গোয়েন্দা ( ধারাবাহিক)
গোয়েন্দা ( ধারাবাহিক)
পর্ব চার
সূর্য্যকিরণ চৌধুরীর পিতামহ স্বর্গীয় অরুণকিরণ চৌধুরী মহাশয় অতিশয় সদাশয় ব্যক্তি ছিলেন । হাতিবাগানের অনতিদূরে গোয়াবাগানে ছিল তাঁর বিশাল পাইকারি দ্রব্যাদির প্রতিষ্ঠান । বাৎসরিক উপার্জন কোটি টাকারও বেশী । মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর এই প্রতিষ্ঠানটি একমাত্র পুত্র তপনকিরণের নামে উইল করে দিয়েছিলেন । শর্ত হিসাবে একটি কথাই লিখেছিলেন তাঁর যাবার পর যেন তাঁর ধর্মপত্নী অর্থাৎ তপনকিরণের মাতা ঠাকুরাণীর জীবন এবং মরণোত্তর সর্বৈব লৌকিক এবং পারলৌকিক ক্রিয়া সুসম্পন্ন না করলে এই উইল বাতিল বলে গণ্য হবে এবং সেই অবস্থায় স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি তাঁর নির্মিত ট্রাস্টিবোর্ডের অধীনে চলে যাবে ।
তপনকিরণের সঙ্গে ট্রাস্টিবোর্ডের সদস্যদের প্রথম দিকে সুসম্পর্কই ছিল । সূর্য্যকিরণের উত্থানের পর তা' একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে । সূর্য্যকিরণের পিতামহী তথা তপনকিরণের মাতাদেবী দৌহিত্রের দৌরাত্ম্যে অতীষ্ঠ হয়ে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে মনস্থির করলেন । ট্রাস্টিবোর্ডের চেয়ারম্যান একে অনৈতিক এবং বেআইনি বিচার করে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের করলেন । আদালত আপাতত যতদিন না মামলার নিষ্পত্তি হয় ততদিন পর্য্যন্ত স্টেটাস কিও মেনটেইন করতে নির্দেশ দিয়েছেন ।
ঐ'রূপ পরিস্থিতিতে সূর্য্যকিরণ হঠাৎ করে ঈশিকাকে বিয়ে করে তাকে ঘরে তোলে । পিতামহী অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে গৃহত্যাগ করেন এবং বৈদিক ভিলেজে নিজস্ব কুটির ক্রয় করে তথায় বসবাস শুরু করেন ।
তপনকিরণ এবং তাঁর সহধর্মিণী অনুপ্রভা দেবী ছেলেকে এমন কর্ম থেকে বিরত করতে না পেরে সুর্য্যকিরণকে ত্যাজ্য ঘোষণা করলে সুর্য্যকিরণও আদালতের দ্বারস্থ হয় । বর্তমানে তপনকিরণের ' ন যযৌ ন তস্থৌ' দশা । যদিও তিনি সপত্নী পিত্রালয়েই থেকে গেছেন ।
এদিকে সুর্য্যকিরণ ঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে সেই ক্লাবে আশ্রয় নিয়েছে। ঈশিকার পিতামাতা মেয়েকে ফিরিয়ে এনেছেন স্রেফ এই অচলাবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য । মেয়ের প্রতি তাঁদের বাৎসল্য হেতু মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেননি । ঈশিকা বর্তমানে একপ্রকার বন্দী জীবন যাপন করছে ।
সূর্য্যকিরণ দিনের বেলায় ডক্টর বৈশ্বানরের শরীরে অবস্থান করে এবং ক্লাবে রাত্রি যাপন করে । বন্ধুবর্গ এ ব্যাপারে তাকে কোন প্রশ্ন করার পূর্বেই তৈরি থাকা কোন জবরদস্ত জবাব দিয়ে সকলের মুখ বন্ধ করে রাখে।
কাটায় কাঁটায় সকাল দশটায় আদালত বসেছে। বাদী বিবাদী পক্ষের উকিল পরস্পরের সঙ্গে খানিক আলোচনা করছেন । একটি বিষয়ে উভয়পক্ষ একমত হয়েছেন যে ডক্টর বৈশ্বানরের মত স্বনামধন্য ডাক্তার এরূপ জঘন্য কর্ম করবেন না । কিন্তু সরকারি উকিল যেহেতু বেতনভূক তাঁকে ওকালতির বিধিনিয়ম মেনে চলতেই হয় । ঠিক সাড়ে দশটা নাগাদ অপ্রকৃতিস্থ বৈশ্বানরকে নিয়ে প্রিজন ভ্যান আদালতে প্রবেশ করল।
ডক্টর সৃঞ্জয় বসুও এসেছেন । তার কিছুক্ষণ পরে একটি পুলিশের গাড়িতে ঈশিকাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তদন্তকারী পুলিশ অফিসার করালীপ্রসাদ সেনশর্মা ।
ডক্টর সৃঞ্জয় বসু ঈশিকাকে এক নজর দেখে নিলেন।করালীপ্রসাদ সেনশর্মা বললেন - ডক্টরসাহেব আপনার কথামত আদালতের অনুমতি নিয়ে অভিযোগকারিণীকে এনেছি। আপনি যদি মনে করেন ওনার সাথে কথা বলতে পারেন ।
- এখন কিছু বলব না অফিসার । আদালত বসুক । জজসাহেবের অনুমতি নিয়ে তাঁরই সম্মুখে দু'চারটে প্রশ্ন করব । আপনি এখনই আমার পরিচয় ওকে দেবেন না। দিস ইজ মাই আর্নেস্ট রিকোয়েস্ট প্লীজ ।
করালীপ্রসাদ বললেন - যেমন ইচ্ছা হয় আপনার ।
ডক্টর সৃঞ্জয় বসু ডক্টর বৈশ্বানর মুখোপাধ্যায়ের উকিলের সঙ্গে আলোচনা করে নিলেন । নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন - আপনি শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের এপ্রুভাল নিয়ে নেবেন; বাকি আমি ম্যানেজ করব ।
ব্যারিস্টার প্রতাপ ভদ্র বললেন - ধরে নিন, অনুমতি পেয়ে গেছেন স্যার ।
এগারোটা বেজে দশে বিচারক আসন গ্রহন করলেন ।
সরকার পক্ষের উকিল সব্যসাচী দত্ত ডক্টর বৈশ্বানরকে প্রশ্ন করলেন - আচ্ছা বলুন তো ! গন্তব্যে পৌঁছে ইপনি যখন ট্রেন থেকে নেমে যাচ্ছেন তখন সেখানে আর কে ছিলেন ?
প্রতিবাদ করলেন ডক্টর বৈশ্বানরের ব্যারিস্টার মি' প্রতাপ ভদ্র ।
- অবজেকশন মি লর্ড ! প্রথমদিনই এই প্রশ্ন করা হয়েছে । দেখতেই পাচ্ছেন স্যার, আমার মক্কেল এখনও অপ্রকৃতিস্থ । তবে যদি অনুমতি করেন আমি আপনাকে পরামর্শ দেব একজন প্রখ্যাত মনোবিদের উপদেশ শুনতে। আমার মক্কেল যে হাসপাতালে ভর্তি আছেন সেখানকার স্বনামধন্য মনোবিদ ডক্টর সৃঞ্জয় বসু এসেছেন। তিনিই তাঁর চিকিৎসা করছেন । আদালতকে তাঁর কিছু বলবার আছে ; যদি অনুমতি করেন ---
বিচারক বললেন - অবশ্যই বলবেন ; তবে তাঁকে কাঠগড়ায় এসে দাঁড়াতে হবে ।
ডক্টর সৃঞ্জয় বসু সাইকোলজিস্ট জীবনে প্রথমবার কাঠগড়ায় এসে দাঁড়ালেন; তবে অবশ্যই আসামী বা সাক্ষী হিসাবে নয় । একজন মনোবিশেষজ্ঞ রূপে ।
তিনি বিচারকের উদ্দেশ্যে বললেন - মাননীয় বিচারক মহাশয়, আমি একজন মনোবিজ্ঞানী। দুর্ভাগ্যবশত ডক্টর বৈশ্বানর মুখোপাধ্যায় ; যিনি এই মুহুর্তে আইনের চক্ষে একজন অভিযুক্ত আসামী, আমি তাঁর চিকিৎসক। আমি যে হাসপাতালে প্র্যাক্টিস করি ডক্টর মুখোপাধ্যায়ও সেই হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান । বয়সে প্রবীণ এই ডাক্তারের একমাত্র ধ্যানজ্ঞান পেশেন্টের চিকিৎসা । অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় আজ তিনি নিজেই পেশেন্ট । আমি সর্বক্ষণ তাঁর পরিচর্য্যায় নিয়োজিত রয়েছি। একটা জিনিস আমি খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করেছি যে দিনের বেলায় তাঁর মধ্যে এক সুপারনেচারাল প্রবৃত্তি কাজ করে যা তাঁকে দেখে মনে হয় তিনি কোন মানসিক সমস্যায় ভুগছেন । অথচ আশ্চর্য্যের বিষয় হল ঠিক সন্ধ্যে সাড়ে ছ'টা নাগাদ তাঁর পূর্ব চৈতন্য ফিরে আসে । তিনি তাঁর পেশেন্টদের খোঁজ খবর করেন । এমনকি সংশ্লিষ্ট ডাক্তারবাবু রোগীটিকে বর্তমানে কোন কোন ওষুধ প্রয়োগ করছেন - সেগুলো ঠিক কি না সে বিষয়ে উক্ত ডাক্তারবাবুকে পরামর্শ দেন । এমনকি ভিজিটেও যেতে চান । কিন্তু অনুমতি না থাকায় তা' আর করতে পারেন না । তখন তিনি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আচরণ করেন । আবার সকাল বেলা থেকে কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে থাকেন । মাঝে মাঝে ভ্যাম্পা ভ্যাম্পা বলে জান হারিয়ে ফেলেন ।
স্যার এই ভ্যাম্পা কথাটির অর্থ যদি ভ্যাম্পায়ারকে নির্দেশ করে তবে আমার একটি আর্জি আছে; চিকিৎসা জগতে এর প্রতিকার কবে নাগাদ হবে তা' তো বলা যায় না। সুতরাং আমার ইচ্ছে তাঁকে যদি কোন তন্ত্রশাস্ত্র অনুযায়ী চিকিৎসা করা যায়; আমি নিশ্চিত তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন ।
বিচারক প্রশ্ন করলেন - বর্তমান আধুনিক সভ্যতায় আপনার এই বিশ্বাস কতখানি গ্রহনযোগ্য ?
ডক্টর সৃঞ্জয় বসু উত্তরে বললেন - সাইকোলজির সব রকমের অধীত বিদ্যা প্রয়োগ করে দেখেছি স্যার; কিছুটা পরিবর্তন এলেও পরবর্তী সময়ে পুনরায় সেই পূর্বেকার দশায় ফিরে যান । অথচ আশ্চর্য্য এই যে রাতভর তিনি স্বাভাবিক আচরণ করেন । এখন ওনার দিকে চেয়ে দেখুন স্যার কেমন নেতিয়ে পড়েথেন ! আপনার বযস্ততার মধ্যেও যদি একটু সময় বের করে হাসপাতালে আসেন বা আপনার প্রতিনিধি হিসাবে কাউকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন আমি এটা নিশ্চিতরূপে প্রমাণ করে দেব ।
বিচারক বললেন - ভেবে দেখব । কিন্তু সে তো তাঁর নির্দোষিতা প্রমাণ করবে না !
ডক্টর সৃঞ্জয় বসু বললেন - তা' ঠিক । কিন্তু স্বাভাবিক থাকার সময় তিনি এ বিষয়ে অর্থাৎ হাওড়া স্টেশনে নামবার সময়কার যে ঘটনা বলেছেন তা' আমি একটি কাগজে লিখে এনেছি । যদি অনুমতি দেন তো সেটি আপনার নিকট জমা দিতে চাই।
বিচারক তাঁর কাছ থেকে কাগজটি নিলেন এবং পাঠ করতে শুরু করলেন ।
ডক্টর সৃঞ্জয় বসু বললেন - মাননীয় স্যার, পুলিশের অনুমতি নিয়ে আমি অভিযোগকারিণী ঈশিকা সামন্তকে এই আদালতে হাজির করিয়েছি। যদি অনুমতি দেন দু'একটি কথা তাঁকে জিজ্ঞাসা করি।
বিচারক অনুমতি দিলেন । সরকার পক্ষের উকিল বাধা দিলে বিচারক ' অবজেকশন ওভাররুলড' বলে তাঁকে থামিয়ে দিলেন ।
( চলবে )
