আদিবাসী চিকিৎসক
আদিবাসী চিকিৎসক
ছোটোবেলা থেকেই গ্রামের আর পাঁচজন ছেলেমেয়ের মতনই স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে ডাক্তার হওয়ার। ডাক্তার হয়ে মানুষের জীবন বাঁচানোর পাশাপাশি নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করাটাও তার জীবনের লক্ষ্য হয়ে উঠেছিল। তার লড়াইটা যে কেবল দারিদ্র্যের সাথে ছিল তা নয়, বরং তারচেয়ে অনেক বেশী ছিল পরিচয় তৈরীর লড়াই; এমন একজন হয়ে ওঠার লড়াই যেখানে পদবী বা জাত গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। স্বাধীন ভারতের সংবিধানে যাই বলা থাকুক না কেন, গোঁড়ামি মুক্ত সমাজে বাস করার সময় হয়তো আসে নি। পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল এলাকার এক প্রত্যন্ত গ্রাম সুগনিবাস, সেখানেই সপরিবারে বাস করে সুখু মান্ডি। বাবা একজন সরকারি অফিসের কেরাণী; সেই রোজগারেই দিন কেটে যায় তাদের। যখন থেকে বুঝতে শিখেছে সুখু আশেপাশের মানুষদের আচরণ সম্পর্কে, তখন থেকেই যেনো মনের মধ্যে বড় চিকিৎসক হয়ে ওঠার জেদ আরও প্রকট রূপ নেয়।
সময় বদলায়, সেদিনের গ্রামের সুখু মান্ডি আজ হয়ে উঠেছে শহরের ডাঃ সুখু মান্ডি। কিন্তু কথাতেই আছে, অভাগা যেদিকে যায়, সাগর শুকায়ে যায়। ডাক্তারের পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়েও সমাজের চোখে সে যেনো ঐ উপজাতির একজন সামান্যতম চিকিৎসক হয়েই দিন কাটাতে বাধ্য হল। সরকারি হাসপাতালে চাকরি জুটলেও সেখানেও অন্যান্য সহকর্মীদের তরফ থেকে মাঝেমধ্যেই উড়ে আসত বিদ্রুপাত্মক বাক্যের বাণ, যা প্রতিমুহূর্তে নিঃশব্দে তাকে বিদ্ধ করত। কিছুই করার ছিল না তার, শত চেষ্টা করে মানুষের চিকিৎসা করলেও খুব ঠেকায় না পড়লে কেউই আসত না তার কাছে। উপজাতির অংশ হলেও যে অনেকেই পড়াশোনা করে সাফল্যের সাথে কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষমতা রাখে তা এই সমাজের আয়নায় প্রতিফলিত হয় না, হবেও না। জীবনের শুরুর দিকে নিজের এক স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরীর জন্য প্রচুর পরিশ্রম করলেও যত দিন যেতে লাগল ততই যেন সবকিছু একঘেয়ে মনে হল তার। মাস শেষে টাকা রোজগার হয় ঠিকই, কিন্তু সে টাকাতে সুখ কম–সন্দেহ বেশী।
বয়স যখন চল্লিশ পেরিয়েছে তিনি শহরের চোখধাঁধানো জটিলতার হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করে ফিরে আসেন তার গ্রামে, তার জন্মভূমিতে। হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি পাকাপাকিভাবে চলে আসেন সুগনিবাসে, গ্রামে হয়তো রোজগার নেই ঠিকই কিন্তু সম্মান আছে। এখানে কেউ তাকে তাচ্ছিল্যের বিষ বাণে বারংবার বিদ্ধ করবে না; বরং তাকে সর্বদা মাথায় তুলে রাখবে। এরই মধ্যে দুর্ঘটনায় অকস্মাৎ স্ত্রীয়ের চলে যাওয়ার শোকটাও নিতে পারছিলেন না আর। নিঃসঙ্গ জীবন যেনো দিনদিন হয়ে উঠছিল এক দুর্ভেদ্য কারাগার। গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা করার পাশাপাশি তিনি অবসর সময়ে সেখানকার সমস্ত ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের পড়াতেও শুরু করেছিলেন। কারণ সংবিধান স্বীকৃত কিন্তু সমাজ অস্বীকৃত আদিবাসীদের এই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার তাগিদে আগামীর মশালকে একদল শক্তপোক্ত হাতে তুলে দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত কাজ।
গ্রামেরই ছেলে হারুণ সমাদ্দার, ঘরের অভাবের তাড়নায় পড়াশোনা সেভাবে করা হয়ে না উঠলেও ছেলে হিসেবে সে বরাবরই ভালো। তবে তার ছবি আঁকার হাত ছিল দুর্দান্ত; নিজের গ্রাম ছাড়াও আশেপাশের গ্রামে অনেকের ঘরের দেওয়ালেই সে তাদের ইচ্ছানুযায়ী দারুণ সমস্ত ছবি এঁকে আসত এবং সেখান থেকেই যতটুকু যা পেত তা
দিয়েই চালিয়ে নিত। কিন্তু ডাক্তারবাবু গ্রামে ফিরে আসার পর থেকেই সে আরেকটা কাজ জোগাড় করে নিয়েছে, তা হল ডাক্তারবাবুর সাথে দিনরাত থাকা। রোগী দেখার সময় ডাক্তারবাবুকে সাহায্য করা থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এনে দেওয়া সবকিছুই সামলে দেয় হারুণ। নিজের ছবি আঁকার কাজের বাইরে যতটা সময় থাকে হাতে সবটাই যেনো সে সঁপে দিয়েছে ডাক্তারবাবুর কাছেই। যে ছেলেমেয়েগুলো পড়তে আসত ডাক্তারবাবুর কাছে তাদেরকে হারুণ হাতে ধরে ছবি আঁকা শিখিয়ে দিত। ডাক্তারবাবুর চোখে হারুণ হয়ে উঠেছিল সন্তানতুল্য।
বয়স বাড়ছিল, রোগী দেখার ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছিল দিন দিন। শরীর এমনই, যতই তুমি তাকে ভালোমন্দ দিয়ে পোষ মানানোর চেষ্টা করো না কেন, সময় হলে সে ঠিকই একদিন উড়ে দেবে ফুড়ুৎ করে কোনো অচিনদেশে। বৃষ্টিস্নাত এক সকালবেলায় ডাক্তারবাবুর স্ট্রোক হয় প্রাতঃরাশের টেবিলে। তড়িঘড়ি করে প্রথমে স্থানীয় গ্রামীণ হেলথসেন্টারে নিয়ে গেলে সেখান থেকে দ্রুত শহরের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। সকল চিকিৎসকদের সমস্ত চেষ্টা বিফল করে দিয়ে ডাঃ সুখু মান্ডি পাড়ি দেন পরলোকের পথে। ডাক্তার এসে ঘোষণা করেন ওঁর ব্রেন ডেথ হয়েছে। নিজের বলতে কেউই ছিল না তো এই জগতে, হারুণ বাদে। হারুণকেই ডাক্তারবাবু নিজের শরীরের বেগতিক অবস্থার কথা ভেবে একদিন বিকেলে ডেকে একটা কাগজে নিজের মরণোত্তর ইচ্ছের কথা লিখে দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে হারুণ সেই কাগজটি ঐ শহরের ডাক্তারকে দেখালে তিনি তার পরবর্তী প্রক্রিয়ার কাজ শুরু করে দেন। ডাক্তারবাবু নিজের জীবদ্দশায় বহু আগেই চোখ ডোনেট করেই গেছলেন এবং এখন ব্রেন ডেথ হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিষয়টি নিয়েও ভাবনা শুরু হল।
ডাক্তারবাবুর বিভিন্ন অঙ্গ স্থান পেলো ভিন্ন ভিন্ন শহরের বিভিন্ন মানুষের দেহে। অস্পৃশ্যতার বাঁধন যেনো এক লহমায় পুড়ে ছাই হয়ে গেল প্রয়োজনের কাছে। যে ডাক্তারবাবুর কাছে মানুষ বেঁচে থাকাকালীন সচরাচর আসার ইচ্ছে প্রকাশ করতেন না শুধুমাত্র তিনি একজন উপজাতি থেকে উঠে আসা ব্যক্তি হওয়ার জন্য আজ তাঁরই চোখ দিয়ে নতুন করে জগতকে দেখার দৃষ্টি ফিরে পেল কলকাতা শহরের এক নামকরা ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান; লিভার স্থান পেল মুম্বাইয়ের এক বিখ্যাত অভিনেতার শরীরে। পুরুলিয়ার জঙ্গলমহল থেকে উঠে আসা একজন আদিবাসী ডাক্তারের প্রতিটি অঙ্গ যেনো দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বেশ কিছু পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে পারল যা হয়ত তিনি সাদা পোষাকে গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে ডাঃ সুখু মান্ডি হিসেবে না পারলেও স্বর্গীয় ডাঃ সুখু মান্ডি হিসেবে নিশ্চিতভাবেই পেরে উঠলেন।
আজ সুগনিবাস গ্রামের আগামী প্রজন্ম ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে মাইলের পর মাইল অতিক্রম করে চলেছে। একজন সুখু মান্ডির দেখানো পথ ধরে হাজারো সুখু মান্ডিরা একদিন পৃথিবীর বিভিন্ন নামীদামি হাসপাতালে রোগীদের সেবায় নিজেদের নিয়োজিত করবেই। তারা আসলে সেই ভারতের স্বপ্ন বুনছে দিনরাত যেখানে পদবীর বেড়াজাল টপকে মানুষ মানুষকে ভালোবাসার টানে জড়িয়ে ধরবে, শ্রদ্ধার আসনে স্থাপন করবে। চেষ্টা সততা আদর্শ এসবের যে কোনো জাতপাত হয় না।