আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
আকাশের রঙ ফ্যাকাশে
দ্বাদশ অধ্যায়
সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গল; দেখি বেলা এগারোটা বেজে গেছে । সারা রাত জেগে ভোরের দিকে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি । ফল তো হাতেনাতে ; এখন বেলা এগারোটা। উঠেই বড়দার খোঁজ করলাম । কোথাও দেখতে পেলাম না । বাধ্য হয়ে প্রাত:কৃত্য সেরে বাবলুদার দোকানে গেলাম চা খেতে ।
আমাকে দেখে বাবলুদা বলল - মহাশয়ের কবে আসা হয়েছে ?
- কি যে বল, বাবলুদা ? তোমাদের কাছে কবে থেকে মহাশয় হয়ে গেলাম ?
- আরে ভাই ! সাহেব-সুবোদের ব্যাপার ! কখন যে কি করে বসে বলা তো যায় না ; তাই আগেভাগে 'মহাশয়' বলে সম্বোধন করাই শ্রেয় ।
- কেন ? আমি তোমার কি করে বসব ? নাও , এক কাপ গরম চা দাও তো !
- এই তো বললাম ! কোথায় মান দিয়ে ডেকে নিয়ে গিয়ে আমাকে চা খাওয়াবে ; উল্টে নিজেই চেয়ে বসলে । নাও বস এখানটায় ; আমি নতুন করে চা বানাই।
বসে আছি অনেকক্ষণ । চা আর আসে না । অধীর হয়ে বলি - কি হল বাবলুদা ! এক কাপ চা দিতে ক' ঘন্টা লাগবে ?
বাবলুদা তো এই মারে কি সেই মারে । বলল
- কি এমন বয়স হল তোমার হে ছোকরা ! এখনই চোখের মাথা খেয়ে বসলে ! কবে চা দিয়েছি; টেবিলটার দিকে নজর দেবে তো !
টেবিলে চা তখন ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কেবলই বুকুনের কথা ভেবে মরছি।
বাবলুদা আর এক কাপ চা দিয়ে গেল । বলল - বড়দাকে দেখলাম বি এল আর ও অফিসে যেতে ।
আমি অবাক হয়ে বললাম - বি এল আর ও অফিসে? কেন ?
- ও তুমি জানো না বুঝি ! গেল বছর যে দু'বিঘে জমি কিনেছে তার পড়চা ( মিউটেশন ) করাতে গেছে। বলল নোটিশ এসেছে মুহুরির কাছে। ডেকে পাঠাল তো ঘুরে আসি। ভাই তো ঘুমোচ্ছে , ঘুমাক আর ডিসটার্ব করলাম না ।
বললাম - এই বয়সে এত ছোটাছুটি পোষায় ? দেখ দেখিনি, আমাকে বললেই হত। আমি গিয়ে নিয়ে আসতাম।
বাবলুদা বলল - হয়তো তোমাকে জাগাতে চায়নি । তুমি তো জানোই তোমার বড়দাকে - কেমঞ মানুষ!
বাবলুদাল দোকান থেকে বাড়ীতে এসে দেখি বড়দা এসে গেছেন ।
বললাম - আমাকে বললেই তো হত !
বড়দা মুখের দিকে চেয়ে বললেন - অত হ্যাপা পোয়াতে পারতিস না । দেখ না, কবে গেছি। মুহুরি বিপত্তারণ মণ্ডল এল সাড়ে এগারোটায় । নোটিশ দিয়ে বলল ওটা রেজিস্ট্রি ডাকে দিতে হবে । আর রেজিস্ট্রি খরচ আমাকেই দিতে হবে এবং আমাকেই পোস্ট অফিসে লাইন দিমে রেজিস্ট্রি করাতে হবে । বোঝ কাণ্ড ! আমার নামে নোটিশ, হাতে পেতে গাঁটের টাকা খরচ করে নিতে হবে । সরকারী বাবুদের নাকি তাই নিয়ম।
আমি বললাম - তা কেন হবে ? ওটা তো অফিসের দায়িত্ব!
- আসলে টাকাটা পকেটস্থ করার বন্দোবস্ত আর কি ! এজেন্ট কাটবে, অফিসের বাবুরা খাবে । এটাই আজকাল দস্তুর । যাক গে ছাড় ! আজ কি রান্না হবে বল ? মাংস খাবি?
আমার খাওয়া দাওয়ায় তেমন নেক নেই । বললাম - যা হোক কিছু হলেই চলবে । কিন্তু বড়দা ! কাল আমাকে একবার কলকাতায় যেতে হবে ।
- কেন ? এই তো গতকালই এসেছিস ?
আমি অনেক কিছুই বানিয়ে বলতে পারতাম। কিন্তু বড়দাকে ঠকাতে বিবেকে লাগল । বললাম - আপনাকে তো বলেছি বড়দা ; অবসর জীবনটা টিকটিকিগিরি করে কাটাব ।
- হ্যাঁ তা' তো বলেছিস ! গতকাল অবসর নিলি আর আগামীকালই গোয়েন্দার কাজ পেয়ে গেলি ?
এবার আর তাঁকে অন্ধকারে রাখতে চাইলাম না। একদিন না একদিন তো জানাতেই হবে - তবে আজই নয় কেন ! এতে তাঁর বুদ্ধিটাও ধার নিতে পারব আর আমার রহস্যের জট খুলতে থাকব ।
কিন্তু মানুষ চাইলেই তো পায় না । কথায় আছে ' ম্যান
প্রপোজেস ; গড ডিসপোজেস । আমার বেলায় তার অন্যথা হয় কি ভাবে ?
বড়দা বললেন - তবে চল । আজ বিকেলেই তোর সাথে আমিও চলি । দেখি তোর গোয়েন্দাগিরির কর্মকাণ্ড।
আমি কি বলব খুঁজে পাচ্ছি না । বড়দা চমকে দিয়ে বললেন - বুকুন নামের মেয়েটি রাতে ফোন করেছিল ?
আমি হাঁ করে বড়দাকে দেখছি।
- তুই খুব অস্থির হয়ে আছিস জানি । এটা তোর প্রথম টিকটিকানো ! আমার হেল্প লাগবেই । নে এবার বল তোদের কথা। আগে ভালো করে জেনে নিই।
আর কোন গতি নেই। বলতেই হবে। বললাম - শুনুন তবে।
১৯৭৬ সালে ; মানে যে বছর আমি থার্ড ইয়ারের ফাইনাল দিচ্ছি - আমার সাথে এক ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে আমার পাশে একই বেঞ্চে পরীক্ষা দিচ্ছিল ।
মেয়েটির কথা এবং আমার পরবর্তী পদক্ষেপ সব অকপটে বড়দাকে বলে দিলাম। কিছুক্ষণের জন্য তিনি বেশ গম্ভীর হয়ে গেলেন। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর এই বুকুন নামের মেয়েটির অকস্মাৎ আগমনে তিনি যুগপৎ বিস্মিত এবং ক্ষুব্ধ হলেন ।
গম্ভীর হয়েই বললেন - একটা চমকপ্রদ রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। ঠিক যেমনটি পেয়েছিলাম ক্রিমিনোলজী পাশ করে ' র ' থেকে আহ্বান পাবার পর ।
- আপনি ' র ' এ সার্ভিস করেছেন ?
বিস্ময়ের সঙ্গে বললাম।
তিনি বললেন - কিছুদিনের জন্য গিয়েছিলাম কার্গিল সীমান্তে । যেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর শ'দুয়েক জোয়ান দায়িত্ব পালন করছিল । ক্রিমিনোলজীর উপরে আমার একটা লেখা পড়ে ' র' আমাকে ডেকেছিল ওই সংস্থায় কাজ করতে।
- তারপর ?
- তখন তুই সবে স্কুলের গণ্ডী পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিস ।
- মনে পড়েছে। আমি হোস্টেলে থাকতাম - সেই সময় ।
- হ্যাঁ, ' 'র ' এর ডাক পেয়ে আমি ' না ' বলে দিতেই ওরা যা জানাল তাতে আমার যৌবনে আঘাত করল। আমি যদিও যেতে প্রস্তুত ছিলাম না; ওঁরা বলেছিলেন অন্তত হেল্পটুকু করবেন আশা করি । আপনাকে স্পটে আসতে হবে না। বাড়ীতে বসেই ই-মেইলে পরামর্শ দেবেন প্লীজ ।
আমি রাজী হলাম। ওরা জানালেন কার্গিলের ওই রেজিমেন্ট থেকে কেউ বা কারা প্রতিরক্ষা সুত্র গোপনে পাকিস্তানের আই এস আইকে পাচার করে দিচ্ছে। ফলে আমাদের অপারেশন ফেলিওর হয়ে যাচ্ছে ।
আমি বললাম - এ যে বিশাল ব্যাপার !
- বিশাল মানে ? সাংঘাতিক ব্যাপার! দেশের প্রতি, দশের প্রতি বিদ্রুপ ছাড়া কি ? মেজর সতবন্ত সিং ওইদিন রাত্রে আমাকে ফোনে ঘটনার কথা সবিস্তারে জানালেন। বললেন যদি সরেজমিনে তদন্ত করতে চান তার যথোপযুক্ত বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি । কিন্তু সাবধান! ওরা ভীষণ ধূর্ত শিকারি। নিজের কাজ গুছিয়ে নিতে খুন করতেও দ্বিধা করে না । এই তো সেদিন সেনাবাহিনীর এক গ্রুপ ক্যাপ্টেন রিপোর্ট নিতে এসেছিলেন। সেদিনই তিনি খুন হয়ে যান । আমরা একেবারে নাজেহাল হয়ে গেছি।
আমি বললাম - তারপর কি হল ?
বড়দা বললেন - ওঁকে জানিয়ে দিলাম যে কথাগুলো বলছি মন দিয়ে শুনুন এবং সেইমত কাজ করে দেখুন। সাকসেসফুল হলে ঠিক আছে ; না হলে যেতেই হবে।
আমি তো ভয়ে বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেছি। কলকাতা তো যাব বলে দিয়েছি ; লঙ্কেশ্বর যদি হাতে পেয়ে যান আমার দশা যে কি হবে বুঝতে বাকি রইল না।
( চলবে )
