Akash Karmakar

Tragedy Crime Thriller

3  

Akash Karmakar

Tragedy Crime Thriller

স্বাধীন চরিত্র

স্বাধীন চরিত্র

3 mins
240


প্রখ্যাত সাহিত্যিক অজয় বসু আজ ভোররাতে কারাগারে ব্লেড দিয়ে শিরা কেটে আত্মহত্যা করেছেন – খবরটা টেলিভিশনে দেখামাত্রই ভ্রাতৃপ্রতিম দীনেশ সেনগুপ্তের বুঝতে দেরী হল না যে, এটা নিছকই আত্মহত্যা নয়; বরং দৃঢ়তার সাথে বলা যেতে পারে একজন সুস্থ মানুষকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করা দীর্ঘদিন ধরে এবং তা সুপরিকল্পিত ভাবেই। 

        মাস তিনেক আগেই এক খ্যাতনামা প্রকাশনী সংস্থা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল অজয় বসুর অন্যতম সেরা উপন্যাস 'তিমিরের দুয়ারে' যা বর্তমানে তার শেষ সাহিত্যসৃষ্টি হয়েই রয়ে গেল। শুধু যে বেস্টসেলার তাই নয়, বলা ভালো বাংলা সাহিত্যের জগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক মাস্টারপিস লিখেছেন তিনি। উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র নিশান, যার জীবনে রয়েছে গুটিকয়েক ভালোলাগা, রামধনু - বৃষ্টিভেজা মাটির ঘ্রাণ - প্রেমিকার দেওয়া প্রথম গোলাপ - শরতের নীলাকাশ আর বাকিটা জুড়ে ঘৃণা - আঘাত - প্রত্যাঘাত - প্রতিবাদ। প্রতিবাদের ধরনে কখনো তার গায়ে লেগেছে খুনীর তকমা, কখনো বা ধর্ষকের, কখনো সমাজবিরোধীর কিন্তু কোনোটাই প্রমাণিত নয়। ঘটনার সূত্রপাতের চিহ্ন এই নিশানকে ঘিরেই। 

         যার বিক্রি বেশী, তার সমালোচনাও বেশী। যিনি সমাজে বিখ্যাত, তিনি যে বিকৃত নন তারও বিপক্ষে প্রমাণ মেলে না সর্বদা। এসবকিছুর ভিড়েই হঠাৎ প্রশ্ন ওঠে, নিশান কি শুধুই চরিত্র? নাকি সেই চল্লিশ বছর আগের জেল থেকে বেরিয়ে আসা কুখ্যাত আসামী কালি ওরফে অজয় বসু। লেখকের অতীতের পাতা উল্টালে স্পষ্টতই পাওয়া যায় যে, কালি এখনো পর্যন্ত আইন এবং সমাজ স্বীকৃত প্রায় প্রতিটি অপরাধের সাথেই কোনো না কোনোভাবে যুক্ত ছিলই; যদিও অজয় বসুর মতন নিপাট ভদ্রলোকের দেখা মেলা ভার আধুনিক সমাজে। সমাজসেবা আর অজয় বসু প্রায় সমার্থক বলা যেতে পারে। অবিবাহিত হওয়ার দরুণ সংসারের টানাপোড়েনের বাইরে তিনি চিরকালই; ঘরে আছে শুধু এক পটলা। তাই বিভিন্ন পুস্তক বিক্রির রয়ালটি বাবদ যা পাওয়া যায় তার একটা বড় অংশ তিনি স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে খরচ করেন বিভিন্ন সমাজকল্যাণকর কাজে। নারী-শিশুকল্যাণ থেকে শুরু করে রক্তদান পর্যন্ত সমাজের সমস্তরকমের সেবামূলক কাজে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি ছিল প্রশংসনীয়। অনেকে তো মজা করে বলেই থাকেন, ইনি আসলে বর্তমান সমাজের বাল্মীকি।

         'তিমিরের দুয়ার' প্রকাশের পর থেকেই শান্ত সাগরে আবারও ঝড় ওঠে, ঘনীভূত হয় নিম্নচাপ। ইচ্ছাকৃত - অনিচ্ছাকৃত প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হতে হয় লেখককে তার পাঠক সাহিত্যের আড়ালে একজন সাহিত্যিক সমাজকে সমাজকে অপরাধ প্রবণতার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন; একজন সাহিত্যিকের সমাজ সংস্কারের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে তিনি সচেতন নন, ইত্যাদি নানাবিধ অভিযোগে তোলপাড় হচ্ছে প্রতিদিন চারপাশের পরিবেশ। প্রতিটি মিডিয়ার এখন হটটপিক হয়ে উঠেছেন লেখক স্বয়ং। অজয় বসু নিজেও বেশ কয়েকবার এই বিষয়ে বিবৃতি দিলেও শান্ত হতে নারাজ বাংলার বুদ্ধিজীবী সমাজ। অপরাধীর মন থেকে অপরাধ তুলে ফেলা যায় না; সুতরাং তাদের দাবী অজয় বসুর গ্রেফতারি যেকোনো মূল্যেই। হয়তো আর পাঁচজন সাধারণ লেখকের উপন্যাসের মতনই এই উপন্যাসটি নিয়েও এতো জলঘোলা হত না যদি না লেখকের নিজস্ব ব্যক্তিগত জীবনে এরকম অন্ধকার অতীত থাকত। 

         অবশেষে বাধ্য হল পুলিশ মাথা নত করতে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির চাপে এবং জারি হল অজয় বসুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা সমাজের যুবসমাজকে পরোক্ষভাবে অপরাধের দিকে ঠেলে দেওয়ার অজুহাতে। হ্যাঁ আসলে এটা অজুহাত ছাড়া কিছুই ছিল না, কারণ যিনি মূলতঃ এই আন্দোলনের কান্ডারী তিনি সরকারের অন্যতম ঘনিষ্ঠ এবং কলকাতার আরেক অনামী প্রকাশনীর কর্ণধার সুপ্রিয় বিশ্বাস। নামে সুপ্রিয় এবং পদবীতে বিশ্বাস থাকলেও তিনি যে অধিকাংশ মানুষের প্রিয় ছিলেন না তা বলাই বাহুল্য; আবার বিশ্বাসের পরাকাষ্ঠাতেও তার ঘাতকতার হার উচ্চতর। যাইহোক্ কালি জেল থেকে বেরিয়ে আসার পর প্রকৃত অর্থেই তার সংশোধন হয়েছিল চরিত্রের। শুধু যে নিজেকে বদলেছিলেন তাই নয়, পাশাপাশি সমাজে ঘটে চলা যে কোনো ধরনের ভুল কাজের নিন্দাও করতেন উচ্চ স্বরে। এই তো গতবছরই সুপ্রিয় বাবুর ছেলে যখন অবৈধ ড্রাগসের ব্যবসার অভিযোগে ধরা পড়ে তখন এই অজয় বসুকে দেখা গেছল প্রতিবাদের সামনের সারিতে। এবং ঘটনাচক্রে আইনি জটিলতায় পড়ে সুপ্রিয় বাবুর ছেলেকে ছয়মাস জেলেই কাটাতে হয়েছিল; সেই কেস আজও চলছে। 

         সুপ্রিয় বাবু যে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন তা একেবারে পরিপাটি করে পরিবেশন করা হল 'তিমিরের দুয়ারে' প্রকাশের মাধ্যমে। নিজের সমস্তরকম সুযোগসুবিধাকে কাজে লাগিয়ে অজয় বসুকে পৌঁছে দিলেন আরেকবার কারাগারের পেছনে একপ্রকার বিনা অপরাধে। হাজারো প্রচেষ্টার পরেও পুলিশের দেওয়া কিছু কড়া ধারার ধারাপাতে আটক হতে হল কারাগারের অন্ধকারে আবারও লেখককে। 

         জীবনের প্রায় শেষ পর্যায়ে এসে সত্তরোর্ধ্ব অজয় বাবু এই অপমান সহ্য করতে পারলেন না; সাহায্য নিলেন এক টুকরো ব্লেডের যা যথেষ্ট ছিল এবারে কারাগার হতে তার চির মুক্তির জন্য। পোস্টমর্টেম করতে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ অজয় বাবুর পকেট থেকে বের করে একটি কাগজ, যাতে লেখা ছিল – "চরিত্রেরা বরাবরই স্বাধীন, লেখকেরা নয়।" 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy