মৃন্ময়ী
মৃন্ময়ী
পুকুর থেকে স্নান সেরে উঠে আসছেন সত্তরোর্ধ্ব গ্রামের একজন ঠাকুমা। সূর্য তখনও পশ্চিম আকাশে পাড়ি দিতে ঘন্টাখানেক দেরী। সারাদিনের কাজ সেরে নিশ্চিত হয়ে স্নান সেরে ফিরছেন তিনি গাঁয়ের মেঠো পথ ধরে। চলতে চলতে হঠাৎ চোখে পড়ে যায় দূরে বটের তলায় বসে থাকা একটি বাচ্চামেয়েকে; পরনে একেবারেই ময়লাটে একটা ছেঁড়াফাটা পোষাক, অঝোরে কাঁদছে সে। ঠাকুমা এগিয়ে গেলেন তার কাছে,
- কি হে বাছা, তুমি কে? কোথা থেকে এয়েচ? অমন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদছই বা কেনে?
ঠাকুমার প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই হঠাৎ যেনো একটা হিমশীতল হাওয়া স্পর্শ করল। ঠাকুমা এগোতে গিয়ে হঠাৎ মাটিতে পড়ে গেলেন। তিনি বলতে চাইছেন কথা কিন্তু শব্দেরা যেনো আটকে পড়ছে গলার কাছে এসে। ধীরে ধীরে সেই মেয়েটি তার কান্না মুছে উঠে দাঁড়াল। ঠাকুমার দিকে বাড়িয়ে দিল হাত, ঠাকুমা উঠে দাঁড়ালেন। হাত ধরে বাচ্চাটি নিয়ে আসতে লাগল ঠাকুমাকে সেই গাঁয়ের পথেই। কিছুটা এসে ডানদিকের গলি ধরে সোজা চলে এলো একটা ছোট্ট টালির ঘরে।
- শোনো বুড়ী, আজ থেকে তুমি এই ঘরেই থেকো। তুমি তো রোজ স্বামীর ভিটেতে থাকবে বলো, তাই না? আমি সব জানি। এই জমির যিনি মালিক তিনিই তো তোমার স্বামী ছিলেন, তু
মি তো তার প্রথম স্ত্রী। এখন অবশ্যি তোমার স্বামী আর তার দ্বিতীয় স্ত্রী দুজনেই ফিরে গেছেন ঈশ্বরের দরবারে, আর তারা নিঃসন্তান হওয়ায় তোমার থাকতে কোনো সমস্যা নেই। আমি তোমাকে তোমার ভালোবাসার কাছে রেখে গেলাম, তোমার ছেলেপুলেরাও খুব শীঘ্রই এখানে চলে আসবে। আর তুমি এখানেই থেকো, আমি দেখতে আসব কিন্তু। এখন আসি, তবে।
- তুমি কে গো? তুমি তো দেখছি আমার সব খবর জানো।
- আমি, আমি তোমার নাতনি মৃন্ময়ী। তোমার অধিকারটা দিয়ে গেলাম তোমায়। কোনো অসুবিধা হলে একবার মৃন্ময়ী বলে ডেকো। আমি আবার আসব।
পরদিন সকালে ঠাকুমার নিথর দেহটা পুকুরপাড়েই পড়েছিল; ঠাকুমার বাল্যবান্ধবী মৃন্ময়ী দেখতে সুন্দর ছিল বলে ঠাকুমা তাকে চোখের সামনে ডুবতে দেখেও হাতটা বাড়িয়ে দেয়নি সেদিন। 'সরলা হাতটা দে' বললেও সেদিন সরলা হাতটা বাড়িয়ে দেয়নি ইচ্ছা করেই, একটু একটু করে মৃন্ময়ীর মৃত্যুকে দেখেছিল কেবল। আজ এতবছর পরে যখন সেই মৃন্ময়ী বৃদ্ধা সরলার সামনে এসে ধরা দিল দৃষ্টি ঝাপসা হওয়ার দরুণ তাকে কার্যত চিনতেই পারল না। মানুষ পাপ করে ভুলে গেলেও বয়সের ভারে, পাপ মানুষকে ভুলতে পারে না কখনোই কোনোভাবেই। আচ্ছা ঠাকুমা কী তাহলে সেই বিকেলে আদৌও গাঁয়ের পথে এসেছিল?