তিথি তাথৈ
তিথি তাথৈ


সে বহুদিন আগের কথা, পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের ধারে ছিল এক গ্ৰাম আজবগাও। গ্ৰামটি দেখতে আর পাঁচটা গ্ৰামের মতো হলেও সেই গ্ৰামে ছিল না কোনো পুরুষ, কিশোর বা বাচ্চা ছেলে। আসলে ঐ গ্ৰামের পাশে বন আর পাহাড় তার ওপারে ছিল এক মরুভূমি। সেখানে থাকত এক ডাইনি-বুড়ি। সে একবার এই গ্ৰামের যে কোনো একটি ছেলেকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু গ্ৰামের কেউ ডাইনীকে বিয়ে করতে রাজি ছিল না। তখন ডাইনী গ্ৰামের সব পুরুষদের ইঁদুর বানিয়ে নিজের সাথে নিয়ে চলে গেছিল ঐ মরুভূমির দেশে।
তিথি আর তাথৈ গল্পটা শুনে আসছে ছোট থেকেই, ওরা যখন মায়ের পেটে ঘটনাটা তখন হয়েছিল আসলে। ওরা দুই যমজ বোন জন্ম থেকেই বাবা কে দেখেনি তাই । সকালে উঠে ওরা মায়ের সাথে ফুল তোলে , মালা গাঁথে, ওদের মা যখন ক্ষেতের কাজে যায় ওরা ঠাম্মির সাথে ফুল আর মালা বিক্রি করতে বের হয়। গ্ৰামের সব মেয়ে বৌরাই কাজ করে, কুমোর বৌ মাটির জিনিস বানায়, তাতি বৌ কাপড় বোনে, জেলে বৌ মাছ ধরে, ধোপানী কাপড় কাচে, বেনে বৌ দোকান খোলে। গুরুমা পাঠশালায় পড়ায়, ঠাকুর বাড়িতে পুরোহিতের বৌ মন্দিরের পূজা করে। কিন্তু কারো মুখে হাসি নেই। আনন্দ নেই কোথাও। গ্ৰামের কোনো ছোট শিশুকেও ছাড়েনি ডাইনী-বুড়ি। তিথি তাথৈয়ের এক দাদা ছিল তিতাস। তাকেও ধরে নিয়ে গেছিল ডাইনী-বুড়ি।
এদিকে রোজ রাতে ওদের মা কাঁদে, গ্ৰামের সবার মনেই দুঃখ। ঠাম্মি ওদের বলেছিল ডাইনী ভীষণ দুষ্টু। কিন্তু মেয়েদের সে কিছুই করতে পারে না। ওর জাদু শুধু ছেলেদের উপর চলে। একদিন তিথি তাথৈ ঠিক করল ওরা দুজন যাবে ডাইনী-বুড়ির বাড়ি । ছাড়িয়ে আনবে বাবা দাদা আর গ্ৰামের সবাইকে।
কিন্তু ওরা জানত মা আর ঠাম্মী ওদের যেতেই দেবে না। তাই চুপিচুপি ওরা তৈরি হচ্ছিল ওদের অভিযানের জন্য। কিছু শুকনো খাবার আর জল নিয়ে একদিন মাঝ রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ল ওরা চলল ঐ মরুভূমির দেশের সন্ধানে। ওরা এতদিন শুধু গল্পই শুনেছে ঐ দেশের। গ্ৰামের শেষ সীমায় মাঠ পার হলে এক বিশাল বন। সেই বনের শেষে একটা পাহাড়ি নদী, নদীর ওপারে পাহাড় আর পাহাড় পার হলেই মরুভূমি।
তিথি তাথৈ যখন বনের ধারে এলো তখন রাতের শেষ প্রহর। তিথি ভয়ে ভয়ে বলল
-'' রাতের বেলায় বনের মাঝে
হরেক পশুই জেগে আছে
ওরা মোদের গন্ধ পেলে
আসবে ছুটে সবাই মিলে।
অপেক্ষা তাই করতে হবে,
দিনের আলোই পথ দেখাবে ।''
তাথৈ চারদিক ভালো করে ঘুরে দেখে বলল
-'' পশু পাখি দেখতে না পাই,
ক্লান্ত এখন ওরা সবাই।
সারাটা রাত শিকার করে
জল খেতে যায় নদীর ধারে।
বন এসময় শান্ত ভীষণ
নেই পশুরা বনে এখন
ভোর হতে আর একটু দেরি
এই ফাঁকে চল তাড়াতাড়ি "
তাথৈয়ের কথায় তিথি তাড়াতাড়ি এগিয়ে চলে। সে এক গহীন বন। কিন্তু বন্য জন্তু তেমন চোখে পড়ে না ওদের। বনের শেষে একটা বুড়ো বট গাছের কোটরে ওরা লুকিয়ে থাকে। একটু পরেই পূব আকাশে গোলাপি রঙ লাগতেই সব পশুরা বনে ফিরে যায়। ওরাও এবার গাছের কোটর থেকে বেরিয়ে আসে।
দুজনের খুব খিদা পেয়েছিল। ওদের পুটলি থেকে ওরা চিড়া গুড় আর নাড়ু বের করে খেতে বসে। এমন সময় একটা বুড়ো হনুমান ওদের পাশে এসে ধুপ করে বসে। হনুমান টাকে দেখে মনে হয় অসুস্থ আর ক্লান্ত। ওরা তাড়াতাড়ি হনুমানকে খাবার আর জল দিয়ে সুস্থ করে।
হনুমান হঠাৎ মানুষের গলায় বলে ওঠে
-'' গহীন বনের ধারে দেখি
ছোট্ট দুটি মেয়ে
একা একা যাচ্ছ কোথায়
বনের এ পথ দিয়ে?''
তিথি আর তাথৈ বলে ওঠে
-''বনের শেষে পাহাড় পারে মরুভূমির দেশ
সেইখানেতেই বালির গুহায় ডাইনি-বুড়ির বাস
মোদের গ্ৰামের সকল পুরুষ বন্দী সেখানে
বাবা, দাদা, সবাইকে সে ইঁদুর করেছে।
ফিরিয়ে আনব সবাইকে যে
এই করেছি পণ।
তিথি তাথৈ নাম যে মোদের
মোরা যমজ বোন ''
হনুমান তখন ওদের বলে ঐ ডাইনী খুব সাংঘাতিক, পথও খুব দুর্গম। তাই তাকেও সঙ্গে নিতে। ওরা হনুমানকে সাথী করে এগিয়ে চলে নদীর ধারে।
কিন্তু নদীতে যে প্রচুর কুমির। ওরা ভেবেই পায় না কি করে পার হবে। হনুমান চারদিক ভালো করে দেখে এসে বলে উত্তর দিকে নদী যেখানে পাহাড় থেকে নেমেছে সেখানে একটা দড়ির সাঁকো আছে। হনুমানের সাথে ওরা সেই দিকে এগিয়ে যায়।
দড়ির সাঁকোর উপর একটা বড় ঈগল পাখী পড়ে ছটফট করছিল। ওরা ওকে খাবার খাইয়ে জল খাইয়ে সুস্থ করে। সব শুনে ঈগল পাখীও ওদের সাথেই যেতে চায়। ওরা পাহাড়ের নিচে এসে দাঁড়ায়। কিন্তু পাহাড় যে বড্ড খাড়াই।
ঈগল পাখি এক চক্কর ঘুরে এসে ওদের বলে আরও উত্তরে গেলে পাহাড়ের মাঝে একটা শুকনো নদীর খাত আছে, সেই পথে পাহাড় পার হওয়া যাবে। ওরা ঈগলের পেছন পেছন সে পথে চলে। রাতটা পাহাড়ের এক গুহায় কাটিয়ে দুই বোন আবার হাটতে শুরু করে। এবার ওরা এসে পৌছায় মরুভূমির দেশে। যেদিকে তাকায় ধুঁ ধুঁ বালিয়াড়ি আর কাঁটা গাছ। যত দূর চোখ যায় শুধু বালি আর বালি। কোথায় আছে ডাইনী-বুড়ির গুহা কে জানে।
এমন সময় ওরা দেখে একটা বুড়ো উট পরে রয়েছে ঝোপের ধারে। ওদের কাছে যেটুকু জল ছিল আর খাবার ছিল ওরা উটকে দিয়ে দেয়। উট একটু সুস্থ হয়ে সব শোনে। তারপর ওদের বলে সে ওদের পৌঁছে দেবে ডাইনী-বুড়ির গুহায়। কিন্তু ডাইনী-বুড়ি বড়ই সাংঘাতিক। আর ওর গুহার চারদিকে প্রচুর বিষাক্ত সাপ রয়েছে।
ঈগল পাখি বলে
-''সাপদের কথা ভাবব আমি,
চল আমায় নিয়ে
তোমরা দু বোন একটু দাঁড়াও
দেখছি আমি গিয়ে।''
ঈগল আকাশে উঠে এক চক্কর দিতেই ঝাঁকে ঝাঁকে ঈগল নেমে আসে ওর ডাকে। আর উটের পেছন পেছন গিয়ে ওরা পৌঁছে যায় ডাইনীর গুহায়। ঈগলরা বিষাক্ত সাপদের শেষ করে দেয়। এদিকে উট ফিরে আসে তিথি আর তাথৈয়ের কাছে। মরুভূমির গরম বালিতে হেটে ওদের দু বোনের কচি পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। উট ওদের বলে -
''মেয়েরা আমার পিঠে বসো
মরুর জাহাজ আমি
পৌঁছে দেবো বুড়ির গুহায়
কষ্ট হবে না জানি।''
ওরা উটের পিঠে বসে এগিয়ে চলে। ওদের পিছনে লাফিয়ে চলে বির হনুমান। এদিকে মরুভূমির গরমে ওদের সবার খুব জল তেষ্টা পায়। খিদেও পায়। কিন্তু খাবার আর জল তো শেষ। হনুমান ওদের জন্য অল্প জল এনেছিল খুঁজে খুঁজে। সবাইকে সে জল খাইয়ে তিথি দেখে বোতলের নিচে কয়েক ফোটা জল রয়েছে। তিথি তাথৈ কে বলে জলটা খেতে। তাথৈ শুকনো ঠোঁট জিহ্ব দিয়ে চেটে তিথিকেই বলে জলটা খেতে। কিন্তু তখনি ওরা কাটা ঝোপের ধারে একটা ময়ূর দেখতে পায়। ময়ূরটাকে দেখেই মনে হচ্ছে খুব অসুস্থ, পুটলি হাতড়ে কয়েক দানা খাবার আর জল টুকু ওরা ময়ূর কে দেয়। একটু সুস্থ হয়ে ময়ূর সব শোনে। তারপর মানুষের গলায় বলে
-''মনটা তোদের ভীষণ ভালো
করবি তোরা জগৎ আলো
এই নে আমার পেখম খানি
ডাইনী এবার জব্দ জানি
আমি তোদের সঙ্গী হব
মন্ত্র তোদের শিখিয়ে দেবো
সকল পুরুষ ফিরবে ঘরে
ডাইনীর জাদু যাবে উড়ে ''
নিজের পেখম থেকে ওদের তিনটে পালক দিয়ে ময়ূর চলল ওদের সাথেই। পথে ওদের এক মন্ত্র শিখিয়ে দিল।
এমন সময় ওরা দেখল একটা বড় বালিয়াড়ির মাঝে বিশাল এক গুহা। চারপাশে সাপ মরে পড়ে রয়েছে।
ময়ূর বলল এবার ওদের একাই যেতে হবে। উট ঈগল হনুমান আর ময়ূর বিদায় নেবে। কারণ ডাইনী এমন জাদু করে রেখেছে কেউ আর এগোতে পারবে না। সবাইকে বিদায় জানিয়ে ওরা তো পালক হাতে ভাবছে এবার কি হবে ?
ওরা যেই গুহায় ঢুকতে যাবে এক ভয়ংকর দেখতে কুজ ওয়ালা বুড়ি বেরিয়ে এলো। বুড়ির চুল গুলো সব
বিষাক্ত সাপ দিয়ে তৈরি, নখ গুলো চাকুর মত ধারালো, দাঁত গুলো বর্ষার ফলার মত তীক্ষ্ণ। চোখ যেন আগুনের গোলা।
তিথি আর তাথৈ এত ভয়ংকর কাউকে কখনো দেখেনি। দুজনেরই ভয়ে বুক শুকিয়ে গেছিল। তাথৈ তিথির কানে কানে বলল
-''পাস না রে ভয় বোনটি আমার
মন্ত্র মনে রাখ শুধু
মেয়েদের উপর ডাইনী-বুড়ির
খাটবে নাক কোনো জাদু।''
ডাইনী যেই ওদের দিকে এগিয়ে এলো ময়ূরের কথা মত ওরা দুজন দুটো ময়ূরের পালক ছুড়ে মারল, আর মন্ত্র বলতে শুরু করল। অমনি ডাইনীর সারা গায়ে আগুন লেগে গেল। মুহূর্তের মধ্যে ডাইনী পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আর গুহা থেকে বেড়িয়ে এলো শয়ে শয়ে ইঁদুর। ময়ূরের শেখানো মন্ত্র বলে ওদের গায়ে পালক বুলাতেই সবাই নিজেদের রূপ ফিরে পেল আবার। কিন্তু এত লোকের ভিড়ে ওরা তো বাবা আর তমাল দাদা কে চিনতেই পারে না।নানা বয়সের পুরুষের ভিড়ে ওরা বাবা আর দাদাকে চিনে নিতে চায়।
পুরুষরা সবাই তো দুটো ছোট্ট মেয়েকে এভাবে দেখে অবাক। এত ভয়ঙ্কর ডাইনী-বুড়ির সাথে লড়াই করেছে এই মেয়ে দুটো!! সবাই ওদের অনেক আদর করে, ওদের নাম জিজ্ঞেস করে, বাড়ি কোথায় জানতে চায়।
দুই বোন একটু হেসে বলে উঠে
-''তিথি তাথৈ দু বোন মোরা
আজব গায়েই বাস
ডাইনী সেথায় করেছিল
ভীষণ সর্বনাশ।
পুরুষদের কে ইঁদুর করে
আটকে রেখে দেয়
তিতাস দা আর বাবার খোঁজে
এলাম মোরা তাই।
ডাইনী-বুড়ি ধংস হল,
বাবা দাদা কই?
গায়ের পানে ফিরে চল
চিন্তা কিছুই নাই।"
অত পুরুষের ভেতর থেকে এক কিশোর আর একটি লোক এসে ওদের কোলে তুলে নেয়। মুখ দেখেই ওদের মনে হয়েছিল এই দুই মেয়ে ওদের আপন কেউ হবে। বাবা আর দাদার কোলে চড়ে গ্ৰামের সবাইকে নিয়ে ওরা ফেরার পথ ধরে।
পথে দেখা হল চার পরীর সঙ্গে যারা ওদের গ্ৰামকে পাহারা দিত। ওদের আসলে ডাইনী-বুড়ি হনুমান, ঈগল, উট আর ময়ূর করে রেখেছিল। ডাইনী বুড়ি মরে যেতেই ওরা নিজেদের রূপ আর শক্তি ফিরে পেয়েছে আবার। চার পরী ওদের জাদু করে গ্ৰামে পৌছে দিল তক্ষুনি। আর বর দিল গ্ৰামে আর কোনো দুঃখ থাকবে না।
এদিকে ওরা তো ঘুমের মাঝে রাতের বেলায় কাউকে কিছু না বলে চলে গেছিল। ওদের খোঁজে ওদের মা সারা গ্ৰাম তোলপাড় করেছে। গ্ৰামের সব মহিলা বুড়ি বাচ্চারা ওদের খুঁজতে বেরিয়ে ছিল। গ্ৰামের বাইরের মাঠেই ওদের সাথে সবার দেখা হল। দুটো বাচ্চা মেয়ে যে একা একা সব পুরুষদের ফিরিয়ে আনবে কেউ ভাবেই নি। ওদের সাহস দেখে সবাই ধন্য ধন্য করল। বহুদিন পর সব পুরুষরা ফিরে আসায় গ্ৰামে উৎসব শুরু হল। সব আনন্দ আবার ফিরে এলো।