথ। একবার ডাকাতদল এসে গুহাটা দখল করতে চেয়েছিল। সবার হাতে মুঙ্গেরী গাদা বন্দুক। গুহায় ঢুকে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়েছিল। বরাতজোরে তান্ত্রিক বেঁচে গেছে। না , তাই বা বলি কেন ! মায়ের কৃপায় বেঁচে গেছে। তারানাথ মা অন্ত প্রাণ। তাই হয়তো...

ডাকাতরা এক অলৌকিক দৃশ্য দেখেছিল সেই রাতে। একটি জ্বলন্ত চলন্ত প্রদীপ আশ্চর্য্য করা দীপ্তি ছড়িয়ে ডাকাতদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। আর সেই প্রদীপ লক্ষ্য করে এলোপাথাড়ি গুলি চালাতে যেয়ে সবাই গুহায় অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল।বাইরের অপেক্ষমান বাকি ডাকাতেরা তা' বটের তলায় বসে প্রত্যক্ষ করেছিল। সৌজন্যে দুটো বড় আকৃতির আয়না। এই আয়না দুটো গ্রামের মাতব্বর লাগিয়ে দিয়েছিল পেরিস্কোপের সূত্র ধরে।

যাতে ভেতরের দৃশ্য বাইরে এবং বাইরের দৃশ্য ভেতরে বসে দেখা যায়। বটতলায় অপেক্ষমান ডাকাতেরা গুহার মুখে বসানো সেই আয়নায় সব দেখেছিল। ডাকাতেরা কেমন করে ভেতরে পজিশন নিয়ে গুলি ছুঁড়ছিল, কেমন ভাবে ঐ আশ্চর্য্য দীপের আলোয় অজ্ঞান হয়ে রইল - সব। আবার তারানাথও একই উপায়ে বাইরের ডাকাতদের দেখছিল। যখন ওরা দেখল সর্দার সমেত সবাই ভেতরে অচেতন হয়ে পড়ে আছে; বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে ' য পলায়তি স জীবতি' ধরে নিয়ে লম্বা দৌড় দিয়ে পালিয়েছিল ।

এদিকে জনা দশ-বারো যারা গুহায় ঢুকেছিল তাদের ঐরূপ দশা দেখে তারানাথের মনে করুণার উদ্রেক হল । তিনি কমণ্ডলু থেকে জল নিয়ে 'মাভৈ: মাভৈ:' বলে তাদের চোখেমুখে জলের ছিটা দিলেন। ডাকাতেরা জ্ঞান ফিরে পেল। সর্দার দেখল এমন সুযোগ হাতছাড়া করা যায় না। বন্দুক তুলে তারানাথের কপালে ঠেকিয়ে গর্জে উঠল -' এখনই এই জায়গা ছেড়ে চলে যাবি তো ভালো, নইলে আমার এই বন্দুকে যা আছে সব খালি করে দেব।'

তারানাথ ভয় পান নাই। মুখে এক চিলতে হাসির রেখা টেনে বললেন - ' যদি পারো খালি করে দাও, মায়ের আদেশ অবশ্য পালনীয়' । 

অট্টহাসিতে গুহার অভ্যন্তর গমগম করে উঠল। সর্দার বলল - ' এই তোর শেষ কথা?'

- না, কথার কি কোন শেষ থাকে? আমি যথাসময়ে বলব, এখন তুমি মায়ের আদেশ পালন কর' ।

সর্দার বুম বুম করে বন্দুক খালি করে দিল। দেখল তারানাথের দেহ ভূপাতিত। উল্লাসে সকলেই মেতে উঠল। আর তারানাথ মাটিতে শুয়ে মায়ের অশেষ কৃপাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দুইহাত কপালে তুলে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন - জয় মা ।

সর্দার তা' দেখে হাসবে কি কাঁদবে ভেবে পেল না। বন্দুক ভালো মত পরীক্ষা করে দেখল খালি এবং তা' থেকে বারুদের গন্ধ বেরোচ্ছে। অথচ তান্ত্রিক নির্বিকার।

তারানাথ উঠে দাঁড়ালেন। সর্দারের চোখে চোখ রেখে বললেন - 'এতবড় আস্পদ্দা তোর ! এখনও চলে যাস নি? মায়ের আদেশ উল্লঙ্ঘন! জানিস, এর শাস্তি কি?

সর্দার নিজেও মা কালীর ভক্ত। মায়ের আশীর্বাদ না নিয়ে কোন অভিযানে যায় না। আজও আসে নি। তবে এমনটা ঘটল কেন ?

গভীর চিন্তামগ্ন সর্দারকে তারানাথ বললেন- শোন পামর!

সর্দার সম্বোধনে রাগান্বিত হলেও তারানাথের মুখের দিকে চেয়ে কোন কথা বলার সাহস পেল না ।দেখল এক অনির্বচনীয় দিব্যজ্যোতিতে তান্ত্রিকের মুখমণ্ডল দীপ্যমান। তান্ত্রিক যে কোন সামান্য জন নয় , সর্দার ভালোমতই জেনে গেল। হঠাৎ সর্দার তান্ত্রিকের পা জড়িয়ে ক্ষমা ভিক্ষা চাইল।

তারানাথ পুনরায় গর্জন করে বললেন-' তুই এখনও যাস নি। মা তোকে চলে যেতে বলেছেন আর তুই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস ! 

বলে কমণ্ডলু থেকে জল বের করে সর্দারের গায়ে যেই ছিটাতে যাবেন ,সর্দার 'যাচ্ছি' বলে প্রস্থান করতে উদ্যত হল । চোখের সামনে বেরোনোর পথ অথচ যেই বেরিয়ে পড়ে অমনি বারবার ফিরে ফিরে আসে। এ যেন কোন ভুলভুলাইয়া মনে হল তার।

তারানাথ সব দেখছিলেন। আর মৃদুমৃদু হাসছিলেন। বললেন - ওরে মুর্খ! মা তোকে এই স্থান খালি করতে বলেছিলেন; তোর বন্দুক নয়। কিন্তু তুই মায়ের ভক্ত হয়েও সে কথা বুঝলি নে ! তোর মত মাথামোটা আর দুটো নেই। ঐ দেখ তোর সঙ্গীরা তোকে ছেড়ে চলে গেছে। ঐ আয়নাটা দেখছিস? ঐ দেখ, বাইরে মোতায়েন তোর সাথীরাও পালিয়েছে । শুধু তুই ঘুরে ফিরে এখানেই চলে আসছিস। বলি তোর মতলবটা কি?

এবার ডাকাত সর্দার হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। বলল - ঠাকুর তুমি পথ দেখাও।

তারানাথ হাসলেন । মাকে দেখিয়ে বললেন - আমি কোন পথ দেখাব রে ! যা যা মায়ের কাছে যা। মা-ই

তোকে পথ দেখাবেন।

সর্দার অষ্টধাতু নির্মিত মাতৃমূর্তির দিকে এগিয়ে গেল। হাঁটু মুড়ে বসল। মাথা ঠুকে মায়ের পীঠাসন রক্তাক্ত করল। তারপর মাকে প্রণাম করে অজানা উদ্দেশ্যে রওনা দিল ।

গুহার বাইরে বেরোতেই বটতলায় বসে থাকা তান্ত্রিককে দেখে আবার অবাক হল। এ কি দেখছি! এ যে মহাকাল! তার অন্যতম আরাধ্য দেব। সঙ্গে সঙ্গে আবার অচেতন হয়ে গেল। এদিকে প্রভাতী ঊষার প্রথম কিরণে যখন তার ঘুম ভাঙল, ডাকাত সর্দার পুনরায় গুহায় প্রবেশ করতে সচেষ্ট হল । কিন্তু তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোন প্রবেশপথ দেখতে পেল না। 

কিছুক্ষন পর সম্বিৎ ফিরে পেয়ে নদীর চর বরাবর হাঁটা দিল। তীরবর্তী পাথরের স্তূপ থেকে এক ঝাঁক পুলিশ বের হয়ে এল। তারা সর্দারকে গ্রেপ্তার করল।

থানায় নিয়ে যেতে ওকে পিছমোড়া বেঁধে গাড়িতে চাপাতে গেলে তারানাথ সেখানে উপস্থিত হলেন। সমবেত পুলিশ কর্তাকে অনুরোধ করলেন - সর্দার আর ডাকাত সর্দার নয়, ও এখন আপন মনের সর্দারে পরিণত হয়েছে। তোমরা ওকে ছেড়ে দাও। কিন্তু পুলিশকর্তা মানতে চাইল না। ড্রাইভারকে নির্দেশ দিল গাড়ি চালাতে।

তারানাথ আর কোন কথা বলেন নি। শুধু উদাসনেত্রে একবার সর্দারের দিকে চাইলেন। গাড়ি কিছুটা যেয়ে রাস্তায় উঠতেই গতি বেড়ে গেল। তারপরই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তারানাথ গুহায় ফিরে এলেন। কয়েক ঘন্টা অপেক্ষা করার পর পুলিশকর্তা সর্দারকে মুক্তি দিতেই গাড়ি চলতে শুরু করল। সর্দার গাড়ি থেকে নেমে সন্ন্যাসীর উদ্দেশ্যে প্রণাম নিবেদন করে গুহাভিমুখে যাত্রা করল।

(ক্রমশ:)



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Action