STORYMIRROR

Akash Karmakar

Tragedy Classics Others

3  

Akash Karmakar

Tragedy Classics Others

পোস্টমর্টেম নয়

পোস্টমর্টেম নয়

5 mins
175


অচেনাকে চেনার, অজানাকে জানার এবং অদেখাকে দেখার ইচ্ছে মানুষের জন্ম-জন্মান্তরের; কিন্তু আমরা চাইলেই যে সবসময় সবটা জানতে পারিনা আজকের গল্পটা তেমনই। আমার মতে, এঁনার চেয়ে হতভাগ্য প্রধানমন্ত্রী কেন, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বেরও জন্ম হয়নি বোধহয়। যাইহোক আর ভণিতা না করে ঘটনায় চলে আসি―


সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫

ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধের এক চরমলগ্নে আমরা পৌঁছে গেছলাম। বরাবরের মতনই সীমান্তপার হতে গুলিবর্ষণ শুরু হলেও আমাদের ভারতীয় সেনারা দক্ষতার সাথে, সাহসিকতার সাথে সেই লড়াইকে যে শুধু দমন করতে পেরেছিল তাই নয়, লাহোর পর্যন্ত অ্যাটাক করার পুরোপুরি সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিল। ইতিমধ্যে United Nations এবং আমেরিকা এগিয়ে আসে মধ্যস্থতা করতে এবং যুদ্ধতে বিরাম দেওয়ার জন্যে। এইরকম পরিস্থিতিতে মূলত UN এর তাগিদেই ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৬৫ সালে ভারত এবং পাকিস্তান দুই দেশ যুদ্ধের ময়দান থেকে সরেও আসে এবং শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত করতে সহমত পোষণ করে। 


১০ ই জানুয়ারি, ১৯৬৬

ভারতবর্ষের দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি মহম্মদ আয়ুব খান উপস্থিত হন তৎকালীন USSR এর অন্তর্গত উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে। সমস্ত নিয়মকানুন মেনে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে বিকেল চারটে নাগাদ ভারতের শাস্ত্রীজি এবং পাকিস্তানের আয়ুব খান সাহাব দুজনেই শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। যেহেতু সেই মুহূর্তে ভারত যথেষ্ট শক্তিশালী জায়গায় অবস্থান করছিল যুদ্ধের নিরিখে তাই এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করা রাজনৈতিক দিক থেকে কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে শাস্ত্রীজির মনে প্রথম থেকেই একটা আশঙ্কা কাজ করছিল তবুও তিনি ইউনাইটেড নেশনসের কথা মতো এই চুক্তিকে গ্রহণ করেন। এরপর আসা যাক্ আমার এই লেখার শিরোনামের সার্থকতা খোঁজার নিরিখে- 


লাল বাহাদুর শাস্ত্রীজির সাথে তাসখন্দ সফরে সঙ্গী ছিলেন ওনার ব্যক্তিগত সচিব জগন্নাথ সহায়, একজন ওনার খানসামা রামনাথ, একজন চিকিৎসক ডা. আর এন চুক এবং প্রেস সচিব হিসেবে গেছলেন তৎকালীন ভারতবর্ষের অন্যতম জার্নালিস্ট কুলদীপ নায়ার। এইনামগুলির গুরুত্ব কতখানি তা ঘটনাপ্রবাহে আমাদের সামনে নিজস্ব আঙ্গিকেই ফুটে উঠবে। এবং তৎকালীন রাশিয়াতে ভারতীয় দূতাবাসে নিযুক্ত ছিলেন টি এন কৌল। সাধারণত ঐ রামনাথ ব্যক্তিটিই শাস্ত্রীজি বাইরে গেলে ওনার সাথে যেতেন, ওনার দেখাশোনা করতেন, এমনকি ওনাকে রান্নাও করে দিতেন। কিন্তু আমরা যেদিনের কথা এখানে আলোচনা করতে চলেছি ঐদিনের খাবার কিন্তু এসেছিল অন্য জায়গা হতে এবং তা ছিল টি এন কৌলের নিজস্ব শেফ জান মহম্মদের কাছ থেকে। অর্থাৎ ভারতীয় দূতাবাস হতে সেদিনের খাবার এসে পৌঁছেছিল শাস্ত্রীজির কাছে এবং তা রান্না করেছিলেন জান মহম্মদ। রাশিয়াতে যে রুমে শাস্ত্রীজির থাকার ব্যবস্থা করেছিল সেখানকার সরকার, সেই ঘরটিও ছিল বেশ অদ্ভুত। একজন দেশের প্রধানমন্ত্রীর রুমে না ছিল কোনো ফোন, কোন বেল আর না কোনো ইন্টারকম; অর্থাৎ কোনো সমস্যা হলে বাইরে কাউকে ডাকার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। এবং ওনার সাথে যারা যারা গেছলেন প্রত্যেকের রুম এক জায়গাতে থাকলেও তাদের মধ্যে দূরত্ব ছিল বেশ ভালোই। কেন বা কি কারণে বা কার কথাতে এরকম থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল তার উত্তর জানা নেই। এবার সেই রাতে জান মহম্মদের তৈরী খাবার শাস্ত্রীজি গ্রহণ করেন, তার কিছু সময় পর অভ্যাসবশত দুধ খান এবং তারপর শুয়ে পড়েন। রাত একটা নাগাদ হঠাৎ ওনার কাশি শুরু হয়, এবার যেহেতু ঘরে কোনো ব্যবস্থা ছিল না তাই বাধ্য হয়ে তিনি জগন্নাথ সহায়ের কাছে পৌঁছান এবং তাকে

বলেন ডাক্তার ডাকতে। জগন্নাথ বাবু শাস্ত্রীজিকে নিজের রুমে নিয়ে আসেন, জল খাওয়ান, শুতে বলেন এবং শাস্ত্রীজিও নিজের বুকে হাত রেখে শুয়ে পড়েন। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই ডা. চুক সেখানে পৌঁছান এবং শাস্ত্রীজিকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। 


তদন্ত শুরু হয়, মাঠে নেমে পড়ে KGB, রাশিয়ার সবচেয়ে বড়ো তদন্ত সংস্থা। তাদের প্রাথমিক ধারণাতে উঠে আসে শাস্ত্রীজিকে বিষ দেওয়ার কথা যদিও তার সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না সেই মুহূর্তে। ডা. চুক ততক্ষণে কিন্তু নিজের হার্ট অ্যাটাকের থিওরিতে শীলমোহর দিয়ে দিয়েছেন এবং আপনাদের অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি আজ অর্থাৎ এই ২০২০ সালেও শাস্ত্রীজির মৃত্যুর নথি বলতে এই কাগজটিই একমাত্র সম্বল। আসা যাক্ একটু সেই ঘরটির বর্ণনাতে। শাস্ত্রীজির চটি-বিছানা সমস্ত কিছুই ঠিকঠাক থাকলেও যা ঠিক ছিল না তা হল একটি থার্মাস, এটি কিন্তু ওনার ব্যক্তিগত সম্পত্তির মধ্যেই পড়ে। পরবর্তী সময়ে শাস্ত্রীজির রাশিয়ায় ফেলে আসা সমস্ত জিনিসপত্র ওনার পরিবারকে ফিরিয়ে দেওয়া হলেও এই থার্মোস কিন্তু এই মুহূর্তেও কোথায় আছে আমরা কেউই বলতে পারব না; এবং সেই রাতে ঐ থার্মাসটি টেবিলে পড়েছিল, যেটা দেখে মনে হয়েছিল যে হয়তো উনি জল খাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কোনো কারণে তা এতটাই শক্ত করে লাগানো ছিল যা আর খোলা সম্ভব হয়নি। শাস্ত্রীজির শরীরের উপরের অংশ পুরোপুরি নীল হয়ে গেছল এবং তার মাঝেমাঝে কিছু সাদা দাগ দেখা দিয়েছিল, সেরকমই একটা সাদা দাগ ওনার কপালের বাম চোখের উপরেও মিলেছিল। যদিও ওনার কোনোদিন কোনো সার্জারি হয়নি তবুও মৃত্যু পরবর্তী সময়ে ওনার পেটের কাছে দুটো কাট মার্কস পাওয়া যায় যা কোথা থেকে এসেছিল বলতে আমরা সবাই অপারগ। পরবর্তী সময়ে যখন ভারতবর্ষের মাটিতে ওনার পার্থিব শরীর আনা হয় তখন ওনার স্ত্রী ললিতা শাস্ত্রী অনেকবার তদন্তের কথা জানালেও তা কার্যনির্বাহী প্রধানমন্ত্রী গুলজারি লাল নন্দা কানে তোলেন নি। পরবর্তী সময়ে যখন ইন্দিরা গান্ধী আসন গ্রহণ করেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনিও আর শাস্ত্রীজির মৃত্যুর তদন্তের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন নি। 


আমেরিকার সাথে শাস্ত্রীজির সম্পর্কের বিষয়ে বলা যেতে পারে তা কখনোই খুব একটা মধুর ছিল না, কারণ প্রথমদিকে তো যুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকার পাকিস্তানকে সাপোর্ট করা এবং ভারতবর্ষের পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষাকে ক্রমাগত বিরোধ করে যাওয়া। এবং শাস্ত্রীজির মৃত্যু প্রসঙ্গে CIA এর ডিরেক্টর রবার্ট ক্রয়েডলির মৃত্যুর পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত একটি আলাপচারিতায় স্বীকার করে নেওয়া যে শাস্ত্রীজির মৃত্যুর জন্য দায়ী আমেরিকায়; যদিও এই ইন্টারভিউটিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি কারণ এভাবে কখনোই কোনো দেশের তদন্তকারী সংস্থা নিজেদের গোপন তথ্যকে বাইরে প্রকাশ করতে পারে না। এবং সেই জান মুহম্মদ যিনি সেই রাতের রান্না করেছিলেন এবং মৃত্যু পরবর্তী সময়ে সবার আগে যাকে জেরার মুখে পড়তে হয়েছিল তাকেই পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল। 


যে কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যুর তদন্তের যা প্রথম ধাপ তা হল ময়নাতদন্ত; একজন দেশের প্রধানমন্ত্রী অন্য এক দেশে গিয়ে মারা গেলেন হঠাৎ করেই তবুও না সেই দেশে আর না ফিরে আসার পর তার নিজের দেশে কোথাতেও একবারের জন্যও ময়নাতদন্ত করা হল না, চুপচাপ দাহ করে দেওয়া হল। কিন্তু ঐ যে বলে কথাতেই আছে তুমি চলে যাবে কিন্তু কীর্তি রয়ে যাবে; আর তাই আজ লাল বাহাদুর শাস্ত্রীজির জন্মদিনে সশ্রদ্ধ প্রণাম জ্ঞাপন করি এবং বলি আপনার দেওয়া সেদিনের শ্লোগান আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, 

'জয় জওয়ান, জয় কিষাণ'। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy