Akash Karmakar

Abstract Romance Fantasy

3  

Akash Karmakar

Abstract Romance Fantasy

রঙের আঙিনা হতে...

রঙের আঙিনা হতে...

4 mins
191


আজ শুধু দিলখোলা আবীর, 

আজ তো সব সম্ভব

আজ আমাদের দোল,

আজ বসন্ত উৎসব।

                - কবি রামচন্দ্র পালের বিখ্যাত কবিতার কয়েকটি পঙক্তিকে একটু নিজস্ব আঙ্গিকে তুলে ধরলে বোঝা যায় এই পলাশ, এই শিমূল আমাদের খামবন্দী চিঠিদের ঠিকানায় পাঠাতে আবারও বাধ্য করে; বাধ্য করে বসন্তের রঙে রাঙিয়ে নিতে নিজেকে। প্রবল শৈত্যপ্রবাহের অত্যাচারে যখন সকল বৃক্ষরাশি নির্জীব হয়ে পড়ে, প্রকৃতির এই অমোঘলীলায় তখন আবার ডালে ডালে, শাখায় শাখায় লাগে প্রাণের ছোঁয়া। কোকিলের স্নিগ্ধ কুহুতানের আভাসে বাতাসে ছড়ায় বসন্তের প্রতিধ্বনি-সে বাতাসে ভেসে উঠে সুরের মূর্ছনা। একরাশ লাল পলাশের স্পর্শে মেতে ওঠা ফাগের হাওয়া গায়ে মেখে, যখন তার দখিন দুয়ার খুলে আহ্বান জানায় ঋতুরাজ বসন্তের রবিঠাকুরের কলমের ধারায়-


আজি দখিন-দুয়ার খোলা,


এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো।


    দিব হৃদয়দোলায় দোলা,


এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো॥


বাংলার প্রকৃতিতে বসন্তের রাজকীয় আবির্ভাব প্রকৃতির পাশাপাশি মানুষের মনকেও আন্দোলিত করে গভীর আবেশে। সে জন্যই বুঝি বসন্ত ঋতুরাজ। আর তাই কবিগুরু বসন্তের কাছে চেয়েছেন নবপ্রাণ, উচ্ছ্বাস, নবচেতনা তাঁর নিজস্ব আঙ্গিকে।


পথের ধারে হলুদ হয়ে ওঠা গাছগুলো জানিয়ে দিয়েছে তুমি এসেছ মহাসোমারহে-পলাশ, কৃষ্ণচূড়া ঝুঁটিতে বেঁধে, আবীর মেখেছে লাল, মেতেছে বসন্ত নৃত্যে। বনে বনে আজ জীবনের নবদোলা, ফুলের পাপড়িতে রঙেরই আল্পনা, এসেছে রঙের উৎসব আবার... দুয়ার রুদ্ধ আর রেখো না...  


"আসে বসন্ত ফুলবনে সাজে বনভূমি সুন্দরী,

চরণে পায়েল রুমুঝুমু মধুপ উঠিছে গুঞ্জরী"

                     --কাজী নজরুল ইসলাম। 


রবিঠাকুরের শব্দে বলা যেতে পারে- 

"ফুলগুলি যেন কথা,

 পাতাগুলি যেন চারিদিকে তার

  পুঞ্জিত নীরবতা।" 


বসন্ত আসলেই অন্ত, বছরের শেষ ঋতু বসন্ত। তবে বসন্ত কেবল একটি শব্দ নয়; বসন্ত এক অনুভূতি। সারাবছর ধরে জমানো চিঠি যার জন্যে তার আগমনে প্রকৃতি নিজেকে এক অনন্য রূপে সাজিয়ে তোলে। ঐ আকাশের রামধনুর সমস্ত রঙ যখন ধরাতলে এসে পৌঁছায়, তখন 'রং যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে'। তাই সবটুকুকে রঙিন করে দিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব ঋতুরাজ বসন্তের। ফুলের উচ্ছ্বাসে হাসছে আকাশ, কাঁপছে বাতাস, দুলছে আম্রমুকুল। অকারণের সুখে অলক্ষ্যে রঙ লাগছে অশোকে-কিংশুকে।


ফাগুনের মাতাল হাওয়া দোলা দিয়েছে বাংলার নিস্বর্গ প্রকৃতিকে নতুনরূপে সাজাবে বলে বসন্তের ঘরানায়। এই উৎসব রঙের, উৎসব মিলনের, উৎসব রাঙিয়ে তোলার।


'নব বসন্তের দানের ডালি এনেছি তোদেরই দ্বারে/ আয়, আয়, আয় পরিবি গলার হারে' - বসন্ত এসে গেছে। স্বর্গের কানন সাজাতে পল্লব এখন মঞ্জুরিত। কোকিলের উদাস করা গানের সুরে দুহাত বাড়িয়ে নব যৌবনে এখন শুধু তাকে গলায় পরার পালা। মেঠোপথের ধারে কারও জন্য অপেক্ষা না করেই ফুটছে নাম না জানা অসংখ্য সব ফুলেরা শোনাতে মিষ্টি ডাক্- 


বসন্তের আগমন মানেই আমের মুকুলেরও আগমন। এইসময় আমের মুকুলের গন্ধ আমাদের বিহ্বল করে তোলে। রাতের আকাশের পূর্ণিমার চাঁদের আলো যখন আমের মুকুলের ওপর এসে পড়ে তখন তার রঙিন ছটা বসন্তকে আরও মনোরম করে তোলে।


বাতাসে আবীরের ছটা দেখে ভোলা মন যখন ব্যাকুল হয়ে গন্ডীর বাইরে এসে মুক্তাকাশে নিঃশ্বাস নিতে চায় নৃত্যের তালে, তখন প্রকৃতিও নেচে ওঠে আজি কমলমুকুল দল খুলিল এর ছন্দের সাথে-


প্রকৃতির এই অপূর্ব মোহময়ী রূপ বার বার দেখতে ইচ্ছে করলেও অপেক্ষা করতেই হয় আমাদের ঋতুরাজ বসন্তের আর তাই পদাতিক কবির কলমে, 'ফুল ফুটুক, না ফুটুক, আজ বসন্ত'।



গাঢ় নীলের ঐ সুদূর দিগন্তে পাখির ডানায় ভর করে ভেসে বেড়ানো মেঘের দলের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যেভাবে পাতাঝরা গাছের শাখা আবারও সেজে ওঠে নতুন কচি পাতার লালিত্যে–


দোল বা হোলি নামের মাহাত্ম্যের সাথে আবার অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত এক যুগাবতারের নাম। সকলের প্রিয়, সকলের আরাধ্য নন্দদুলাল শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের হাত ধরেই ভারতভূমিতে হোলির সূত্রপাত বলে মেনে নেয় নানান লোকগাঁথা। দোল বা হোলি, যে নামেই তাকে ডাকা হোক, ফাগের মিষ্টি সুবাসে তা চিরন্তন প্রেমের দোলা দিয়ে যায় মনে। সেই প্রেম কখনও মননের, কখনও বা শরীরী। সেই প্রেম আদি অনন্ত। গোপিনী শ্রেষ্ঠা রাই ও গোপ শ্রেষ্ঠ কৃষ্ণের অনুরাগের রঙে সেই প্রেম দ্বাপরে ধারণ করেছিল মনোহর কায়া। রাধা ও কৃষ্ণের যুগললীলায় দোল আজ পেয়েছে এক বিশ্বজনীন রূপ...


নীল থেকে নীলাভ আজ আকাশের রং, পলাশের বনের রক্তিম চাদরের তলায় ছোট্ট পাখিরা তাদের কলতানে জানান দেয়, 'আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে'। শীতের শুষ্কতা কাটিয়ে যখন কিশলয়দের মাথা তোলার পালা আসে তখন ঐ মনমাতানো দখিনা বাতাসে হৃদয় দুয়ারের দরজা হতে ধ্বনিত হয় 'ওগো দখিন হাওয়া, জাগো, তুমি আজ, জুড়াও প্রাণের রসনা।'


রঙের ঝরনায় স্নাত সিক্ত প্রকৃতি আবার নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে দখিনা হাওয়ার সুবাসে, অলংকৃত করেছে কুহুতান রসের সুধায়।


ফাল্গুনের এই দিনটির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত আমাদের আরাধ্য শ্রী কৃষ্ণ ও শ্রী রাধিকা। কথিত আছে, বসন্তের প্রথম পূর্ণিমায় কেশি নামক এক অত্যাচারী অসুরকে বধ করেছিলেন শ্রী কৃষ্ণ। বসন্ত পূর্ণিমায় আসুরিক শক্তির বিনাশের আনন্দে শ্রী কৃষ্ণ দানবের রক্ত ছিটিয়ে উল্লাসে মেতে ওঠেন, আর সেই আনন্দে সামিল হন ব্রজবাসীও। তার হাত ধরেই সূচনা হয় এই পবিত্র দোল উৎসবের। 


পুরাণ-কথা অনুযায়ী, কৃষ্ণ আসলে নারায়ণের একটি রূপ এবং রাধা লক্ষ্মীর রূপ। রাধা-কৃষ্ণের প্রেম মানুষের সঙ্গে ভগবানের চিরকালীন প্রেমেরই প্রতিচ্ছবি। 


বৈষ্ণব পদাবলীতে দেখা যায়, কংসকে নিধন করার জন্য শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবন ছেড়ে মথুরার দিকে চলেছেন। তখন শ্রীরাধা আকুল ভাবে শ্রীকৃষ্ণের কাছে জানতে চান, কেন তিনি তাকে বিয়ে করে মথুরায় নিয়ে যাচ্ছেন না। জবাবে শ্রীকৃষ্ণ জানান, শ্রীরাধাকে তিনি নিজের সত্ত্বা বলে মনে করেন। শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধা আসলে একই আত্মার দুই শরীর। তাই শ্রীরাধিকাকে বিয়ে করলে শ্রীকৃষ্ণকে তো নিজের সাথেই বিয়ে করতে হয়।কৃষ্ণ চলে গেলেন মথুরায়, আর ফিরে আসেননি। বিরহিনী রাধা কৃষ্ণের প্রতীক্ষায় যমুনার তীরে বসে রইলেন। বৃন্দাবন বাসিরা বিশ্বাস করেন, এখনো শ্রীরাধা রাতের অন্ধকারে শ্রীকৃষ্ণের সাথে মিলনের অভিলাসে যমুনার তীরে অভিসারে যান।



ফাগুনের উৎসবে সেজেছে প্রকৃতি মা আমার , এসে গেছেন ঋতুরাজ বসন্ত। এই বসন্ত বাতাসের জাদুতে মুগ্ধ হয়েই শাহ আবদুল করিম লিখেছিলেন সেই বিখ্যাত গানটি, ‘বসন্ত বাতাসে সইগো’।



বাতাসে বসন্তের আগমনী বার্তা। গাছ থেকে ঝরে পড়ছে পুরাতনি যতো ধূসর পাতা। আর তার জায়গা বদল করছে সবুজ কিশলয়। হঠাৎ করে কোথাও ডেকে উঠছে কোকিল। রঙে-বেরঙের ফুলে ভরে উঠছে বাগানগুলো। দীর্ঘ শীতের কুয়াশা মোড়ানো প্রান্তর পাড়ি দিয়ে অবশেষে আমাদের দোরগোড়ায় এসেছে ফাল্গুন। এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত! 



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Abstract