Akash Karmakar

Horror Tragedy Crime

3  

Akash Karmakar

Horror Tragedy Crime

পুনর্মিলন

পুনর্মিলন

10 mins
288


-" কত হলো দাদা?"

-"চল্লিশ টাকা"

পকেট থেকে পঞ্চাশের একটা নোট সামনের অটোটার দিকে বাড়িয়ে রীতেশ বল্লো -" এই নিন দাদা; ফেরত লাগবে না আর"। 

স্বচ্ছল পরিবারের একমাত্র ছেলে হওয়ায় টাকা পয়সার হিসেব যে সে ছোট থেকে কোনোকালেই রাখেনি সে আর বলার অপেক্ষা রাখেনা; তার উপর আজ তো এমনিতেই একটা মন ভালোর দিন। পনেরো বছর আগের ফেলে আসা কলেজ আস্ত একটা মেমোরি লেন; যার প্রতিটা আনাচেকানাচে রয়েছে প্রকাশিত-অপ্রকাশিত ভালোবাসা-মন্দবাসার অনুভূতিদের পাহাড়। আজ আবার সেখানে ফিরে আসা, পুরানো মুখেদের মাঝে নতুন করে খুঁজে নেওয়া আরেকবার নিজেকে। আজকের বৃষ্টি শুধু শরীর ভেজায় না; ফিরিয়ে দেয় সাবালক হয়ে দুনিয়া কাঁপানোর তৃপ্তি-জেদ-আগ্রাসন। কলেজের রিইউনিয়ন মানেই একগুচ্ছ নস্টালজিয়া, সমস্ত বন্ধনের ঊর্ধ্বে লেখা এক আকাশ মুক্তি। 


রীতেশ পা বাড়ালো তাদের কমিউনিটি হলের দিকে, মনে পড়ছে ফ্রেশার্সের দিন সিনিয়রদের দেওয়া সেই অচেনা-অজানাদের প্রপোজালের টাস্ক্– উফফ বাপ্রে! পরবর্তী কালে সিনিয়র হয়ে সেই চিরন্তন প্রথাকে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার সেসব দিন মনে করে নিজের মনেই হাসতে থাকে সে। রুমের দরজা খুলতেই একঝাঁক আবেগ আছড়ে পড়ল, জাপটে ধরল নিখাদ হাতগুলো। হাসিঠাট্টার জমজমাট এই আসরে গমগম করছে হলটা। 

অবশেষে ধূসর বিকেল গড়িয়ে রঙীন সন্ধ্যা ডাক দিল–শুরু হলো বন্ধুত্বের সেলিব্রেশন! কলেজের পেছনে দিকের মাঠটা থেকে ডি জে'র আলোয় মাতোয়ারা ক্যাম্পাস। একের পর এক বোতলের ছিপি খোলার সাথে সাথেই স্যাম্পেন আর মদের ফোয়ারায় ভিজছে গলা-ভিজছে দেহ-ভিজছে দেওয়াল-ভিজছে হৃদয়। ইতিমধ্যে রীতেশও বেশ কয়েক পেগ এক টানেই শেষ করে ফেলেছে। 

-"বুঝলি এইজন্যই স্পেশালি ছুটি নিয়ে এখানে চলে আসা", হঠাৎ বলে উঠলো সুমন্ত। 

হাতের গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রীতেশ বল্লো -"এই আমাকেই দেখ না, আজ তো আমি মেডিক্যাল লিভে আছি; না বল্লে কি জানতে পারতিস? হা হা হা" , এই বলে ঠোঁটের কোণে একটা সিগারেট কামড়ে হাসতে হাসতে কলেজের ছাদে উঠে আসে। অন্ধকার ছাদের আশেপাশে বেশ কয়েকটা গুল্ম, পড়ে থাকা নানাধরনের জিনিসপত্র কিন্তু চারিপাশটা বেশ গুমোট, বাতাসের লেশমাত্র নেই, গাছগুলোও যেনো নিঝুম নিস্তেজ হয়ে দাঁড়িয়ে। নিজের খেয়ালেই বিড়বিড় করতে থাকে রীতেশ, "এই কলেজটা বেশ পুরোনো, এই ছাদেও কেউ আসে বলে তো মনে হচ্ছে না, মেরামতের অভাবে একপাশটা ভাঙতে শুরু করেছে, আসলে আমাদের বেলায় কেই বা এসব... কে? কে ওখানে?" একমুহূর্তের জন্য রীতেশের হৃৎপিন্ডটা স্তব্ধ হয়ে এলো। ছাদের কার্নিশ ঘেষা দেওয়াল থেকে একটা ছায়ামূর্তি হঠাৎ যেনো দূরের অন্ধকারে মিশে গেলো। রীতেশ এগোতে গিয়েও এগোতে পারলো না, কেউ যেনো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে, নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে। অনেক কষ্টে ওখান থেকেই চেঁচিয়ে ডাক দিলো সুমন্তকে। তার চিৎকার শুনতে পেয়ে সবাই দৌড়ে উঠে এলো ছাদে। রীতেশ অসাড়-স্তব্ধ, তাকে নিয়ে বসানো হলো একটা টেবিলের কাছে। সকলেই তার কথা হেসেই উড়িয়ে দিলো; সুমন্ত বল্লো সে নাকি নেশায় পড়ে হ্যালুসিনেট করছে; তাই হবে হয়তো! একটু ধাতস্থ হয়ে টেবিল রাখা গ্লাসটা রীতেশ আবার হাতে তুলতেই সঙ্গে সঙ্গে শিরদাঁড়া বরাবর আবার একটা হিমশীতল স্রোতে তার সর্বাঙ্গ অসাড় হয়ে এলো! গ্লাসের মুখে একজোড়া রক্তাক্ত ঠোঁটের ছাপ। এত কাছে সে! কে! আবারও চিৎকার করে উঠলো সে, কিন্তু আশ্চর্য সেই দাগ তো আর কেউ দেখতেই পেলোনা! আবারও সবাই তাকে হ্যালুসিনেশনের সায়েন্স পড়িয়ে সান্ত্বনা দিতে লাগলো। কিন্তু রীতেশের মনে একটা গুমোট মেঘ যেনো দলা পাকিয়ে গেছে; একটা অজানা ভয়ে যেনো তার সমস্ত শরীরটা এক নিমেষে উত্তেজনাশূন্য হয়ে পড়েছে। সে নির্বাক, নিস্তব্ধ, নিস্তেজ। তার বলার মতন অনেক কিছু আছে, তবে শোনার মতন কেউই নেই। সেই রাতে রীতেশকে একা ছাড়েনি সুমন্ত। তাকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসেছে সে। 


রিইউনিয়নের আজ দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে, রীতেশের মনে আজও অনেক প্রশ্নের ঝড়, তারা শান্ত হয় না। বারবার ঢেউয়ের ঝাপট আছড়ে পড়ে তার চারপাশে। সে উত্তর খুঁজছে অনেক প্রশ্নের, কিন্তু প্রশ্নটাই তো অজানা। অযাচিতভাবে কেউ যেনো প্রতিমুহূর্তে তার উপর নজরদারি করেই চলেছে। কলেজের রিইউনিয়ন থেকে ফেরার পর সবসময় একপ্রকারের মানসিক অস্থিরতায় জর্জরিত সে। হাবেভাবেও বেশ কিছু পরিবর্তন লক্ষণীয়। যে রীতেশকে সর্বদা খুব উচ্ছ্বসিত দেখাত যে কোনো বিষয়ে, সে যেনো এখন অনেকটাই নিস্তেজ। আয়নায় নিজেকে দেখলেই কেমন যেনো একটা অপরাধবোধ তাকে গিলতে আসছে; আবার এমনই এক মানসিক যন্ত্রণা যা সে না পারছে কারোর সাথে আলোচনা করতে আর না পারছে কারোর কাছে বলতে সেই কলেজের সব ঘটনা। তবে এটাও ঠিক যে, যতদিন যাচ্ছে তত যেনো সে বেশী করে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করছে। তাহলে যদি সেদিনের ছায়াটা সত্যিই হয়ে থাকে, তাহলে সে কে? আর সে শুধু রীতেশকেই কেনো দেখা দিল? রীতেশের সাথে তার কি সম্পর্ক? তারা কি পূর্ব পরিচিত? হাজারো প্রশ্নের ঝড় বারংবার আঘাত হানছে তার হৃদকুঠুরিতে।

এদিকে তার সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। একটা চাপা মানসিকতার মাঝে বাড়িতে এরকম খুশির খবরের হাওয়ায় মনটা যেনো বেশ ফুরফুরে লাগছে অনেকদিন পর, তবে শান্ত হতে পারছে না কিছুতেই। এরই মধ্যে আবার অফিস থেকে বসের এমার্জেন্সী ফোন, সাত তাড়াতাড়ি পৌঁছালো অফিসে। পনেরো দিন ধরে পড়ে থাকা অসম্পূর্ণ প্রজেক্টের জন্য কি কি অজুহাত দেওয়া যেতে পারে ভাবতে ভাবতে এসে পৌঁছালো রীতেশ। কিন্তু এখানে তো সব উল্টো! 'মে আই কামিন স্যার?' বলে ঢুকতেই বস তো একেবারে জড়িয়ে ধরল তাকে। এতদিন ধরে পড়ে থাকা প্রজেক্টের জন্য রীতেশ যে কাল সারারাত নিজের কেবিনে বসে কাজ করেছে তারজন্য এই সামান্য প্রশংসা তো সত্যিই প্রাপ্য তার। "ব্র্যাভো রীতেশ, তুমি তো অসাধারণ কাজ করেছ। নিজের কাজের প্রতি এরকম ডেডিকেশন থাকলে তুমি অনেকদূর অব্দি এগোবে অবশ্যই", এই বলেই তাকে তার প্রমোশনের জন্য আগাম শুভেচ্ছাও জানালেন তিনি। গল্পের শুরু এখান থেকেই, মনের মধ্যে চলতে থাকা সীমাহীন প্রশ্নের তালিকা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে যার চাপে রীতেশ তলিয়ে যাচ্ছে সাগরের অতলে। যে রীতেশ কাল তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে গেছল স্ত্রীয়ের এতো ভালো খবর শুনে সে কিভাবে রাত জেগে কাজ করল? তাও আবার নিজের কেবিনে? খানিকটা ভয় মিশ্রিত হাসি নিয়েই সে বলে বসল "স্যার আপনি কি করে জানলেন যে কাল আমি বাড়ি না গিয়ে এখানে ছিলাম বলে?", এটা তো তাকে জানতেই হবে। "তুমি কি ভাবছ আমি কিছুই খোঁজ রাখি না। আজ সকালে ঢুকতেই গেটের গার্ড তো বলল কাল সারারাত তোমার কেবিনের আলো জ্বলছিল। যদিও আমি খুব একটা অন্যের কথায় বিশ্বাস করি না। কিন্তু যখন সিসিটিভির ফুটেজেও তোমাকে দেখতে পেলাম আমি তো অবাক হয়ে গেলাম। সত্যিই রীতেশ, তোমার মতন এত দায়িত্বশীল এমপ্লয়ী থাকলে আমাদের কখনোই আর কাজের সমস্যা হবে না।" "হ্যাঁ স্যার, আসছি" বলে বেরিয়েই রীতেশ পুরো অসাড় হয়ে পড়ল। সমস্ত স্নায়ু একেবারে নিস্তেজ নির্বিকার হয়ে পড়েছে। রিইউনিয়নের দিন সবাই তাকে হ্যালুসিনেশনের গল্প বলেছিল; কিন্তু আজ? বস যা শোনালেন তা তো আর হ্যালুসিনেশন নয়, তাহলে? সে এরপর দৌড়ে গেল নিজের চোখে একবার সিসিটিভি ফুটেজ দেখবে বলে। বসের কাছ থেকে কোনোক্রমে অনুমতি আদায় করে সে গেল সিস্টেম অপারেটিং রুমে। গতরাতের নিজের কেবিনের ফুটেজ দেখতে গিয়ে আরেকবার থমকে দাঁড়াল সে। কৈ, কোথাও তো কিছু নেই, চেয়ার ফাঁকা কিন্তু তাহলে বস যে বললেন! নাহ্ সত্যি মিথ্যা কাউকে বোঝানোর বা বলার মতন পরিস্থিতিতে সে নেই। চুপচাপ সেখান থেকে ঘাম মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো সে। প্রমোশনের জন্য সে আনন্দ করবে নাকি তার সাথে ঘটে চলা বিগতদিনের সব ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা খুঁজবে? সবাই ভুল দেখছে আর সে ঠিক? নাকি উল্টোটা? সে যা দেখছে বা তাকে দেখানো হচ্ছে সবই কি তাহলে অনাবৃত সত্যি?  


    বাড়ি ফিরে এসে আরও অস্থির হয়ে পড়ল রীতেশ কিন্তু এই অস্থিরতা জাহির করা যাবে না। বন্ধুদেরকে ফোন করলেও লাভ হবে না, এটা সে ভালোই বুঝে গেছে। আর সত্যি বলতে এখনকার যুগে দাঁড়িয়ে কেই বা তার এই ভৌতিক কাহিনীর বাস্তবিকতা নিয়ে মাথা ঘামাবে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সে ফোন করল সুমন্তকে। সেদিনের পর আর সেভাবে যোগাযোগ করা হয়নি তার সাথে। সুমন্তর সাথে কথা বলতে বলতে রীতেশ হঠাৎ করেই তাকে বলে বসল, "আচ্ছা শোন না, পার্টির যে ছবিগুলো তোর কাছে আছে আমাকে পাঠাস তো জলদি।" কেন জানে না, কিন্তু ঐ ছবিগুলো খুব দরকার রীতেশের। তার নিজের কাছে যা ছবি আছে নতুন পুরানো তার সাথে সেগুলোকে মিলিয়ে দেখতে লাগল, কিছু একটা মিসিং আছে। চোখের সামনেই আছে কিন্তু নজরের বাইরে। বারবার দেখার পরেও কোনোকিছু বুঝতে না পেরে সব ড্রয়ারে ঢুকিয়ে শুয়ে পড়ল সেদিন রাতে। 


     আজ সকাল থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। অন্তরের এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে একটু স্বস্তির খোঁজে সে আজ একাই বেরিয়ে পড়ল নতুন গাড়ি নিয়ে লং ড্রাইভে। একটু আগেই এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। রাস্তার পাশের গাছপালা সব সবুজ হয়ে আছে। রাস্তায় ধুলো উড়ছে না, একটা বেশ শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ যেখানে হয়তো কোনো ঝড় নেই। সত্যিই কি নেই? ঝড় থেমে গেল! নাকি এটা আরও কোনো বড়ো ঝড় আসার আগের ধীরস্থির আবহাওয়া? ধীরগতিতে গাড়ি এগিয়ে চলেছিল উদ্দেশ্যহীন যাত্রাপথে; হঠাৎ বেশ কিছুক্ষণ ধরে সে অনুভব করে তার জামার কলারের কাছে কে যেনো একটা গভীরে নিঃশ্বাস ফেলছে! কিন্তু এই পরিতৃপ্তির নিঃশ্বাস তার খুব চেনা! 


   জোরে একটা ব্রেক কষে পেছনের সিটে তাকায়, কিন্তু কৈ! নিঃশ্বাসটা এখন যেনো আরো স্পষ্ট, আরো তীব্র। নাকে ভেসে আসছে খুব চেনা একটা পারফিউমের গন্ধ, কিন্তু কার হতে পারে? ঠিক তো, এই গন্ধটাই তো সেদিন যখন রীতেশ কলেজের গেটে পা রেখেছিল সাথে সাথে অনুভব করেছিল কিন্তু তখন হৈ-হুল্লোড়ে আর এবিষয়ে খেয়াল করেনি সে। এক মুহূর্তের জন্য যেনো ঘড়ির কাঁটা আটকে গেছে। স্টিয়ারিং হাতে, এক্সেলেরটরে পা তবুও এগোচ্ছে না গাড়ি; তার হৃৎস্পন্দন এবার যেনো কানের পর্দায় ধাক্কা দিতে লাগল। প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হলেও সেদিনের সন্ধ্যার ছাদের ঘুমোট পরিবেশটা অনুভব করল আবার রীতেশ। আচমকাই তার মনে পড়ল তাদের পুরানো বাড়ির কথা, যে বাড়িতে আজ দীর্ঘদিন যাতায়াত নেই তবুও কেমন যেনো সেদিকেই টানতে লাগল মনটা। মনে হল ওখানে যেতে হবে, হয়তো ছাদের থেকে শুরু করে এখনকার সব প্রশ্নের উত্তর সেখানেই মিলবে। আর সময় নষ্ট না করে গাড়ি ঘুরিয়ে রওনা হয় তাদের পুরোনো বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়িটা শহর থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে, এসে থামল গাড়ি। এদিকে যে বিশেষ আসা হয় না সে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। চারদিকটা আগাছায় ভর্তি, রঙ কি ছিল তা বলা কঠিন, অধিকাংশ ইঁট যেনো হাত নেড়ে ডাকছে। এই অর্ধভগ্ন বাড়িটাকে টিকিয়ে রেখেছে পুরোনো কেয়ারটেকার দাদু। রীতেশ তড়িঘড়ি করে চাবি নিয়ে তার নিজের রুমটাতে ঢুকলো, বাপ-ঠাকুরদার আমলের আলমারি থেকে বার করলো একটা ডায়েরি – তনুর দেওয়া লাস্ট গিফ্ট!

ডায়েরিটা রীতেশ আজ অবধি কখনো পড়েনি, হয়তো বা পড়ার ইচ্ছেও করেনি কিংবা হয়তো ডায়েরিটা উল্টানোর সাহস জোগাতে পারেনি নিজেকে। অচেনা অজানা এক উপহার! তনু বলেছিল আমার অনুপস্থিতিতে একবার হলেও পড়ো। আজ হতে চলেছে তারই উদ্বোধন, শুভ! ডায়েরিটা নিয়ে সোজা সে ফিরে এলো তার বর্তমান ঠিকানায়।


পেটে খিদে থাকলেও খাবারগুলো গলার নীচে নামছেই না। সে অপেক্ষা করতে লাগল সবার ঘুমিয়ে পড়ার। রাত সোয়া একটা। রীতেশ ডায়েরির পাতা ওল্টাতে শুরু ক‍রল―

-"কি পরিচয় দেবো নিজের, বলতে পারো? কলেজের সবথেকে গরীব দরিদ্র ছাত্রী তনুরুচি? নাকি রীতেশ সেনের প্রেমিকা! আমি যখন ভাঙা টিনের চালের ঘরে শুয়ে আগামীর স্বপ্ন দেখি সেই স্বপ্ন তোমার সাতমহলা বাড়ির একটা প্রাচীরও জানতে পারেনা! হয়তো তুমি জানো; হ্যাঁ জানো বোধহয়! এই তোমাদের জাঁকজমকপূর্ণ দুনিয়ায় তুমি কি আমাকেই পেয়েছিলে বোকা বানানোর জন্য? আমার বেঁচে থাকার সব স্বপ্নগুলোকে এক লহমায় শেষ করে দিলে! অস্বীকার করলে প্রতিটা ছোঁয়াকে যা শুধু আমার শরীর চিনেছিল! জানো তো আমার আজও খুব মনে পড়ে আমাদের সেই সময়গুলো, উষ্ণতার প্রতিটা রাত, হয়তো বা অভিশপ্ত রাত! এখনো আমার বুকের ওড়নায় লেগে আছে তোমার গায়ের গন্ধ, বুক জুড়ে তোমার প্রতিটা ঠোঁটের আঘাত..."


     রীতেশ চোখ বুজে ডায়েরিটা বন্ধ করে দেয়। চোখের সামনে শুরু হয় অতীতের ঝলকানি তবে চিৎকার করা বারণ। সহ্য করতেই হবে নীরবে প্রতিটা যন্ত্রণার আঁচড়। সে যে একজন খুনী। সে তারপর আবার পাতাগুলো উল্টাতে থাকে আর একটার পর একটা অসমাপ্ত অধ্যায় শেষ করতে থাকে। ক্রমশঃ আত্মগ্লানির আগুনে ঝলসে যেতে থাকে তার সমস্ত শরীরটা। মনে পড়ে তনু সেদিন তার কাছে হাতজোড় করে বলেছিল, রীতেশ তাকে বিয়ে না করলে সে আর সত্যিই বাচঁবে না আর তাদের সন্তানও! আত্মদম্ভে পরিপূর্ণ রীতেশ তাকে তার শয্যাসঙ্গী করেছিল ঠিকই কিন্তু জীবনসঙ্গী করতে চায়নি। মুখ ফিরিয়ে চলে আসার পর আত্মহত্যার খবরও এসেছিল ঠিকই তবে নিঃসঙ্কোচে সে এড়িয়ে গেছল সেদিনের তার সকল দায়িত্বকে। 


    মাঝরাতেই গাড়ি নিয়ে সে রওনা দিল কলেজের উদ্দেশ্যে। রাত আড়াইটার জনমানবহীন ফাঁকা অন্ধকার রাস্তাটাও আজ তাকে আর ভয় দেখাতে পারলো না। ফেলে আসা পুরোনো দিনগুলো যেনো কাঁটার মতো বিধঁছে তাকে প্রতিটা মুহূর্তে। আগাপাশতলা কিছুই না ভেবে সে পেছনের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে কোনোক্রমে উত্তর পশ্চিমের কমিউনিটি হলের ছাদে। ভাঙা কার্নিশে দাঁড়িয়ে রীতেশ। হ্যাঁ, ঠিক এইখান থেকেই তনুর দেহটা স্পর্শ করেছিল মাটি, তারপর আর কখনো উঠে দাঁড়ায় নি সে – এক মা ও তার সন্তানের অন্তিম যাত্রা সূচনার কান্ডারী ছিল সেদিন রীতেশ। সারারাত বারবার তাকে ডেকে চলেছে রীতেশ; আজ গোটা ছাদটাকে যেনো একটা অমাবস্যার নিকষ কালো গ্রাস করে নিয়েছে। আজকের রাত শুধু অশ্রুসিক্ত নয়নে নিজের পাপবোধে পুড়ে যাওয়ার রাত, এই রাত তার অনুশোচনার, এই রাত তার ক্ষমা চাওয়ার রাত, এই রাত তার মুক্তির রাত। তবে ভালোবাসার মানুষের অপরাধকে ক্ষমা না করার মতন দৃঢ় মানসিকতা তনুরুচির কোনোকালেই ছিল না, আজও নেই। রাত পেরিয়ে ভোরের আলো ফোটার লগ্ন উপস্থিত তবুও কেউ তো এলো না আর। কিন্তু ইন্দ্রিয়ের ঐপারে তখন ঘটে চলেছে অনেক কিছুই যা কল্পনাতীত, যা বিজ্ঞানের ঊর্ধ্বে। তনুরুচি চেয়েছিল রীতেশের হাতেই লেখা হোক্ তার মুক্তি – সে প্রেমে না হোক্, বেঁচে থাকুক অন্তিম স্পর্শে। সে একাধারে মুক্তি নিয়ে, আর অন্যদিকে মুক্তি দিয়ে পাড়ি দিল সাতসমুদ্র তেরো নদীর পারে। ছাদেই কখন যে রীতেশ নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছিল কে জানে।


     সম্বিত ফেরে স্ত্রীর ফোনে...

-"হ্যালো, কোথায় তুমি?"

-"হ্যাঁ, এই একটু হঠাৎ অফিস আসতে হয়েছিল, এমার্জেন্সী প্রজেক্টের জন্য। ফিরছি এখনই।"

-" হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি এসো। এইমাত্র তোমার এক পুরানো কলেজের বান্ধবী এসেছিলো আমাকে অভিনন্দন জানাতে, একটা ফুলের তোড়াও রেখে গেছে..."

-" আমার বান্ধবী! কে বলোতো? "

- "নামটা কি যেনো বলল; হ্যাঁ মনে পড়েছে, তনুরুচি মিত্র। হ্যালো! শুনতে পাচ্ছ? কখন আসছ তুমি?"


দিনের আলোতেও কালোমেঘের ঘনঘটা বুকের মধ্যে চেপে রেখে নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলো রীতেশ। রিইউনিয়নে শেষ পর্যন্ত দেখাটা সবার সাথেই হয়ে গেল। 





  


    



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Horror