শিক্ষকের পরিচয়
শিক্ষকের পরিচয়
শহরের একটি নামকরা স্কুলে শিক্ষক হিসেবে সদ্য যোগদান করেছেন গ্রামের ছেলে সুবিনয়। বয়স কম কিন্তু বিষয়ের গভীরতা দারুণ। খুব স্বল্পদিনের মধ্যেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে নবাগত অঙ্কের স্যার হয়ে উঠেছেন জনপ্রিয়। স্যারের কাছে কোনো অঙ্কই অসাধ্য নয়-এরকম ধারণা নিয়েই স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা স্কুল ছুটির পরেও সুবিনয়ের কাছে অজস্র জটিলতম গাণিতিক সমস্যার সমাধান খুঁজতে আসে। কয়েকজন তো আবার স্যারের বাড়িতেও মাঝেমধ্যে আসা শুরু করেছে যদিও কোচিং বিষয়টাকে সেভাবে গুরুত্ব দিতে কখনোই পছন্দ করে না সুবিনয়।
সমস্ত কিছু ভালোভাবে চলার মাঝেই একদিন ফোন করেন একজন অভিভাবিকা। হ্যাঁ আপনি যেমনটা ভাবছেন, ঠিক সেই পথেই এগোতে চলেছে সুবিনয়ের আগামী জীবন। সেই ছাত্রকে পড়াতে আসার সূত্রে কখন যেনো গড়ে ওঠে এক সূক্ষ্ম প্রণয়ের সম্পর্ক ছেলেটির মায়ের সাথে। ক্রমাগত বাড়তে থাকা গভীরতায় দুইজনের শরীরদ্বয়ও আঁকড়ে ধরে একে অপরকে। ঐ ছাত্রটির বাবা কর্মসূত্রে বাইরে থাকায় এই বিষয়ে তিনি অবগত হতে পারেন না কোনোভাবেই। সমস্যার সৃষ্টি হয় যখন মিসেস মধুরিমা দ্বিতীয়বারের জন্য সন্তানসম্ভবা হয়ে ওঠেন এবং সেই গর্ভের সন্তান সুবিনয়ের। জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকা পরিস্থিতির মধ্যেই ভূমিষ্ঠ হয় সেই দ্বিতীয় সন্তান; কিন্তু তাকে কোনোমতেই মেনে নিতে রাজি হয় না পৃথ্বীশ বাবু।
দাম্পত্য কলহ চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠতে থাকে প্রায়শই। এরকমই একদিন সন্ধ্যায় সেখানে দেখা করতে যায় সুবিনয়। বেশ তখনই যেনো মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে পৃথ্বীশের। বাদানুবাদ বাড়তে বাড়তে একটা সময় আচমকাই তিনি হাতে তুলে নেন কাটারি, তেড়ে যান সুবিনয়ের দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে সুবিনয়কে বাঁচানোর তাগিদে পৃথ্বীশের মাথায় একটি ভারী বস্তু দিয়ে সজোরে আঘাত করে বসে মধুরিমা। এক ঝটকায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে পৃথ্বীশের নিথর দেহ। কি করবে, কোথায় যাবে, কি হবে অজস্র প্রশ্নের সামনে দাঁড়িয়ে সুবিনয়-মধুরিমা। দুই সন্তানের বড়ো হওয়া, তাদেরকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং সর্বোপরি তাদেরকে একটি সুস্থ জীবন উপহার দেওয়ার উদ্দেশ্যে পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে সুবিনয়। মধুরিমাকে বাঁচাতে গিয়ে পরিস্থিতির শিকার হয়ে সেদিন সে আঘাত করে বসেছিল সুবিনয়কে, আদালতে প্রমাণ হওয়া এই অপরাধের নিরিখে মহামান্য বিচারপতি তাকে চৌদ্দবছরের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করেন। একটা উপন্যাস আবারও ছোটোগল্প হয়েই রয়ে গেল।
জীবন কখনোই আমাদের সাজানো পথে চলে না, আমাদেরকেই বরং বাধ্য হতে হয় জীবনের দেখানো পথে চলতেই। তবুও মানুষ বারবার স্বপ্ন দেখে জীবনকে গুছিয়ে নেওয়ার। হয়তো কিছু জিনিস অগোছালোই থাকা ভালো। সত্যিই তা ভালো কিনা তা তো সময়েই বোঝা যায়! গ্রামের সাদামাটা ছেলে সুবিনয় শিক্ষক হিসেবে শহরে আসে; নাম হয়-পরিচিতি বাড়ে। কিন্তু তারপর? পাহাড়ে ওঠার পথে বীভৎস ধ্বস নামে। জীবন গিয়ে পড়ে এমন এক গভীর খাদে যেখান থেকে উঠে আসা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। নিজের সন্তান অন্যের পিতৃপরিচয় নিয়ে বড় হতে থাকে; নিজের যোগ্যতায় পাওয়া চাকরি হারিয়ে যায় এক ভুলে; গ্রামে বসে থাকা বাবা-মা ছেলের খবর বিশেষ জানতে না পেরে দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। অন্যদিকে মধুরিমা স্বামী-প্রেমিক সমস্ত সম্পর্কের মায়াজালে জড়িয়ে পড়ে আজ রিক্ত হাতে বেরিয়ে পড়ে কেবলমাত্র তার দুই সন্তানদের মানুষ করার উদ্দেশ্যে। জীবন তো এমনই! তুমি যতই সূত্র প্রয়োগ করো না কেন, সে একদিন বেড়া ভেঙেই এগিয়ে যাবে।
সময়ের অন্তরালে মধুরিমার দুই ছেলে এখন জীবনে প্রতিষ্ঠিত। বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, ছোটো ছেলেও চান্স পেয়ে গেছে মেডিক্যালে। সমস্ত আলোর এই বৃত্ত হতে আজ দীর্ঘদিন পর মুক্তি পেয়েছে স
ুবিনয়। জেলে থাকাকালীন একবার এসেছিল মধুরিমা দেখা করতে, তারপর সুবিনয় বারণ করে দেয়। সে কখনোই চায়নি আসলে এরকম একটা নিকৃষ্ট সত্যের মুখোমুখি আসুক তার কোনো সন্তান। বড় ছেলে সমরেশ আজও জানে সুবিনয় তার বাবার খুনী। তাদের মা সত্যিটা বলতে চেয়েও কখনোই বলে উঠতে পারে নি। আসলে তার যে সত্যিই বলার মতন কিছুই নেই আর। সুবিনয় ছাড়া পেয়ে প্রথমেই যায় সেই বাড়ির দিকে যেখানে সে পড়াতে গেছল প্রথমবার সমরেশকে; কিন্তু সেই বাড়ির মালিক বদলে গেছে। নতুন ভদ্রলোক সুবিনয়কে না চিনলেও সেই ঘটনাবলী পাড়াতে শুনেছিলেন আগেই; কাজেই তার পরিচয় পেয়ে একপ্রকার দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলেন। কোথাও তো সত্যিই এখন আর যাওয়ার নেই সুবিনয়ের। হাঁটতে হাঁটতে সে পা বাড়ায় তার সেই স্কুলের দিকে যেখানকার প্রতিটা ছাত্রছাত্রীর নয়নের মণি হয়ে উঠেছিলেন তিনি অতি অল্পদিনেই। আজ সেই দরজাও পুরোপুরি বন্ধ। প্রধানশিক্ষক থেকে শুরু করে কিছু পুরানো সহকর্মী সকলেই একপ্রকার ধিক্কার জানিয়ে সেখান থেকে চলে যেতে বললেন।
মধুরিমা ঐ শহরেই থাকে নাকি অন্য কোথাও থাকে কোনোকিছুই জানা নেই সুবিনয়ের; এমনকি সে আজ ছাড়া পেয়েছে এটাও তো মধুরিমা জানে না। সবমিলিয়ে কেমন যেনো একটা ঘোলাজলের মধ্যে ভাসমান জীবন এই মুহূর্তে। যার জন্য তার এই আত্মত্যাগ সেই সন্তানকে দেখার কি কোনো উপায় মিলবে না? বড্ড অস্থির মনে হচ্ছে নিজেকে আজ তার; এরচেয়ে তো জেলই ভালো ছিল। এরকম ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে সুবিনয় আর সামনে একজন বাইক আরোহী; সজোরে ধাক্কা! রক্তাক্ত দেহ। সঙ্গে সঙ্গে অ্যাম্বুলেন্স কল করে সেই আরোহী নিজেই। যাইহোক চিকিৎসকের তৎপরতায় এইযাত্রা বেঁচে যান সুবিনয়। আসলে সন্তানের সাথে হয়তো বাবার এভাবেই দেখা হওয়ার ছিল!
-জানো মা, আজ একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ হঠাৎ দিকভ্রান্ত হয়ে আমার বাইকের সামনে চলে আসেন। ধাক্কা তো লাগবেই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি এবং সিনিয়র ডাক্তাররা মিলে এই যাত্রায় ওকে বাঁচিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি।
- তোকে কতবার বলেছি আস্তে গাড়ি চালাবি, সাবধানে যাতায়াত করবি, কিন্তু তুই তো কিছুই শুনিস না।
- ওদিক থেকে দাদা জিজ্ঞেস করে, ভদ্রলোক কে? নামধাম জানিস? তার বাড়িতে খবর দিয়েছিস?
- নাম তো শুনলাম সুবিনয় সেন। কিন্তু ধাম সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন নি। আর আত্মীয় তো কেউ নেই বললেন।
-কী নাম? সুবিনয় সেন! তুই ঐ লোকটাকে বাঁচালি যার জন্য আজ আমরা বাবাকে হারিয়েছি?
মধুরিমা একেবারেই স্তব্ধ। মুখ দিয়ে আর কোনো শব্দ উচ্চারণ করার ক্ষমতা তার নেই। সমরেশের চিৎকারের মাঝে একটাই কথা শোনা গেলো, 'বাবু, কাল আমাকে একবার নিয়ে যাবি সুবিনয় বাবুর কাছে?'
- মা, তুমি ঐ খুনীটার কাছে যেতে চাও? লজ্জা করছে না মা তোমার?
- না রে বাবু করছে না। তার কারণ হল ঐ লোকটা সেদিন জেলে না গেলে তোরা মা-বাবা দুজনকেই হারাতিস।
-মানে?
-তোদের বাবা সেদিন ভুলবশত মারা গেছলেন ঠিকই, কিন্তু তা আমার হাতে; সুবিনয়ের হাতে নয়। তাই ঐ লোকটার যে ত্যাগ রয়েছে তার কাছে আমাদের সবকিছুই তুচ্ছ। হ্যাঁ একদিন আমরা দুজনেই ভুল করেছিলাম শিকার করছি, কিন্তু তারপরেও মানুষটার এই ত্যাগের কাছে সবকিছুই তুচ্ছ হয়ে যায়।
ধীরেধীরে নিভে আসে আলো। শিক্ষক সুবিনয় নিতান্তই একজন হারিয়ে যাওয়া চরিত্র যেখানে তার শিক্ষাদান করতে আসার বদলে জুটল এক বাস্তবের শিক্ষা। মানুষের জীবন এক উন্মুক্ত বিদ্যালয়; সেখানে কীভাবে কে কখন শিক্ষা দিয়ে যাবে কেউই বলতে পারে না। শিক্ষক সুবিনয় আজ অতলে তলিয়ে যাওয়া এক মানুষ যার গায়ে চেপে আছে জেল ফেরত এক আসামী যিনি খুনের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন!