Akash Karmakar

Drama Tragedy Inspirational

3  

Akash Karmakar

Drama Tragedy Inspirational

মানিয়ে নেওয়া-সামাজিক ব্যাধি

মানিয়ে নেওয়া-সামাজিক ব্যাধি

3 mins
253


  মঞ্চে উঠলেন পুরস্কার নিতে বছর সাইত্রিশের অর্ণব দাশগুপ্ত, সঙ্গে তার দিদি সংঘমিত্রা দাশগুপ্ত। শ্রেষ্ঠ বাঙালির সম্মান গ্রহণ করতে চলেছেন দুজনে দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে তাদের সামাজিক কাজকর্মের জন্য। দিদি এবং ভাই দুজনেই নিজের নিজের জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি পরিচালনা করেন একটি বেসরকারী সংস্থা, যার নাম 'নারী'। নাম দেখেই খানিকটা ধারণা পেয়ে গেছেন সংস্থাটির কাজকর্ম সম্পর্কে। তারা মেয়েদের জন্যই কাজ করেন, কিন্তু কোন মেয়েদের জন্য? মূলতঃ তাদের কাজের পরিসরের মধ্যে পড়ে সেই সমস্ত নারীরা যারা আর মেনে নিতে পারে নি বা তারা সমস্ত রকমের মানিয়ে নেওয়ার ঊর্ধ্বে চলে গেছে। 

          

       মেয়ে উচ্চ শিক্ষিত হোক্ বা না হোক্, নিজে সুপ্রতিষ্ঠিত হোক্ বা না হোক্ এসবে সত্যিই আমাদের আধুনিক সমাজের কিছু এসে যায় না। তাই তো আজও সমাজে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে কোনো সমস্যা হলেও মেয়ের বাড়ির লোক খুব সহজেই মানিয়ে নিয়ে সংসার করার বিধান দিয়ে থাকেন। আর যখন সেই মেয়েটির অর্ধদগ্ধ বা ঝুলতে থাকা নিথর দেহটার সামনে বসতে হয় মেয়ের বাবাকে তখন তিনি যতই আইনের দরজায় কড়া নাড়ুন না কেন, আর যতই অপরাধীদের শাস্তির কথা বলুন না কেন, আসলে নিজের অপরাধের জন্য কোনো শাস্তিই আর ধার্য করতে পারেন না। মনে শুধু একটাই কথা কাঁটার মতন বিঁধতে থাকে, আজ যদি আমি সেদিন মানিয়ে নিতে না বলতাম তাহলে আজ তো আমাকেও এই দৃশ্যটা মেনে নিতে হত না।


     অর্ণবের বাবা একটি জুটমিলে কাজ করতেন। সংসার স্বচ্ছল নাহলেও অভাবী ছিল না কখনোই। বড়দি সঞ্চয়িতার গায়ের রঙ একটু কালো হলেও পড়াশোনা-গান-হাতের-হাতের কাজে জুড়ি মেলা ভার। অর্ণবের যখন এগারো-বারো বছর বয়স তখন তার বড়দির বিয়ে হয় শহরের এক শাড়ী ব্যবসায়ীর ছেলের সাথে। প্রথম দিকে সব ঠিকঠাক থাকলেও ধীরেধীরে দাম্পত্য কলহ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মানসিক অশান্তি ক্রমাগত রূপ নেয় শারীরিক অত্যাচারের। এসবের মধ্যেই সঞ্চয়িতা গর্ভবতী হয়, তাকে তখন তার বাবা গিয়ে নিয়ে আসেন। বাবা মায়ের কাছে সঞ্চয়িতা ধীরেধীরে তার সমস্ত কথা জানালেও তারা খুববেশী কিছু করার চেষ্টা করেন না এইভাবে যে, বাড়িতে ছোট মেয়ে সংঘমিত্রা রয়েছে, কিছুদিন পর তারও বিয়ে দিতে হবে আর যদি এই পুলিশ কোর্টের চক্করে তার বিয়ে না হয়। এরকম নানাবিধ প্রশ্নের চাপের মুখে তারা যাইহোক করে আবার সবকিছু বুঝিয়ে সঞ্চয়িতাকে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দেন মেয়ের তীব্র অনিচ্ছা সত্বেও। 


      সঞ্চয়িতার তখন পাঁচমাস, এরমধ্যেই একদিন দুপুরে খবর এলো সন্তানসম্ভবা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে গলায় দড়ি নিয়ে। আর কেউ সঠিক কারণটা না জানলেও ওঁর বাবা মা ভাই বোনেরা সবটাই বুঝেছিল। মেয়ের নিথর দেহটার সামনে দাঁড়িয়ে পিতা হিসেবে দাশগুপ্তবাবু সেদিনের ঐ 'মানিয়ে নেওয়া' বিষয়ের জন্য আজ যতই আফসোস আক্ষেপ করুন না কেন, কোনোকিছুর বিনিময়েও প্রথম সন্তানের কাছ থেকে বাবা ডাক শুনতে পাবেন না। সামাজিক নিয়ম মেনে মেয়ের পার্থিব দেহ সৎকারের পর থেকে তার জন্য বিচারের আশায় তিনি হাজারবার আইনের দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়ালেন কিন্তু দিনের শেষে প্রমাণের অভাবে এবং টাকার কাছে হার মানতে হল আরেকবার দাশগুপ্তবাবুকে। 

  

          সংঘমিত্রা সেদিনই মনে মনে শপথ নিয়েছিল বিয়ে না করার সকল পরিস্থিতিতে, আর এই যুদ্ধে সে পাশে পেয়েছিল তার ভাই অর্ণবকে। ভাই-বোন নিজ নিজ জগতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তৈরী করল এক সংস্থা যারা সেই সমস্ত নারীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের স্বাবলম্বী করে তুলবে যা তাদের সেই অতীতের অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতের ওপারে আলোর কিরণ হয়ে জ্বলে উঠবে। প্রসঙ্গতঃ জানিয়ে রাখা ভালো যে অর্ণব বর্তমানে একজন প্রতিষ্ঠিত উকিল আর সংঘমিত্রা মানবাধিকার কমিশনে উচ্চপদে কর্মরতা। 


     আজ 'নারী' সংগঠন প্রতিমুহূর্তে যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছে যাতে কখনো কোনো মেয়েকে মেনে নিয়ে বা মানিয়ে নিয়ে বাঁচতে না হয়; সে বাঁচবে নিজের মর্যাদায়, নিজের যোগ্যতায়। নিজের দিদিকে আকস্মিক হারানো আর সেখান থেকেই তার ছোটো ভাই-বোনের ঘুরে দাঁড়িয়ে তাদের কার্যকলাপের মাধ্যমে দিদির শেষ পরিণতিকে মনে রেখে লড়াই করে এগিয়ে চলা; ভাইবোনের সম্পর্কের বিচারেও আজ তারা জয়ী, নারীদের সার্বিক উন্নয়নের নিরিখেও তারা জয়ী। আসলে এই জয়ের যে কোনো মাপকাঠি নেই, তাই দিদির চরণেই ঠাঁই পাক্ সংঘমিত্রা ও অর্ণবের আজকের শ্রেষ্ঠ বাঙালির সম্মান। 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama