সম্মান চাই
সম্মান চাই


"এই দেখ্ দেখ্ বুবস্ যাচ্ছে। সত্যি কি ফিগার মাইরি।নেশা হয়ে যাবে।"
চায়ের দোকানে বসে থাকা একদল ছেলে রিয়া কে উদ্দেশ্য করে মন্তব্য করলো। লজ্জায় রিয়ার কান মাথা গরম হয়ে গেল এই ধরণের নোংরা মন্তব্যে। রিয়া কোনো কথা না বলে চুপচাপ চলে গেল নিজের টিউশন স্যারের বাড়িতে। সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস থাকে ওর। নতুন ভর্তি হয়েছে এই স্যারের কাছে। কিন্তু এক দুদিন পর থেকেই ওকে উদ্দেশ্য করে শুরু হয়েছে এইধরণের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য। এইসব নোংরা মন্তব্যের বিরুদ্ধে কি জবাব দেবে ও। রাত্রি বেলা মাকে বললো,"মা জানো টিউশন স্যারের ওখানে কয়েকটা ছেলে এইভাবে আমাকে বাজে বাজে মন্তব্য করে বিরক্ত করছে কদিন ধরে। আমার খুব খারাপ লাগে মা। আমার ব্রেস্ট টা কি সত্যিই আমার বয়সী অন্য মেয়েদের তুলনায় ভারী একটু"।মা রিয়াকে কাছে টেনে নিয়ে পরম স্নেহে বলে,"শোন্ রিয়া স্তন হলো একটা মেয়ের সৌন্দর্য। তার নারী হবার গর্বিত নিদর্শন। সেটা বড়ো নাকি ছোটো তাই নিয়ে যারা মন্তব্য করে, তাদের মানসিকতাও তাদের মতই নীচ। মায়ের কোলে যে স্তনদুগ্ধ খেয়ে একটা ছেলে বড়ো হয়েছে, সেই ছেলেই যখন তার যৌবন কালে অন্য মেয়েদের স্তন নিয়ে মন্তব্য করে, সেটা সেই মায়ের কাছেও খুব লজ্জার, যার দুধ খেয়ে ছেলেটি বড়ো হয়েছে। তাই এইসব ছোট ছোট কথায় কান দিস না আর। আর ওদের কথার উপেক্ষা করবার পরও যদি ওরা তোকে বিরক্ত করে , তাহলে এটা বলিস ওদের।"এরপর রিয়ার কানে কানে ওর মা বলে দিয়েছিল কি বলতে হবে ওদের পরবর্তী সময়ে।
রিয়াকে ওর মা আরো বলেছিল, আসলে এইধরণের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য আমাদের সব মেয়েদের ই জীবনের কোনো না কোনো সময় শুনতে হয়েছে।কারুর স্তন ছোটো হলেও সেটা নিয়ে ছেলেদের মন্তব্য, আবার একটু ভারী হলেও সেটা নিয়ে মন্তব্য। শরীরের অন্যান্য অঙ্গের মতোই স্তনও নারী শরীরের একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।জামার ওপর দিয়ে সামান্য ক্লিভেজ দেখা গেলে সেটাকে সবসময় লালসার চোখে না দেখে, স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখলেই তো এসব সমস্যা আর হয় না। ছেলেদের বোতাম খোলা শার্টের ভিতরের রোমশ খোলা বুক যদি মনে কোনোরকম কামনার উদ্রেক না করে, কোনো বাজে চিন্তাধারা না নিয়ে আসে, তাহলে একটা মেয়ের জামার উপরের হাল্কা ক্লিভেজ মনে বাজে চিন্তার জন্ম দেবে কেন? সেটা বড়ো নাকি একদম পারফেক্ট সেটা যার জিনিস সে ভাববে। কারুর ব্যক্তিগত জিনিস নিয়ে সমালোচনা করাটা ঠিক কি?
এরপর রিয়াকে তার মা শোনায় এক কাহিনী। আজ থেকে কয়েকশ বছর আগে মেয়েদের তাদের স্তনের জন্যও নাকি কর দিতে হতো।ভারতের কেরালা অঙ্গরাজ্যে ত্রিবাঙ্কুর রাজা নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুদের মধ্যে এক প্রকার শুল্ক বা করের প্রচলন করেছিল। করটির নাম 'স্তনকর'। স্থানীয় ভাষায় যার নাম ছিল 'মুলাক্করম'। নিয়ম ছিলো শুধু ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য কোন হিন্দু নারী তার স্তন ঢেকে রাখতে পারবে না। আর যদি কোনো নারী তার স্তন কে কাপড় দ্বারা ঢেকে রাখতে চাইতো, তবে তাকে তার স্তনের আকারের উপর ভিত্তি করে কর দিতে হতো। এই স্তন শুল্কের বড় অংশ যেত ত্রিবাঙ্কুরের রাজাদের কুলদেবতা পদ্মনাভ মন্দিরে।
শোনা যায় ১৮০৩ সালে এই ব্রাহ্মণ্যবাদী নির্মম প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন আলাপুঝার এঝাওয়া সম্প্রদায়ের নারী নাঙ্গেলি। এই সাহসিনী নারী রাজার ওই নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তার স্তনকে আবৃত করে রাখে।নাঙ্গেলি তার স্তনকে আবৃত করে রাখায়, গ্ৰামের শুল্ক সংগ্ৰাহক, তার কাছ থেকে'মুলাক্করম' বা 'স্তনশুল্ক' দাবি করে। কিন্তু নাঙ্গেলি তা দিতে অস্বীকার করে এবং প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে সে তার স্তন দুটি ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে, কলাপাতায় মুড়ে শুল্ক সংগ্ৰাহকের হাতে তুলে দেয়। শুল্ক সংগ্ৰাহক হতবাক হয়ে যায়। স্তন কেটে ফেলার কিছুক্ষণের মধ্যেই অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে নাঙ্গেলির মৃত্যু হয়। স্ত্রীর মৃত্যু শোকে নাঙ্গেলির স্বামীও আত্মহত্যা করে। এই ঘটনার পর 'স্তনকর' বা 'মুলাক্করম' রদ করা হয়। তবে 'স্তনকর' রদ করা হলেও দক্ষিণ ভারতে নারীদের স্তন আবৃত করার জন্য বহু সংগ্ৰাম করতে হয়েছে। এমনকি বিষয়টি নিয়ে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা পর্যন্ত হয়েছে। ১৮৫৯ সালে দক্ষিণ ভারতে একটি দাঙ্গা সংগঠিত হয়।এই দাঙ্গার উদ্দেশ্য ছিলো নিম্ন বর্ণের হিন্দু নারীদের শরীরের উপরের অংশ আবৃত করার অধিকার আদায় করা।এই দাঙ্গা 'কাপড়ের দাঙ্গা' হিসাবে পরিচিত। সাহসিনী নারী নাঙ্গেলি নিজের জীবনের বিনিময়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল, স্তন আমার,অনাবৃত রাখবো নাকি আবৃত সে নিয়ম করার তুমি কে?
মায়ের কাছে সব ঘটনা জানবার পর রিয়ার মনে এক অদ্ভুত জোর এসে গিয়েছিল। সে ভেবে নিয়েছিল, এরপর আর সে সহ্য করবে না তার স্তন নিয়ে এধরণের নোংরা মন্তব্য। প্রতিবাদ করবে সে।আজ টিউশন ক্লাসে যাবার সময় সে একা ছিল না। সঙ্গে তিতিরও ছিলো। চায়ের দোকানের পাশ দিয়ে যাবার সময় আবার সেই কানমাথা গরম করা লজ্জাজনক মন্তব্য। রিয়া একটুও ভয় না পেয়ে, তিতিরকে বলে "একটু চল্ তো আমার সঙ্গে ওখানে"। তারপর ছেলেগুলোর কাছে গিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করে,"কি বলছিলে তোমরা? আমাদের বুবস্ নেশা ধরিয়ে দেয় তোমাদের চোখে তাই না? তা ভাই তোমার বোনের বা যে মাতৃদুগ্ধ পান করে আজ এতো বড়ো হয়েছো, এইসব নোংরা মন্তব্য করবার যোগ্য হয়েছো, সেই মা আর বোনের বুবস্ টাও কি তোমাদের চোখে অতটাই নেশা ধরিয়ে দেয় নাকি?"
ছেলেগুলো হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে রিয়ার দিকে। তারপর মুখ নীচু করে সরে যায়। আর রিয়া মায়ের কথামতো যোগ্য জবাব দিয়ে গর্বিত বুকে এগিয়ে যায় টিউশন ক্লাসে।
পুরুষ যেদিন নারীকে স্তন,নিতম্ব, উরু এইসব দিয়ে বিচার না করে তার শরীরকে কামনার দৃষ্টিতে না দেখে, সাধারণ ,সাবলীল দৃষ্টিতে দেখবে । নারীর শরীরের , মনের , সর্বোপরি একজন নারীকে তার যোগ্য সম্মান দিতে পারবে , সেদিন প্রত্যেকটি মানুষের মনে সমতার মনোভাব এমনিতেই এসে যাবে। কোনো ধর্ষণের শিকার হতে হবে না কোনো নারীকে, পুরুষ যেদিন তার দিকে লালসার মনোভাব নিয়ে না এগিয়ে এসে, বন্ধুর মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসবে, সেদিনই তো নারী তার পরিপূর্ণ মর্যাদা পাবে।