উপেক্ষা১ম পর্ব
উপেক্ষা১ম পর্ব
নির্মল একটু বেশী বয়সে বেকারত্ব কাটিয়ে একটা হাইস্কুলের শিক্ষকতার চাকরীটা পেয়েছিল। তখন তার বয়স চৌত্রিশ ছুঁই ছুঁই। বিধবা মা হাজার চেষ্টা করুন নির্মল অনঢ় ছিল। বেকার ছেলেদের বিয়ের নাকি বাজার দর নেই।না পণের কথা সে বলত না।শিক্ষিতা সুন্দরী ভালো ফ্যামিলি,এটাই তার অগ্রাধিকার বা চাহিদা। বাড়িতে জমি সম্পত্তি যা ছিল, চাকরী না করলেও চলে যায়, কিন্তু বেকার শিক্ষিত তাই ভালো ঘরে সুন্দরী শিক্ষিতা পাত্রীর সম্বন্ধ আসছিল না।নির্মল কোন মেয়ে দেখতেও যায় নি।
হাইস্কুলের শিক্ষকদের চাকরী সে সময়ে রাজার চাকরী, বামফ্রন্ট সরকার যেন ঢেলে দিয়েছিল। শিক্ষক বন্ধুরা তাদের কমরেড, আর বিধায়কদের একটা বড় অংশ শিক্ষক। বিয়ের বাজারে হাইস্কুল শিক্ষক তখন পাত্র হিসাবে ভালো দর।নির্মলের ভাগ্য ফিরল।রীতিমত সুন্দরী বাইশ বছরের নমিতা বিএ পাস,আবার সচ্ছল শিক্ষিত ফ্যামিলির মেয়ে।আনন্দে আর ধরে না।মাকে খুশীতে বলল "দেখলে মা সবুরে মেওয়া ফলে!"
মা খুশী তবে বলে "বাবা একটু বেশী বয়সে বিয়ে করলে ছেলে মেয়ে মানুষ করা সমস্যা,তাই একটু কম বয়সে বিয়ের ভালো,আমরা বাবা সেকেলে মানুষ "
নির্মল হেসে বলে "মা আমার রিয়েল বয়স চৌত্রিশ কিন্তু বাবা স্বর্গে গেছেন, শত শত প্রনাম, আমার তিন বছর বয়স কমানো আছে। তুমি সত্যিটা যেন নমিতাকে বলো না।ওর সার্টিফিকেট এজ বাইশ, আর ঠিকুজী কুষ্ঠিতেও তাই।"
মা বলে,"পাগল বরং তোর বয়স আরও কমিয়ে বলবি! তোর বাবা সরল সাদাসিদে মানুষ ছিল বয়স বাড়িয়ে ভর্তি করেছিল বলেছি। আর তো কুষ্ঠীতে তাই আছে! ওটা,তোর বোনের জন্ম তারিখ, শুধু তোর নাম বোনের পরিবর্তে পাল্টে দিয়ে বাসু পন্ডিতকে দিয়ে তোর এই ঠিকুজী,কুষ্ঠী করিয়েছি । ওরা বড় সনাতন পন্থি মানুষ, ঠিকুজী ,কুষ্ঠি বিচার না মিলিয়ে বিয়ে দেবে না। কী করব তোর এত পছন্দ আর মীনার ঠিকজী কুষ্ঠিতে কোন ত্রুটি নেই। বাসু পন্ডিত তাই বলেছে।"
একটু হেসে ভারতী বলে,"ছেলেদের আবার ঠিকুজী! তোর বাবা শুধু তোর দুবোন,মীনা আর কল্পনার এসব করেছিল। আমার বাবু এতে এত বিশ্বাস নেই। তা না হলে আমার মেঝ বোনের এত ভালো ঠিকুজী আর কুষ্ঠি, সত্তর বছর পরমায়ু সে কীনা একুশ বছরে মারা গেল!তবু দুদিনের জ্বরে।পেটে তখন চার মাসের সন্তান। আমার আর তাই এ সবে ভরসা নেই।"
নির্মলের মা ভারতী কম বয়সে স্বামীকে হারিয়ে তিন ছেলে মেয়েদের মানুষ করেছিল। স্বামীর জমিজমা দেখভাল করতে,জন মজুরের ভরসাই করত না।নিজে সব ক্ষেত জমি চিনত। আর বাগানে কাচ্ কলা থর মোচা থেকে কাচা আম আমড়া ইচোর পেঁপে সজনে পাতা অবধি সব কিছুই বাড়ির রাখাল দিয়ে গ্রামের হাটে বা বাড়ী বাড়ি বিক্রি করতে পাঠাত। সে সময়ের গ্রামে একদিন হাট,তাই কাগজী বা পাতি লেবু দরকার হলে মানুষ তার বাড়ি গেলে নায্য দাম ছাড়া দিত না। গ্রামেরই মানুষ তাকে আড়ালে বলত, হাড় কঞ্জুষ, পাইকের ।
ভারতী ছিল নির্মলদের বাবার থেকেও বাড়া। বাবার অভাব তাই তাদের বুঝতে দেয় নি।তখন নির্মল ক্লাস থ্রিতে পড়ত বাবা সাপের দংশনে মারা যায়। বোনেরা আরও ছোট। ভারতী একদিকে মা আবার একদিকে বাবা।গ্রামের মানুষ তাকে ভয় পেতো। ভারতী ভীষণ বুদ্ধিমতী আর বাস্তব ধর্মী, সংস্কার মুক্ত, সংসারের কীসে মঙ্গল হবে সেটাই তার অগ্রাধিকার। জীবনযুদ্ধে অনেক ঘা খেয়ে আজ সংসারটা দাঁড় করেছিল। নির্মল মাকে সমীহ করত। আর ভারতীর কথা ছিল চাঁচাছোলা।
নমিতাকে বিয়ে করে নির্মল ভীষণ খুশী,চাকরীর ছ মাসের মধ্যেই বিয়ে। সুন্দরী রূপবতী নমিতাও ছিল স্বামী সোহাগিনী। বাপের বাড়িও সে কম যেত। শাশুড়ির খুব আদরের বৌ। ভারতী কম বয়সে বিধবা হলেও পুত্র, পুত্র বধুর পরস্পর ভালোবাসা সোহাগে খুশী। সংসারে তার সম্মান দাপট ছিল। তার আপন মামী বৌ বেটার পীড়িত সহ্য করতে পারত না। ছুটির দিন দুপুরে ছেলেকে বলত তোরা কপাট খুলে শো।আর নিজে মাঝে মাঝেই কাজের বাহানায় ঘরে ঢুকত। খানিকটা পাহারা আর ঐ নজরদারির মত,আপন বেটা যেন পরের ঘরের মেয়েটাকে সোহাগ আদর না করতে পারে!
নিজের তবু স্বামী জীবিত,আর স্বামী তার পদলেহন করতেও রাজী। তবু তার এ হেন নীচ সংকীর্ণ আচরণে,শান্ত স্বভাবের ছেলেও একদিন বিদ্রোহ করে বাড়ি ছেড়েই পালাল।যদিও তার চাকরীর স্থল বাড়ির থেকে যাতায়াত সুবিধা ছিল।
ভারতীর বড় গুণ, সমাজ সংসার থেকে শিক্ষা নিত।
নির্মলের স্কুলের দুরত্ব কুড়ি কিমির কম নয়।মটোর সাইকেলে যাতায়াত করত, কিন্ত বাড়ি ছাড়ার নাম করত না।নমিতা তো আরও এক ধাপ এগিয়ে।বলত "কে তোমার এত যত্ন করবে! ভাগ্যি করে মা পেয়েছ!"
নমিতার তাই পতি সোহাগ সম্ভব ছিল। বেলা অবধি তারা বিছানা ছড়ত না। ভোরের দিকে যেন তাদের পরস্পরের সোহাগ আদর বেশী বাড়ত। বিবেকহীন নির্মল ছোট থেকেই স্বার্থপর অন্যের মনের খবর রাখে না। ব্যতিক্রম নমিতা। তার পায়ে তেল মালিশ করতে হলেও রাজী।তবে সে আবদার নমিতা করত না।
শোবার ঘরের দরজা খুলত নির্মল সকাল সেই বেলা সাতটায়,আর ভাত খেয়ে স্কুলের জন্য, রওনা দিত নটার একটু পড়ে। মায়ের রান্না ভাত খেতে বিবেকে লাগত না।বৌ যেন শো কেশের পুতুল। ভারতী কিছু মনে করত না,তার স্বভাব আর পাঁচটা মেয়েদের মত নয়,গঠনমূলক, দ্বায়িত্ববোধ, স্বনির্ভর মানুষ। আদুরে নমিতার মোহে নির্মল পাগল, স্ত্রীই ধ্যান জ্ঞান। মাকে ভয় শ্রদ্ধা করত কিন্তু সহানুভূতি দ্বায়িত্ববোধ মায়ের প্রতি ছিল না।যেন এখনও কচি খোকা!
নমিতার বছর ঘুরতেই বাচ্চা হল,পুত্র সন্তান, আর তার তিন বছর পর এক কন্যা সন্তান। বেশ সুখে ছিল। কোন স্থায়ী জন্ম নিয়ন্ত্রণের ব্যাবস্থা তারা নেয় নি! এতে নাকি সম্ভোগের সুখ ষোল আনা যায় না! আবার নিরোধ ট্যাবলেট বা কন্ডোম ব্যবহার করত না,এতে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয়, আর সম্ভোগের সুখও ঠিক মত হয় না।পন্ডিত কিছু সিনিয়র কলিগের কাছে জ্ঞান নিয়ে নমিতার মাসিকের ডেট মেনে, নিরাপদ দিনগুলোতে সম্ভোগ চলত। বেশ চলছিল হঠাৎই, কন্যা যখন সাত ,নমিতার গর্ভে নতুন গর্ভ সঞ্চার হল।অবাঞ্ছিত সন্তান গর্ভপাতের জন্য নির্মল অস্থির। নমিতা কাঁদছিল সংস্কারবাদী সনাতন বাড়ির মেয়ে।গর্ভপাত মহাপাপ। গর্ভপাত সে করবেই না।তার কথা অমান্য নির্মলের সাধ্য নেই।
তৃতীয় সন্তান নমিতার গর্ভে আসার পরেই রেগে দুঃখে নির্মল নিজের জন্ম নিয়ন্ত্রণ ব্যাবস্থা পাকা করে নিল।ডেট কন্ট্রোল নিকুজি করেছে! এবার নিশ্চিন্তে যখন খুশী, যেমন খুশী সম্ভোগ সহবাস, কোন টেনশন দরকার নেই । কিন্তু বিধাতার বিধান, তৃতীয় সন্তান জন্মের পর আর নমিতার রক্ত ক্ষরণ বন্ধ হয় না।হাজার চেষ্টা আর রক্ত সরবরাহ করেও নমিতাকে বাঁচানো গেল না।শিশু পুত্র সন্তান বেঁচে ছিল। ক্ষোভে দুঃখে হতাশায় নির্মল নিজ সন্তানের মুখ দর্শন করে না।
ভারতী অপমানে ধুলো ঝেড়ে দিল! "জানোয়ার ওটা তোর সন্তান। আমার স্বামী মারা যাবার সময় তোর বয়স এগার আর তোর ছোট বোন দুই বছর। আমি একা মানুষ করেছি।"
"আমি পারব না,ওকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসব।"
ভারতীর তখন পঁয়ষট্টি, আর তেমন নিজের উপর ভরসা নেই।নির্মলকে দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলতেই ক্ষেপে আগুন।"নমিতা ছাড়া আমি আমার জীবন আর কাউকে আসতে দেবো না।"
"হতভাগা সে নেই,কত স্মৃতি নিয়ে থাকবি,আমি তো জানি,আমার সমস্যা ছিল, স্বামীর গৃহে স্বামীর সম্পত্তি ভোগ করেছি,আর তিন সন্তানের মাকে কে বিয়ে করবে!আর করলেও ছেলে মেয়েদের সর্বনাশ তাই জীবনে নিজের ত্যাগের বিনিময়ে তোদের মানুষ করেছি।আমি মা বাড়িতেই থাকতাম,তোর শিশু সন্তানদের জন্য তোকে বিয়ে করতে হবে, না হলে আমিও বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়ির পালাব।আমার আর মনের জোর নেই,ক্ষমতা নেই , তোর তিন ছেলে মেয়েদের কে মানুষ করবে!"
"আয়া রাখো,আমি আর বাপ হতে পারব না,কে আমাকে বিয়ে করবে! আর আমার এসবে ইচ্ছা নেই।"
"আয়া গ্রামে কোথায় পাবি! তার দায় দায়িত্ব কী থাকবে! শিক্ষক না তুই মূর্খ, ছেলে মেয়েদের কথা ভাববি না! কেবল সংসার মানে স্ত্রী! আমার ছেলে হয়েও তোর এ শিক্ষা!"
"কিন্তু মা আমার মন ভেঙ্গে গেছে আমি নমিতা ছাড়া কিচ্ছু ভাবতে পারছি না।" নির্মলের হতাশ বিষন্ন মুখে দুচোখ জলে ভরে যায়। নমিতার মোহে আজও সে পাগল।
"বিয়ের পর সন্তান হলে সংসার পরিপূর্ণ হয়,সংসার একটা মিশন,তার জন্য ত্যাগ শেখ।বিয়ে তোকে করতেই হবে।তোর কচি ছেলেটাকে মানুষ আমি করতে পারব না।আর কাজের মানুষ এসব ঝক্কী চিরকাল নেবে না।আমার বয়স হয়েছে ,আমি মরলে সংসারটাই ভেসে যাবে। আমি কিন্তু ঘটক লাগিয়েছি। "
নির্মল হতাশায় রেগে বলে "পরে অশান্তি হলে তুমি সামলাবে, আমি কোন দ্বায়িত্ব নেবো না।"
"বাহাদুরী করে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হবার দরকার নেই।তোর আর বাপ হবার ক্ষমতা নেই,সেটা নতুন বৌকে বলবি না,সে বুঝবে কী করে! তোর বাচ্চা হয়েছে,তাই আর বাচ্চা না হলে নিজেকেই বাঁজা ভাববে।তবে সব মেয়েদের মা হবার ইচ্ছা থাকে, এখন কিছু নচ্ছার বাদ দে,তারা মায়ের মর্ম আর মা হওয়ার গর্ব কী বোঝে! তোর নতুন বৌ যেন না বোঝে তোর দোষে বাচ্চা হচ্ছে না, নিজের দোষ ভাবলে, দুঃখ হবে, কিন্তু মনে বঞ্চনার কষ্ট কম হবে।কত মেয়ে তো বাঁজা হয়।আর ফুলের মত এক শিশু পাবে, তাকেই ছেলে মত মানুষ করুক না! মায়ের সখ মিটে যাবে।"
নির্মলের এ সব মিথ্যাচার ভালোলাগে না,কিন্তু মায়ের উপর কথা বললেই অশান্তি।তার বিয়ে করাই ইচ্ছা নেই।নেহাত সন্তানদের জন্য বিশেষ করে কচিটা, তাকে দেখলেই তার কেমন অসহ্য লাগে। নমিতাকে সে গর্ভপাত করতে বলেছিল,
"সব ভাগ্য, আর ওরই বা জন্মে লাভ কী হল! মা হারা,হতভাগা। নমিতার মৃত্যু ঘন্টা বাজাতে এল!"
নির্মল এতটাই স্বার্থপর অবিবেচক নিজের জীবনের বিরহ যন্ত্রণা একাকীত্ব নিঃসঙ্গতা নিয়ে বিব্রত ছিল। শিশুটির সে বাবা সেই দ্বায়িত্ববোধ যেন ভুলে যেত।নমিতার মৃত্যুর কারণ সদ্যোজাত শিশু! এমন ভ্রান্ত ধারনা তাকে পাগল করত।নমিতার শত স্মৃতি আর আনন্দ ঘন মুহূর্ত তাকে পাগল করে তুলত। রাতে বিছানায় শুয়ে স্মৃতির সাগরে ডুবে যেতো।এক যেন মানসিক বিকার!
স্বাভাবিক জ্ঞান হারিয়ে অসহ্য লাগত। শিশুটির কত বড় সর্বনাশ হল। বাবা হিসাবে ভাববার সে অবকাশ পেতো না। একটা সাময়িক সর্বক্ষণের আয়া ছিল,আর তার ঠাকমার সজাগ নজরে শিশুটি বড় হচ্ছিল।
বেশীদিন তাকে মাতৃহারা থাকতে হয়নি। গর্ভধারী না হোক, এক পালিতা মা পেয়েছিল। সৎমার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে এক রহস্য, ভালো, কখনও মন্দ। পালিতা মা যেন জীবিকা,অর্থ নিরাপত্তা আর সুরক্ষিত ভবিষ্যতের ভরসায় সন্ধ্যা সেদিন তার মৃত সতীন নমিতার কচি সন্তানটিকে পরম যত্নে বুকে তুলে নিয়েছিল।
কোন সামাজিক বিয়ে নয়, নিমরাজী নির্মল সন্ধ্যাকে রেজিস্টারী ম্যারেজ করে। সন্ধ্যার নিজস্ব কোন সায় থাক বা না থাক! তাকে সব মেনে নিতে হয়েছিল বা তাকে বাধ্য করা হয়েছিল।
চব্বিশ বছরের সন্ধ্যার মা কম বয়সে স্বামীকে হারিয়ে দুর সম্পর্কের তার এক কুটুম্ব বাড়িতে আশ্রয় পায়।পরিচালিকা রাধুনী সব কাজ করত।বিশ্রাম ছিল না প্রায়।দুর্ভাগা মায়ের বড় মেয়ে সন্ধ্যা তখন নয় বছরের,ছোট ছেলে গোপাল তখন তিন বছর। গোপাল এখানে তার দুর সম্পর্কের কুটুম্ব বাড়িতে,দেড়বছর পর বাড়ির পাশেই পুকুরে ডুবে মারা যায়। সন্ধ্যার তখন বয়স পনের,নাইনে পড়ে, মা হাজার কষ্টে মেয়েকে পড়াত।তখন একদিন মা মারা গেল।গলা দড়ি দিয়ে নাকি আত্মহত্যা! সন্ধ্যা আজও তার বিশ্বাস মাকে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল।তার কুটুম্ব বাড়ির কোন পুরুষ সদস্যের সম্মান বাঁচাতে। এক কিশোরী তার একমাত্র আপনজনকে হারাল।সন্ধ্যা সেদিন খুব কেঁদেছিল। তার মুল্য কিছুই ছিল না।
সন্ধ্যা পড়াশোনা ছেড়েছিল। তার দুর সম্পর্কের কুটুম্ব বাড়ির দাসী বা ভালো ভাষায় পরিচালিকার কাজ শুরু করল। বঞ্চনা লঞ্ছনা আর নিরাপত্তা হীনতায় তার দীর্ঘ ন বছর পর যখন নির্মলের বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে যায়,এক ঘটক। বিনা পণ,বিনা বিবাহের আয়োজন ,সন্ধ্যার ঐ কুটুম্ব বাড়ির বড়রা তৎক্ষণাৎ রাজী।কারণ, সন্ধ্যার রং কালো হলেও শরীর স্বাস্থ্য ভালো। তার মায়ের মৃত্যুর কারণ তারা জানত, লোভে বা প্রলোভনে বা পদস্খলনে তার গর্ভে সন্তান এসেছিল।
তাই তাকে পৃথিবী থেকেই সরে যেতে হল। খুনী কুটুম্ব পরিবারকে এজন্য অনেক খরচ করতে হয়েছিল।পুলিশ এসেছিল। তাদের ঝুলির মাপ নির্ভর করে, সচ্ছলতা আর অপরাধের মাত্রা সঙ্গে শান্তি ধরন অনুসারে। ভালোই খেঁচেছিল,এই ভয়ে কুটুম্ব পরিবারের গার্জেন সন্ধ্যার জন্য যেচে আসা এমন পাত্রকে হাত ছাড়া করেনি। আর যাই হোক আপদ বিদেয় হলে,ও আর এ বাড়ী ফিরবে না। খাবার অভাব হবে না।ভারতীর সাথে কথা বলে সেটা নিশ্চিত ছিল। আবার অঘটন হলে পুলিশের হয়রানি আর টাকার শ্রাদ্ধ! সন্ধ্যার প্রতি আবার যদি বুড়োটার নজর পড়ে ! বাড়ির গিন্নি তাই খুব বিচলিত ছিল, সন্ধ্যাকে নজরে রাখত,তার জীবন বা ভবিষ্যত নয়! সংসারের বিপদ যেন না ঘটে।
নির্মল মেয়ে দেখেনি।ঘটকের সাথে ভারতী, সন্ধ্যাকে দেখতে যায়। গতর আছে। শরীর স্বাস্থ্য ভাল, বয়স চব্বিশ আর পিছুটান হীন।যেমন খুসী শোষন নির্যাতন করো,পিছনে দাঁড়ানোর কেউ নেই। এমন মেয়েকে তার কচি নাতির পালিতা মা করার চেয়ে আর কী চাই!এ তো সোনার সোহাগা !সদ্যোজাত নাতীকে কতটা এই কাঙ্গাল অনাথ দাসী মেয়েটা ভালোবেসে আপন করে নেয় তার উপর হিসাব নিকাশ করে ভারতী ,ভবিষ্যতে সন্ধ্যার গুনাগুন মূল্যায়ন করবে ।
নির্মল আগেই বলে দিয়েছিল আর সে টুপি পড়ব না, গলায় মালা পড়ব না, মালা বদল করব না। ভারতী সবেতেই রাজী।আর সন্ধ্যার কুটুম্ব আশ্রয় দাতা কাম মুনিব বা প্রভু ভারী খুশী, কোন খরচ করতে হবে না।যা কিছু পোষাক আশাক গহনা ভারতীর খরচ। নির্মল না সাজুক মালা না পরুক, নমিতা,সন্ধ্যাকে বিয়ের দিন অনেক খরচ করে ফুলের মালা, চন্দন, কাজল স্নো পাউডার সেন্ট দামী কাপড় ব্লাউজ অনেক কিছুর সঙ্গে এক কণে সাজানো অভিজ্ঞ মহিলার সৌজন্যে সন্ধ্যাকে বেশ সাজিয়ে ছিল। কালো হোক, মুখ চোখ ভালো,লম্বা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি, সুগড়ন,শরীর স্বাস্থ্য ভালো, দেখতে তাই ভালোই লাগছিল।
মুখ নামিয়ে সন্ধ্যা সেদিন যেন লজ্জা ভয়ে অজানা গৃহে, অচেনা পরিবেশ, নীরবে জড়সড়ো হয়ে বসে। থমথমে অনিশ্চয়তা আর সংশয়ভরা তার মলিন মুখ। মাঝে মাঝেই শাশুড়ির নানা নির্দেশ আদেশ আর উপদেশ।ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে শুনছিল নীরবে ইশারায় সম্মতি দিচ্ছিল,বা মৃদুস্বরে পালনের অঙ্গীকার করছিল।
