Akash Karmakar

Tragedy Inspirational

4  

Akash Karmakar

Tragedy Inspirational

দাদুভাই

দাদুভাই

4 mins
466


ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে নয়টা। খাবার টেবিলে তখন সপরিবারে খেতে বসেছেন সঞ্জয়, সঞ্জয়ের মা, তার স্ত্রী ও একমাত্র পুত্র। সামনে অন করা টেলিভিশন সেট, সেখানে চলছে কোন এক নাম না জানা সিনেমা। মুখে খাবারটা তুলে তাকাতেই চিৎকার করে উঠলেন সঞ্জয়ের মা শ্যামলী দেবী,

---বাবু দেখ, তোর বাবা না?

     বাবা শব্দটা শুনেই পুরো স্তম্ভিত হয়ে গেছে সঞ্জয়। প্রায় পয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর বাবার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। বাবা আর পৃথিবীতে নেই মনে করেই তারা জীবন কাটাচ্ছিল এতদিন ধরে। সত্যি বলতে, বাবা আছেন কিনা, বা কোথায় আছেন এই বিষয়ে তেমন কোনো খোঁজ নেওয়ার চেষ্টাও করেনি কখনো সেভাবে। সঞ্জয়ের স্ত্রী বা ছেলের কোনো ধারণাই নেই পরিবারের বয়ঃজৈষ্ঠ্য মানুষটি সম্পর্কে। 


     সঞ্জয়ের বয়স যখন পাঁচ ছয়ের কাছাকাছি তখন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে পিওনের কাজ করতেন তার বাবা। সেখানকার ইউনিয়নের ঝামেলায় জড়িয়ে একজন নেতার খুনে তিন চারজনকে পুলিশ গ্রেফতার করে, তাদের মধ্যেই একজন সঞ্জয়ের বাবা‌। একে তো গরীব মানুষ-টাকার অভাব, তার উপর খুনের দায়ে অভিযুক্ত; সেভাবে তথ্য প্রমাণ নিজের সপক্ষে দিতে না পারার কারণেই যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিত হতে হয়‌‌। সেখান থেকেই শুরু এক নতুন জীবনের‌। অভাবের দায়ে প্রথমে শহর ছাড়ে সঞ্জয়কে নিয়ে তার মা। বাবার অস্তিত্বকে একপ্রকার জীবন থেকে ঝেড়ে ফেলে তারা পা বাড়ায় নতুন ভোরের দিকে।


      শিক্ষার অভাব, দক্ষতার দারিদ্র্যের চাদরের তলে ছেলেকে বড় করতে সঞ্জয়ের মা কয়েকটা ঘরে রান্নার কাজ করতে শুরু করেন; ধীরেধীরে সেখান থেকে একটা ছোট্ট হোম ডেলিভারীর ব্যবসা গড়ে তোলেন ছেলে বড় হওয়ার পরে। এদিকে সঞ্জয় একটা কাজ জোগাড়ের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা ক‍রতে থাকে। অতঃপর একদিন চেষ্টার সাথে ভাগ্য সহায় হয়; গরীবের চালাঘর ছেলের রোজগারের ভাতের গন্ধে ভরে ওঠে। সেখান থেকে বিয়ে, বাচ্চার জন্ম সব নিয়ে চারজনের সংসার সেজে ওঠে। বাবা তলিয়ে যান কারাগারের অতল আঁধারে। শেষবারের চিৎকার করে বলা সঞ্জয়ের বাবার 'আমি নির্দোষ' কথাটা যেনো আজ এতবছরেও কোনোদিন কর্ণগোচর হল না আর।


      বাবা হঠাৎ কীভাবে সেই চলচ্চিত্রে চলে এলেন এই নিয়ে কিছুতেই আর রাতে ঘুম আসে না সঞ্জয়ের। এদিকে নাতি তো একেবারে জেদ ধরেই নিয়েছে দাদুকে দেখার; যে কোনো প্রকারে তাকে দাদুর সাথে দেখা করতেই হবে। স্কুলে সবাই যখন দাদুদের কাছে গল্প শোনার গল্প শোনায় তখন তাকে এতদিন চুপ করেই বসে থাকতে হত; কিন্তু আর নয়, একবার যখন ঝলক দেখা গেছে তখন মানুষটার কাছে পৌঁছাতেই হবে। ছেলেকে অনেক বোঝানোর পরেও যখন কোনো কাজ হল না তখন অগত্যা সঞ্জয় খোঁজ নিতে শুরু করল বিষয়টা নিয়ে। দিন পাঁচেকের মধ্যেই ছবিটা স্পষ্ট হয়ে উঠল সকলের কাছে। যে সিনেমায় সঞ্জয়ের বাবাকে দেখা গেছে তার শ্যুটিং হয়েছিল সেই সংশোধনাগারে যেখানে ঐ বয়স্ক মানুষটি নিজের জীবনের অর্ধেকের চেয়ে বেশীদিন কাটিয়ে ফেলেছে। এবার ঐ সিনেমার একটি অংশের উদযাপনের দৃশ্যে কোনোভাবে এক ঝলক ক্যামেরা তাকে ধরে ফেলে, বেশ এটুকুই খবর। 


      সেখানে নিয়মমাফিক যোগাযোগ করে একদিন সকালে তারা সপিরাবরে বেরিয়ে পড়ে সেই জেলের উদ্দেশ্যে বাবার সাথে দেখা করবে বলে কয়েকযুগ পরে। বয়স বেড়েছে, ঝুরি পড়েছে, চোখের জ্যোতি কমেছে তবুও ছেলেকে-স্ত্রী কে এতদিন পর সামনে দেখে চোখের জল ধরে রাখতে পারল না স্বাভাবিক ভাবেই উভয়পক্ষই। নিয়মানুযায়ী জীবনের বাকিদিনগুলোও ঐ অন্ধকার কারাগারেই কাটাতে হবে সঞ্জয়ের বাবাকে। কিন্তু এতো গেলো স্বামী-স্ত্রী এবং পিতা-পুত্রের আলাপপর্ব। আসল গল্পের শুরু তো এবার; নাতিকে জানতে হবে দাদুর গল্প। আজ তো প্রথম আলাপ দাদুর সাথে, তাও আবার জেলে! প্রথমদিন তো নাতিকে জড়িয়ে ধরে 'দাদুভাই' বলে চুমু খেতেই ঘন্টা বেজে গেল, এবার ফিরতে হবে। কিছু নাতির মন যে মানে না; সে তো আর এতো নিয়মের কড়াকড়ির সাথে অবগত নয়। 'আবার নিয়ে আসব' - সঞ্জয়ের কাছ থেকে এই প্রতিশ্রুতি পাওয়ার পরেই তার ছেলে শান্ত হয়।


       প্রথমদিনের সাক্ষাৎ পর্বের পর যাতায়াত বাড়তে থাকে; বিশেষ করে ছেলের জেদের কাছে কার্যত হেরে সঞ্জয় আসতে থাকে বাবার কাছে। তবে সেখানে যত না কথা হয় বাবা-ছেলের, তারচেয়ে ঢের বেশি হয় দাদু-নাতির। নাতি যত বড় হতে থাকে ততই যেনো সে দাদুর কাছে গল্পের ছলে জানতে থাকে সমস্ত ঘটনা। বুড়ো মানুষটিও এতদিন ধরে একজনকে খুঁজতে বেড়িয়েছেন যাতে মৃত্যুর আগে অন্তত একবার যেনো বলে যেতে পারে যে সত্যিই সেদিন নির্দোষ ছিল। নাতি গভীর আগ্রহের সাথে শুনতে থাকে সমস্ত ঘটনা প্রবাহ; ক্রমাগত সে নিজেকে গড়ে তুলতে থাকে ভবিষ্যতের একজন পুলিশ হিসেবে শুধুমাত্র দাদুর মুক্তির জন্য নয়, যাতে তার মতন আর কোনো শিশুর শৈশব দাদুর গল্পশোনা থেকে বঞ্চিত না হয়। বড় হওয়ার সাথে সাথে সে বুঝতে পারে আইনে সাজাপ্রাপ্ত একজন অপরাধীকে মুক্ত করতে হলে আসল অপরাধীদের সামনে আনতে হবে; আদালত আইন সবাই যে প্রমাণ খোঁজে। 


       সময়ের স্রোতে চলতে চলতে সঞ্জয়ের ছেলে হয়ে ওঠে জেলার; উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের কাছে রীতিমতো সে অনুরোধ করে পোস্টিং নিয়ে আসে ঐ জেলেই যেখানে এতদিন সে আসত কেবল দাদুর সাথে দেখা করতে। উদ্দেশ্য একটাই যদি কোনোভাবে মৃত্যুর আগে একবার দাদুকে নির্দোষ প্রমাণ করা যায় আইনের চোখে। ধুলো জমা ফাইলের ভিড় থেকে বের করা হয় সেই ফাইলটি, শুরু করে সে গোপন তদন্ত। হাতে উঠে আসে বেশ কিছু তথ্য প্রমাণ; দাদু ততদিনে শয্যাশায়ী। শারীরিক অসুস্থতার কারণে ভর্তি করা হয়েছে জেলের হাসপাতালে। অবশেষে খোঁজ মেলে আসল অপরাধীর, তাকে গ্রেফতার করে তোলার হয় আদালতে এবং সঙ্গত কারণেই সাক্ষ্য প্রমাণের উপস্থিতিতে তিনি স্বীকার করে নেন আজ কয়েকযুগ আগে করা তার অপরাধের কথা। 


      আজ দাদুর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান। দাদু শুনে যেতে পারেননি নির্দোষ প্রমাণের কথা, দেখে যেতে পারেননি নাতির অদম্য লড়াই দাদুর জন্য কিন্তু নাতির দৃঢ় বিশ্বাস দাদুরা নাতিদের সাথেই থাকেন সবসময়, সে এই জগতে হোক্ বা অন্য জগতে। নাতি আজ বড়ো অফিসার পুলিশের, লক্ষ্য তার আজও একটাই; দাদুর মতন আর কোনো নির্দোষ নিরপরাধ ব্যক্তিকে যেনো শুধুমাত্র গরীব হওয়ার কারণে আইনের বলি হতে না হয়।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy