বিবাহ ― বিপদ বাড়ানো হলো
বিবাহ ― বিপদ বাড়ানো হলো


ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিবাহের ক্ষেত্রে ছেলে আর মেয়ের মিলনের চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ হল দুই পরিবারের মিলন, আর সেই মিলন যে শুধু মন মিলে গেলে বা বেয়াই-বেয়াই কোলাকুলি করলেই হয়ে যায় না তার দৃষ্টান্ত দেখেননি এমন মানুষ আশা করি তেমন নেই। ভালোবেসে বিয়ে করা আর বিয়ে করে ভালোবাসা ব্যাপারটা হল গিয়ে অনেকটা আখ খাওয়ার মতো; আপনার দাঁত শক্ত হলে আপনি কামড়ে খেয়ে নিন আর নয়তো মেশিনে ঢুকিয়ে পেষাই করে আপনাকে গ্লাসে করে সাজিয়ে ছেঁকে পুদিনার রস দিয়ে খাওয়ানো হবে। হ্যাঁ, তবে রস পান করাটা আবশ্যিক। বর্তমানে এই বিশ্বায়নের যুগে বিবাহের ধরণ-ধারণেও বেশ বৈচিত্র্য এসেছে কিন্তু এর মধ্যেও কিছু রীতিনীতি সামাজিকতার ছদ্মবেশে আমাদের সংস্কৃতিতে জাঁকিয়ে বসে আছে। আমার তো মাঝেমধ্যে মনে হয় এই দেশে একটা বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠান করা প্রায় একটা আন্দোলনের সমান; আর যদি ঘটনাচক্রে পাত্র কিম্বা পাত্রী কোনো একটি পক্ষে বৈপ্লবিক চিন্তাধারা দেখা দেয় বেশ তবে তো ষোলোকলাপূর্ণ।
তবে আজকের এই ইঁদুরদৌড়ের জীবনে মানুষ ধর্ণা বিবাহ, আকস্মিক বিবাহ এসবের আবিষ্কারও করে ফেলেছেন। হয়তো শুনতে প্রাথমিকভাবে একটু হাস্যকর হলেও দিনের শেষে মন্দ নয়; ধরুন দুটি মানুষের সুখের চেয়ে বড়ো আর কি হতে পারে। আগেকার দিনে তো ছেলে মেয়ে একেবারে শুভদৃষ্টির সময় একে অপরের মুখদর্শন করত, এরপর পছন্দ-অপছন্দ বলে কোনো দ্বন্দ্ব মনে ভাবাও পাপ। লাভ ম্যারেজ একেবারে হত না বললে ভুল তবে সংখ্যা টা বোধহয় সেনসাস্ দেখে বলে দেওয়া যেতে পারে। প্রাশ্চাত্য দেশের মতো এ দেশেও এই ভালোবেসে বিয়ে করার প্রচলন দিনদিন বাড়ছে ঠিকই তবে এখনও ঘটা করে পাত্রী দেখতে যাওয়ার মধ্যে একটা বেশ রোমাঞ্চ লক্ষ্য করা যায়। একটা পাত্রী দেখে
আসার পর শুরু হল বাড়িতে চুলচেরা বিশ্লেষণ; মাথা চওড়া, মুখটা ভালো না, ভ্রু গুলো জোড়া ইত্যাদি নানান তথ্য সমৃদ্ধ ঘন্টার পর ঘন্টার আলোচনা চলতে লাগল কোনো কমার্শিয়াল বিরতি ছাড়াই, সঙ্গে রইল পরিবারের মাথা, পা, ধড় সকলেই।
আবার আরেকদিন বিকেলের ভুরিভোজ সারা হল আরেক ঠিকানায় তবে এরা আরেক ধাপ এগোলেও বাঁধ সাধল দেনা-পাওনা। দেনা-পাওনা কে শুদ্ধ ভাষায় নাম দাও পণপ্রথা আর তারপর ছেলেমেয়েরা লিখে ফেলে দশ নম্বরের রচনা, ব্যস্ ঐ পর্যন্তই। ঘুণধরা জানলার পাল্লায় আলকাতরা দিয়ে প্রাইমার দিলে হয়তো একটু টিকতে পারে তবে, এই ঘুণধরা সমাজের চেহারা পাল্টাতে কোনো কীটনাশকই যথাযথ নয়। সমাজের ক্যান্সারের সত্যিই কি আছে কোনো অ্যান্সার? ছেলের বাড়ির পণ নেওয়া যেমন অপরাধ তেমনি কিন্তু দেওয়া টাও অপরাধ। তবে এসব শুনতে-পড়তে বেশ জমে, বাস্তবের ভেতরে সবটাই ঘুণধরা সমাজ। পড়াশোনার একটা প্রলেপ চেপেছে বটে, তবে তা ঐ অধিকরণ কারকের মতোই স্থান-কাল-পাত্র ভেদে উবে যায় 'আগামী দিনে মেয়েটা ভালো থাকবে'-র লৌকিকতার আড়ালে। বেশ এভাবে পাত্রী পরিক্রমা শেষে আরও পাঁচ-দশ ঘর ঘুরেফিরে দর কষাকষি করে একখানা বিবাহ স্থির হল, আর কার্ডে জ্বলজ্বল করতে লাগল, 'ঋষি প্রজাপতির ইচ্ছায়'; এদিকে শুয়োপোকারাও কনফিউজড অবস্থায় সজনে গাছে ঝুলতে লাগল।
সাতকান্ড, না না সতেরোকান্ড রামায়ণ শেষে আশীর্বাদে চারচাকা হাতিয়ে টোপর পরে ছাদনাতলায় বসে অগ্নি সাক্ষী রেখে হাজার টা লোককে পাতপেড়ে খাইয়ে বর-বৌ বলছে, 'যদিদং হৃদয়ং তব/ তদিদং হৃদয়ং মম' অর্থাৎ দাঁড়াল 'তোমার হৃদয় আমার হোক, আমার হৃদয় তোমার'। মনের ভেতর একটাই কথা তিড়িং তিড়িং করে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে দুজনেরই, 'পিকচার আভি বাকি হে মেরে দোস্ত'। 😊😊