প্রতাপগড়ের অদ্ভুত কাহিনী
প্রতাপগড়ের অদ্ভুত কাহিনী
কথিত আছে, প্রতাপগড়ের রাজপরিবারের কুলদেবী নাকি খুব জাগ্রত। রাজগৃহের মাঝমধ্যিখানে তৈরী এক মন্দিরের গর্ভগৃহে কুলদেবীর অধিষ্ঠান। কালো কষ্টি পাথরের করালদর্শন সেই দেবীমূর্তিকে দেখলে যে-কারোর মনে সম্ভ্রমের সাথে সাথে ভয়ের সঞ্চার হয়। দু'চোখ থেকে যেন ঠিকরে বেরোচ্ছে জ্যোতি। হাতে উদ্যত খড়্গ। এই কুলদেবী কিন্তু প্রতাপগড়ের রাজবংশকে কয়েকশত বছর ধরে সবরকম বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে আসছেন। বাইরের দেশের আক্রমণ হোক বা প্রজাদের বিদ্রোহ, কোনো ক্ষতিই স্পর্শ করতে পারে না রাজপরিবারকে। এমনটাই বিশ্বাস করে প্রতাপগড়ের সব মানুষ। রাজপরিবারের মঙ্গলার্থে সদাসর্বদা সবদিকে কড়া নজর জাগ্রত কুলদেবীর। অবশ্য তার জন্য একটি চরম মূল্য দিতে হয় রাজপরিবারকে।
বহু প্রজন্ম আগে রাজা সূর্যপ্রতাপ এইখানে প্রতাপগড় রাজ্য স্থাপন করেন। পাহাড় ও জঙ্গলে ঘেরা এই ছোট্ট রাজ্য, তখন থেকেই সম্পূর্ণ স্বাধীন। কুলদেবীর এই বিগ্রহও তারই প্রতিষ্ঠিত। আর শুরু থেকেই মর্মান্তিক একটি নিয়ম এই বংশে চলে আসছে। কালের অমোঘ বিধিই হয়তো বা। রাজবংশে যখনই নতুন কোনো বংশধর জন্ম নেয়, কুলদেবী তার পরিবর্তে রাজপরিবারেরই একটি প্রাণ আগে কেড়ে নেন। কোনো ব্যতিক্রম হয় না এই নিয়মের। এই তো ছোট রাজপুত্র চন্দনপ্রতাপ যেদিন জন্মালো, তার আগেরদিনই রোগশয্যায় থাকা পিতামহ দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিং মারা গেলেন। হয়তো তিনি ফিরে এলেন অন্যরূপে। আবার তার জন্মের সময়ও শোনা যায় তারই বৃদ্ধ পিতামহ আদিত্যপ্রতাপ সিং রাজপ্রাসাদের ছাদ থেকে পড়ে মারা গিয়েছিলেন। রাজা বীরেন্দ্রপ্রতাপের জন্ম ও তার এক কাকা বিশম্ভ্রপ্রতাপ সিং এর মৃত্যুও হয় একইদিনে। এখনের বড় রাজপুত্র চন্দ্রপ্রতাপের জন্মের ঠিক আগে তারই এক সৎ ভাই মারা গিয়েছিলেন। তদানীন্তনকাল ধরে এই নিয়ম চলে আসছে। লোকে বলে, পুরাতন প্রাণ চলে গিয়ে আবার নতুন হয়ে জন্ম নেয়। কে জানে।
এখানে নতুন সন্তানের আনন্দধ্বনির সাথেই মিশে থাকে করুণ এক সুর। কোনো নবজাতকের আগমনের পূর্বে আরেকটা কোনো প্রাণ কেড়ে নেন কুলদেবী। তখন বিগ্রহের কালো মুখে কীসের যেন এক আভা দেখা যায়। ঠোঁটে যেন লেগে থাকে অদ্ভুত এক টুকরো হাসি। সন্তুষ্ট হন তিনি। দেশে এরপর দুর্ভিক্ষ হয় না, মড়ক লাগে না। ব্যবসা-বাণিজ্য ফুলে ফেঁপে ওঠে, আরো প্রতাপ-প্রতিপত্তি বাড়ে রাজবংশের। সাড়ে তিনশো বছরেরও বেশী পুরাতন এই রাজবংশ সাড়ম্বরে টিঁকে আছে শুধু এই কুলদেবীরই কৃপায়।
**************************************************
এইভাবেই দিন পার হয়।
বড় রাজপুত্র চন্দ্রপ্রতাপের বিয়ে হলো অতি ধুমধাম করে পাশের রাজ্যের সুন্দরী রাজকন্যা অনামিকার সাথে। এক সপ্তাহ ধরে বহু লোক পংক্তিভোজনে খাওয়া-দাওয়া করলো রাজবাড়ীর বারমহলে। কালক্রমে একদিন চন্দ্রপ্রতাপ রাজসিংহাসনেও বসলেন। রাজা বীরেন্দ্রপ্রতাপ অবসর নিলেন। চন্দ্রপ্রতাপ রাজা হয়ে প্রতাপগড়ের নাম আরও উজ্জ্বল করলেন। দেশ-বিদেশে সওদাগরির অনেক বাড়বৃদ্ধি হলো। প্রজারা খুবই সুখে দিন কাটাতে থাকলো। তারা সর্বদা রাজার গুণগান করে।
কয়েক বছর পর একবার রাণী অনামিকা সন্তানসম্ভবা হলেন। খুশির জোয়ার বয়ে গেলো চারদিকে। নতুন রাজপুত্র আসবে। বীরেন্দ্রপ্রতাপ নিজের নাতির মুখ দেখবার আনন্দে সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের ছুটি ঘোষণা করে দিলেন। দিকে দিকে তখন আবার উৎসবের মেজাজ।
কিন্তু সব আনন্দের মধ্যেও বরাবরের মতোই একটা উৎকণ্ঠা, একটা আশংকা রয়েছে সবার মনের মধ্যে। যত দিন ঘনিয়ে আসতে থাকলো, ততোই সেই প্রশ্নচিহ্ন ক্রমশ দানা বাঁধতে থাকলো রাজপরিবারে। আর শুধু রাজপরিবারেই বা বলি কেন, পথেঘাটে সর্বত্র শুরু হয়ে গেলো ফিসফাস। সকলের মনে একটাই জিজ্ঞাস্য - এবার কে ? এবার কার যাবার পালা ?
এদিকে রাজবৈদ্যকে নিজের ঘরে একদিন ডেকে পাঠালেন চন্দ্রপ্রতাপের মা রাণী রূপমতী।
**************************************************
"আজ্ঞে ডেকেছিলেন রাণীমা ?"
"হ্যাঁ। বৈদ্য, আপনি তো জানেন আমাদের বংশের রীতি।"
"হ্যাঁ মা, জানি। আমাদের পরিবার বংশপরম্পরায় আপনাদেরই তো সেবা করে এসেছে রাণীমা। আমি সব জানি।"
"তবু, কোনো অন্যথা যাতে না হয়, তার জন্য আরো একবার আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।"
"বলুন রাণীমা।"
"প্রতাপবংশে আজ অবধি কোনো রাজকুমারী আসেনি। রাজকুমারী আসবে না। এই বংশে শুধু রাজপুত্রই জন্মায়। রাজপুত্রই দিনের আলোর মুখ দেখতে পায়। বুঝেছেন ?"
"নিশ্চয়ই রাণীমা।"
"সময় থাকতে থাকতে নির্মূল করে দেবেন যদি সেরক
ম কোনো সম্ভাবনা থাকে তো। বাইরের মানুষ যেন জানে, সন্তান এসেছিলো, কিন্তু বাঁচেনি।"
"আপনার আদেশ শিরোধার্য থাকবে।"
"আমি আপনার সামনে হাত জোড় করছি বৈদ্য, এটা আমাদের রাজপরিবারের সম্মান ও ঐতিহ্যের প্রশ্ন। কোনো ভুল না হয় দেখবেন।"
"ভুল হবে না রাণীমা।"
**************************************************
যথাসময়ে রাণী অনামিকাকে আঁতুড়ঘরে পাঠানো হলো। তার সঙ্গে থাকলেন রাজবৈদ্য ও আরো সহকারীরা। বেশীদিন আর বাকি নেই নতুন রাজপুত্র আসতে। রাজপুরোহিত বিশালাকার এক যজ্ঞের আয়োজন করলেন পরিবারের সবার মঙ্গলার্থে। সে এক রাজসূয় ব্যাপার।
পূর্বনির্ধারিত সময়ে রাণী অনামিকার প্রসববেদনা শুরু হলো। তখনই গর্ভমন্দিরে পুজো দিয়ে এলেন রাজপুরোহিত। কুলদেবীর দুটো বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে নিবেদন করলেন। রক্ষা করুন তিনি সবাইকে, এই প্রার্থনা। এই যে কারুর আসার সময় হলো, এখন তো কারুর বিদায় নেবারও পালা। এখনও কোনো দুঃসংবাদ আসেনি, কারুর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু বিধির বিধান, কাউকে তো যেতে হবেই। কালের এই অমোঘ নিয়ম কেউ খন্ডাতে তো পারে না। আনন্দ-দুঃখের এক অদ্ভুত মিলনে আপ্লুত সকলে রাজগৃহে অপেক্ষা করতে থাকলেন আঁতুরঘর থেকে শুভ সংবাদ আসার। কিন্তু সেখানে এক বিস্ময় তাদের জন্য সেদিন অপেক্ষা করছিলো।
সন্তান ভূমিষ্ট তো হলো। কিন্তু কেউ হাসলো না। কেউ জয়ধ্বনি করলো না। শুষ্কমুখে নবজাতককে কোলে নিয়ে রাজগৃহে প্রবেশ করলেন রাজবৈদ্য। রাজা চন্দ্রপ্রতাপ তাকে দেখেই প্রশ্ন করলেন, "কী ব্যাপার বৈদ্য চূড়ামণি, আপনি ম্রিয়মান কেন ? রাজপুত্র কি স্বাভাবিক নয় ? কোনো খুঁত আছে ?"
বৈদ্য দুঃখ-ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জানালেন, "শোকসংবাদ রাজাধিরাজ। আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি কালাচিনি খাইয়ে ঠিকই চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। আমার হাতেই জন্ম হলো এই বংশের প্রথম রাজকুমারীর।"
কথাটা যেন বজ্রের মতো ছিটকে পড়লো, আঘাত করলো উপস্থিত সকলকে। এরকম ঘোর পাপের জন্য কেউ প্রস্তুত ছিলো না। সব আয়োজন বৃথা। সব আনন্দ রসাতলে। থমথমে গম্ভীর মুখ রাজার। কপালে হাত দিয়ে বসে পড়লেন রাণীমা। ভেঙে পড়া কণ্ঠস্বরে শুধু বললেন, "এ আপনি কী করলেন বৈদ্য ? এ কী সর্বনাশ করলেন ?"
"আমাকে ক্ষমা করবেন রাণীমা। কালাচিনি খেয়ে কেউ দু'দন্ড বাঁচে না। এই রাজকুমারী হয়তো অমর শক্তির অধিকারী হয়ে এসেছে। তার বড়ো দুটো চোখের দিকে তাকিয়ে, বিশ্বাস করুন আমি আর সাহস পাইনি মারতে।"
এই বলে তিনি এগিয়ে এসে অপেক্ষারত রাজপুরোহিতের হাতে তুলে দিলেন শিশুটিকে। "আপনি এখন যেটা ভালো বোঝেন করুন ঋষিদেব। আমি আজই হয়তো শয্যা নেবো।"
দু'হাতে শিশুকন্যাটিকে নিয়ে এক পলক দেখলেন রাজপুরোহিত। ঠিক সেইরকম টানা টানা উজ্জ্বল দুটো চোখ। এই চোখ তিনি কোথায় যেন দেখেছেন। একটু সময় অপেক্ষা করে তিনি সদ্যজাত রাজকুমারীকে নিয়ে গর্ভগৃহে চললেন কুলদেবীর পায়ে ছোঁয়াবেন বলে।
এই বংশের রীতি, নবজাতককে সবার প্রথমে কুলদেবীর চরণস্পর্শ করানো হয়। সেই কুলদেবীর আশীর্বাদ নিতেই চললেন রাজপুরোহিত। কী করা উচিৎ না উচিৎ তা কারুর মাথাতেই আসছিলো না। সকলে একটা বিহবল অবস্থার মধ্যেই রাজপুরোহিতকে অনুসরণ করলো।
সব দুঃখের মধ্যেও একটা খুশির ব্যাপার এই যে, কারুর মৃত্যুর খবর আসেনি এখনো। রাজপরিবারের সবাই এখানেই আছে। সুস্থ ও সবল।
**************************************************
গর্ভগৃহের দরজা খোলা হলো। বাকি সবাইকে বাইরেই দাঁড়াতে বলে রাজকুমারীকে কোলে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন রাজবৈদ্য। বিগ্রহের দিকে এক নজর তাকিয়েই নিজের অনুমান সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হলেন তিনি। সত্যিই অভাবনীয় ব্যাপার, অভূতপূর্ব। মুখ ভরে উঠলো তার হাসিতে। বাইরে অপেক্ষারত সকলকে এবার তিনি ডাকলেন ভিতরে।
গর্ভগৃহে পা দিয়েই চমকে উঠলেন সবাই। কষ্টি পাথরের মূর্তি একদিকে কাত হয়ে আছে। চোখ দুটো যেন আধবোজা। হাতের খড়্গ নামানো। অতন্দ্র প্রহরীর সেই মূর্তি আজ যেন শুধুই একটা শিলাপাথর। যেন এই বিগ্রহে আর প্রাণ নেই। মৃত্যু হয়েছে কুলদেবীর।
এবার সকলের দিকে ফিরে রাজকুমারীকে উঁচু করে চাগিয়ে ধরলেন রাজপুরোহিত। বললেন, "কুলদেবী চলে যাননি, তিনি শরীর বদল করে এসেছেন।"
এক মুহূর্তের নীরবতা। তারপরই তুমুল হর্ষধ্বনি ও সম্বর্ধনার মধ্যে রাজকুমারীর কপালে একটা চুমো দিলেন রাজপুরোহিত। আর তুলে দিলেন তাকে রাণী রূপমতীর কোলে। রাণীমার চোখের কোণে তখন আনন্দাশ্রু চিকচিক করছে।
~ সমাপ্ত