রাখীর স্মৃতি
রাখীর স্মৃতি
আজ রাখীবন্ধন উৎসব। ভাইবোনের সম্পর্ককে আরেকধাপ দৃঢ়তার পথে এগিয়ে দেয় রাখী। সাধারণত দিদি বা বোনেরা ভাই বা দাদাদের হাতে রাখী পরানোর চল থাকলেও বর্তমানে সেই ধারা ভেঙে আজকাল দিদি বোনেদের মধ্যেও রাখীবন্ধন সমারোহের সাথে পালিত হয়। আজকের এই রাখীপূর্ণিমার পুণ্য তিথিতে আমি ইতিহাসের কচকচানির মধ্যে না গিয়ে আমার জীবনে এই রাখীর গুরুত্ব কতখানি সেসব নিয়ে কিছু কথা বলব গল্পের ছলে।
আমি আমার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ায় নিজের দিদি বোন না থাকার আক্ষেপ যে কখনোই ছিল না তা বললে ভুল বলা হবে। তবে একদম ছোটবেলা থেকে আমি জানতাম দিদার কাছেই রাখী পরতে হয়, কারণ আমার জ্ঞান হওয়ার পর থেকে প্রতিবছর দেখতাম দিদা দুপুরে আমাদের বাড়ী আসত একমাত্র নাতিকে রাখী পরাবে বলে। সকালবেলায় মামাবাড়ির সামনের মন্দিরে পুজো দিয়ে আমার জন্য প্রসাদ নিয়ে, রাখী নিয়ে আমাদের বাড়ি আসত। দাদু যতদিন বেঁচে ছিলেন দিদাকে ব্যাগ গুছিয়ে দিতেন যত্ন করে। আগে রাখীর দিন স্কুল ছুটি না থাকলেও দিদা আসার আনন্দে আমার সকাল থেকেই মনটা চঞ্চল হয়ে থাকত যে কখন দিদা আসবে আর আমাকে আদর করে রাখী পরিয়ে দেবে। এখন দিদার বয়স হয়েছে, ঠিকমতো হাঁটতে পারে না তাই আমাদের বাড়ী আসার সেই প্রথাও ভেঙে গেছে। আমিই বরং সময় করে চেষ্টা করি যাতে আজকের দিনটা দিদার কাছে যেতে পারি। আমার দিদা যেমন নিয়ম করে প্রতিবছর আসত, আমি তা পারি না। যেতে না পারলে দুঃখ তো হয়ই, তখন ভাইফোঁটাতে দিদা নাতি দুজনেই পুষিয়ে নিই মনের সকল ইচ্ছে।
আমি যখন ক্লাস থ্রী বা ফোরে পড়ি তখন আমাদের প্রতিবেশী হয়ে আসেন যারা তাদের এক ছোট্ট পুচকি মেয়ে ছিল, নাম খুশী। যতদিন এগোতে থাকে, দৃঢ় হতে থাকে দুই পরিবারের মধ্যে সম্পর্কের বাঁধন। ধীরে ধীরে আমি হয়ে গেলাম ঐ কাকু কাকিমার 'কেনা ছেলে' আর খুশী হয়ে উঠল আমাদের 'কেনা মেয়ে'; বেশ আমি জীবনে প্রথম আমার একটা বোন থাকার আনন্দ অনুভব করলাম। তারসাথে শুরু হল আমার লড়াই খুনসুটি আব্দারের এক মিষ্টি সম্পর্ক। খুশী তার বাবার সাথে গিয়ে বাজার থেকে সবচেয়ে বড়ো রাখিটা নিয়ে আসত দাদার হাতে পরাবে বলে, তার সব বন্ধুবান্ধবীদের সাথে আমার পরিচয় করাত, 'এটা আমার দাদা, শুধু আমার কিন্তু।' ও হ্যাঁ বলতে ভুলে গেছি, এর ফাঁকে সে কিন্তু উপহারের বিষয়ে বেশ সজাগ ছিল; আগে থেকেই আমাকে চুপিচুপি ব
লে যেত তার এবারে কী কী গিফট লাগবে দাদার কাছ থেকে। যখন খুশী পাঁচ পেরিয়ে ছয়ে পা দিয়েছিল তখন আমি প্রথম দেখেছিলাম ঐটুকু একটা পুচকি বোন দাদাকে রাখী পরাবে বলে কিছু না খেয়ে অপেক্ষা করেছিল। বিশ্বাস করুন, সেদিন যে কিরকম অনুভূতি হয়েছিল তা আমি এখানে শব্দে প্রকাশ করতে পারব না; বুঝেছিলাম আমি হয়তো সত্যিই খুব ভাগ্যবান। খুশী আমার অনেক খুশীর কারণ হয়ে উঠেছিল সেই থেকে প্রতিবছর ধরে। এখন সে বাইরে চলে গেছে পড়ার সূত্রে, আসতে পারে না কিন্তু শুভেচ্ছাটা ঠিক চলে আসে সকাল সকাল; আজও তার ব্যতিক্রম হয় নি।
কলেজে উঠেছি, অনেক নতুন মুখের ভিড় চারিপাশে। তিন-চারজন বাদ দিয়ে সবাই অচেনা; নতুন করে তৈরী হতে চলেছে বন্ধুত্বের পথচলা। সেইসব বন্ধুবান্ধবীদের মাঝে একজনকে পেয়েছিলাম যে জোর করে এসে বলেছিল, এই আমি তোর সাথে পড়লেও তোর থেকে বড়ো, আমি রাখী পরাব তোকে আর তুই আমাকে দিদি বলবি। আমি যদি কোনোদিন যেতে না পারতাম তার বাড়িতে সে কিন্তু ঠিক চলে আসত আমাদের ঘরে রাখী নিয়ে। আর এসেই জমিয়ে দিত মায়ের সাথে গল্পের আসর। অবশ্যই উপরের তালিকায় থাকত আমাকে নিয়ে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ বিশ্লেষণ। তার অনেক ইচ্ছের মধ্যে একটা ছিল, আমার বিয়ের সময় আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে ননদের উপহার নেওয়ার। সব ভালোই ছিল, কিন্তু কথাতেই আছে সব ভালোরও একটা শেষ থাকে। আজ চারবছর হল সে নেই; ফাঁকি দিয়ে চলে যাওয়ার মধ্যে সে কতটা সুখ খুঁজে পেয়েছিল আমি জানি না। যখন সন্ধ্যায় আমি তার চলে যাওয়ার খবর পেয়েছিলাম স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম; তার বাড়ির সামনে দিয়ে আমি বহুকাল যেতে পারতাম না, আজ কখনো পেরোলে ব্যালকনির দিকে তাকালে মনে হয় সে হাত নেড়ে বলছে, ভাই একদিন আসবি রে সময় করে, অনেক গল্প জমে আছে যে।
এখানে যা যা লিখলাম তা আমার জীবনে রাখীবন্ধনের তাৎপর্য; কিছু বন্ধন ঐ একটা সুতোর টানে তৈরী হওয়া থেকে শুরু করে জীবনের শেষদিন অব্দি আমাদের অজস্র না বলা কথাতেও তা ক্রমাগত দৃঢ় হতে থাকে সময়ের বিবর্তনে। আজ এই রাখী পরানোর মানুষের তালিকায় নতুন সংযোজন হয়েছে আমার দিদি। একটা কথা আমি আমার এই ছোট্ট জীবনের পরিসরে খুব ভালোভাবেই বুঝেছি যে, ভরসা বিশ্বাস ভালোবাসা আমাদের রক্তের বাঁধনের চেয়ে অনেক অনেক ঊর্ধ্বে। আমার সকল দিদি বোনেরা যেখানেই থাকুক ভালোতে থাকুক, তাদের জীবনের আকাশ জুড়ে বিরাজ করুক রামধনুর মেলা।