STORYMIRROR

Bula Biswas

Action Inspirational

3  

Bula Biswas

Action Inspirational

#সফল সংগ্রামী

#সফল সংগ্রামী

6 mins
184


      খেলা পাগলমেয়ে মল্লিকাদি'কে আমাদের স্কুলের গেম টিচার ওকে ভীষণ ভালোবাসতেন। স্কুলে যখন স্পোর্টস হত, মল্লিকা দাস প্রায় সব খেলাতেই ভিত্তিস্ট্যাণ্ডে একেবারে এক নাম্বারে দাঁড়াতো। বিশেষ করে রান রেস, রিলে রেস, শর্টপাট, লং জাম্প সবেতে সবেতে সবেতে দিদি একেবারে চ্যাম্পিয়ন। তাছাড়া ব্যাণ্ডে ওইই বড় ড্রামটা বাজাতো। পি টি, ড্রিল, যোগ ব্যায়াম সবেতে ওর ধারে কাছে কেউ এগোতে পারতো না। ছোটবেলায় ও যখন ওর মামাদের গ্রামের বাড়িতে থাকতো, নিয়ম করে প্রতিদিন ও দাদাদের সাথে মাঠে ফুটবল খেলতে যেতো। ওর দাদারা পিসাকে বলেছিলো, পিসা মলি খুব ভালো ফুটবল খেলে। ভালো কোচের হাতে পড়লে দেখো একদিন ও খুব বড় ফুটবল প্লেয়ার হবে। মল্লিকার বাবা সেদিন খুব হেসেছিলেন। বলেছিলেন, 'ঠিক বলেছিস। ভগবান ওকে ছেলে বানাতে বানাতে মেয়ে বানিয়ে ফেলেছে। তোরাই ওকে ট্রেনিং দে।' সেভাবে কোনো কোচের কাছ থেকে ও ট্রেনিং পায় নি। 

কোলকাতায় এসে সকাল বেলায় ও যখন মাঠে দৌঁড়াতে যেত, মাঠে অনেক মেয়েরা ফুটবল খেলতো। ও দাঁড়িয়ে দেখতো। ওর আগ্রহী চোখ খেলার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকতো। ওরাই ওকে দলে নিতো। বলা যায় ও যেন অ্যাথেলিট হয়েই জন্মেছে। ও বয়সে আমাদের থেকে বড় ছিলো। আমরা যখন সিক্সে, মল্লিকাদি নবম শ্রেণিতে। 

যখন কোনো কমপিটিশন থাকতো, গেম টিচার সুলেমান স্যার, আমাদের গেম পিরিয়ডে, বড়দির কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে মল্লিকাদিকে মাঝেমাঝে সাথে করে ওনার ক্লাসে আনতেন। কারণ এক একটা সেকশনে এত মেয়ে, স্যার একা সামলাতে পারতেন না। স্যার ও সাথে মল্লিকাদি দু'জনে মিলে আমাদের খেলার পিরিয়ড বেশ সুষ্ঠুভাবে চলতো। তাছাড়া স্পোর্টস এর আগে থেকে মল্লিকাদি আমাদের প্র্যাক্টিস করাতো। 

এহেন অ্যাথেলিট মল্লিকাদির বাড়ির অবস্থা ভালো ছিলো না। দিদি বাড়ির বড় মেয়ে। ওর আরো ছয় ভাই বোন ছিলো। বাবা বেশ অসুস্থ। একটা প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরি করতেন। অসুস্থতার কারণে বুড়ি ছোঁওয়াটা পর্যন্ত করতে পারেন নি। অর্থাৎ রিটায়ার করার বহু আগে ভিআরএস নিয়ে নিয়েছিলেন। যে টাকা পেয়েছেলেন, তার সুদে সংসার চলে। বাড়িটা অবশ্য নিজেদের। সেটাই যা রক্ষে ছিল। 

এসব বলার অর্থ হলো একটাই, মল্লিকাদি যে পরিমাণ খেলাধুলা করতেন, তার জন্য ভালো খাওয়ার দরকার ছিলো। সেটা ও সেভাবে পায়নি। তাই বলে ও দমে যায় নি। 

ওর খুব ইচ্ছে ছিলো, পি টি ঊষার মত ও খুব বড় অ্যাথেলিট হবে। এর জন্য চাই পর্যাপ্ত খাবার ও অর্থের জোড়। এ দুটোই ওর ছিলো না। 

ছিলো শুধু মনের অদম্য জোর।

ও খুব ভোরে উঠে দৌঁড়াতে যেতো। ট্রাক শ্যুট পড়ে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তো। ওর দৌঁড় শুরু হতো, কখনো রেসকোর্সের পাশ দিয়ে সোজা গড়ের মাঠ। কখনো পিটিএসের পথ ধরে ভিক্টোরিয়া। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলে, রাস্তার কল থেকে দুহাত ভরে জল পান করতো।

বাড়িতে এসে কখনো বাসি রুটি, কখনো মুড়ি, কখনো বা পান্তা। তারপর স্কুল। 

পরিবারের আর্থিক দুরবস্থার জন্য ওকে টিউশন করতে হতো। 

যা পেতো প্রায় সবটাই মায়ের হাতে তুলে দিতো। এভাবেই ওর জীবন চলছিলো। 

মল্লিকাদি দেখতে একেবারেই ভালো ছিলো না। গায়ের রং বেশ কালো। আর এত কঠোর পরিশ্রম করতে করতে ওর মেদবিহীন একটা পুরুষালি চেহারা তৈরি হয়ে গিয়েছিলো। 

মল্লিকাদি'র মায়ের খুব চিন্তা। ওর বিয়ের বয়স হচ্ছে। কিন্তু বহু পাত্রপক্ষ ওকে দেখে বাতিল করেছে। 

মল্লিকাদি কিন্তু মনে মনে হাসতো। কারণ একসাথে কাজ করতে করতে স্যারের সাথে খুব ধীর গতিতে ওর মন দেয়া নেয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। 

সুলেমান স্যারও ওর প্রতি কেমন দূর্বল ছিলেন। তিনি অবশ্য ওকে বারেবারে বলেছেন, এভাবেই হয়ত ওদের সারাজীবন চলতে হবে। দুটো ভিন্ন জাত। সুলেমান স্যারের তিনকুলে কেউ নেই। মল্লিকাদি'কে গ্রহণ করতে তাঁর কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু স্যার ভালো করেই জানেন, মল্লিকার মা বাবা এই বিয়েতে গররাজি হবেন। মল্লিকাদি এ সব বোঝেন। তবুও কেমন নাছোড়বান্দা যেন! 

বয়সের দোষ বড় দোষ। একদিন ভোর বেলা মল্লিকাদি দৌঁড়াতে গিয়ে আর ফেরেনি। 

মল্লিকাদির বাবা মা স্যারের সাথে ওর সম্পর্কের কথা আবছা আবছা জানতেন। কিন্তু তাঁরা এটাকে ভালো চোখে দেখতেন না, কিম্বা ওকে প্রশ্রয়ও দিতেন না। বরং রাগারাগি করতেন। 

মল্লিকাদি চুপ থাকতো। 

ওর বাবা মা সেদিন বেশ দুঃখ পেয়েছিলেন। থানা পুলিশ করার মুখ তাঁদের নেই। ওঁরা একেবারেই চুপ করে গেছেন। লোক জানাজানি যাতে না হয়, তাই এই ব্যবস্থা। 

ঠিক তার তিনদিন বাদে মল্লিকাদি একা বাড়ি ফেরে। ওর কিরকম সাজ পোশাক দেখে ওর মা ডুকরে কেঁদে ওঠেন। ওর বাবা পাশ ফিরে শুয়ে চোখটা বন্ধ করে রাখলেন। মল্লিকাদির দু হাত ভর্তি কাঁচের চুড়ি, নাকে নাকছাবি, শালোয়ার কামিজ আর ওড়নায় নিজেকে আবৃত করে ঘরে এসে ঢোকে। 

ঘরে ঢুকেই ওর অতি চেনাপরিচিত পরিবেশটার আমূল পরিবর্তন দেখে ওর অন্তরাত্মা ক্ষণিকের জন্য কেঁপে উঠেছিল। মা, বাবা, ভাই বোন কেউ ওর সাথে একটি কথাও বলে নি। ওর নিজেকে বড় ব্রাত্য মনে হতে লাগলো। ও ওর মা'কে বলেছিলো, 'মা, আমি সুলেমানকে বিয়ে করেছি। আজই আমরা বিহারের সাসারামে ওর দেশের বাড়িতে চলে যাবো। আমার সাথে একটুও কথা বলবে না, মা।' সবাই নির্বাক। ওর মা ওর হাতে দু'হাজার টাকা দিয়ে, রান্নাঘরে চলে গেলেন। 

মল্লিকাদি কিচ্ছু নিলো না। টাকাটা খাটের উপর রেখে, নিষ্পলক দৃষ্টিতে ঘরের চারপাশটা একবার দেখে ও ধীরে ধীরে বেরিয়ে চলে গেলো। 

সুলেমান স্যার ওকে বিহারে ওর দেশের বাড়িতে নিয়ে যান। ওখানে তিনি কিছুদিন কাটিয়ে আবার কোলকাতায় ফিরে আসেন। কারণ তখনও তাঁর চাকরিটা এখানেই । তিনি বদলির জন্য দরখাস্ত করেছিলেন। যতক্ষণ না হয়, ততক্ষণ মল্লিকাদি'কে ওখানেই থাকতে হবে। মল্লিকাদি সুলেমান স্যারকে আশ্বস্ত করে বলেছিল, ও একা থাকতে পারবে। 

এদিকে বড় ছুটি না পেলে সুলেমান স্যার যেতে পারেন না। মল্লিকাদি স্বামীর আশায় দিন গোণে। বেশ কয়েকবার সুলেমান স্যার দেশে গিয়েছিলেন। 

এরপর বদলীও হয়েছিলো। কিন্তু সুলেমান স্যার চাকরী ছেড়ে সব টাকা পয়সা নিয়ে কোথায় যে চলে যান, মল্লিকাদি কিচ্ছুটি জানতে পারে না। এদিকে প্রায় একবছর হয়ে যায়। স্বামীর ফোন আসা পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেছে। মল্লিকাদি'র তখন দিশেহারা অবস্থা। কোলকাতায় ওর নিজের বলেতো কেউ নেই, যে চলে আসবে, সুলেমানের খোঁজ করবে। 

কিন্তু বেশিদিন ও চুপ করে বসে থাকতেও পারলো না। ও বোধহয় মনে মনে আঁচ করতে পেরেছিল, সুলেমান আর হয়তো ওর কাছে আসবে না। তবুও শেষ চেষ্টাতো করতেই হবে। 

মল্লিকাদির মনে কু টাই গাইছিলো। মনে মনে ও ঠিকই করে ফেলেছিলো, সুলেমানের কোনো খোঁজ না পেলে, ও কারো কাছে যাবে না। ও আর কারো পরিচয়ে বাঁচবে না। 

মল্লিকাদি সত্যিই সুলেমানের কোনো খোঁজ পায় নি। ও সুলেমানের সাথে ওর সম্পর্কের যা চিহ্ন ছিলো, মল্লিকা সব ধুয়ে মুছে ফেলে দিলো। 

অর্চনা বলে ওর এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিলো। ওকেই ও মাঝে মাঝে ফোন করে। কিন্তু এই অসময়ে মল্লিকাদি ওকে ফোন করতে চায় নি। 

দেশে থাকতে সুলেমান ওকে সংসার চালানোর জন্য টাকা দিয়ে আসতো। মল্লিকাদি সেখান থেকে জমিয়ে জমিয়ে কিছু টাকা করেছিলো। ওটুকু সম্বল নিয়ে ও চলে এসেছে। কিছুতো একটা করতেই হবে। একেবারে নিরুপায় হয়েই ও অর্চনাকে ফোন করে ফেলে। অর্চনাকে ও সব জানায়। 

অর্চনার স্বামী নেই। এক ছেলে। চাকরীসূত্রে ব্যাঙ্গালোরে থাকে। অর্চনা ওর বাড়িতে একাই থাকে। মল্লিকাদি'কে ওর বাড়িতে আসতে বলে। 

মল্লিকাদি অর্চনার বাড়িতে আসে। অর্চনা বলে, 'তুইতো তোর খেলাধূলা নিয়ে কিছু ভাবতে পারিস।'

মল্লিকাদি'র মধ্যে কেমন একটা ভালো লাগা শুরু হতে লাগলো। ও অর্চনার হাতে টাকাক'টা গুঁজে দিয়ে বলে, 'আমাকে ক'টা দিন তোর বাড়িতে থাকতে দিবি? আমি ঠিক আমার কাজ খুঁজে নেবো। তারপর আমি চলে যাবো।'

অর্চনা বলেছিলো, 'এতোটা ভেঙে পড়িস না। তোর পাশে আমি আছি। মল্লিকাদি আবার পুরোনো ফর্মে ফিরে যায়। নিয়ম করে রোজ ভোরবেলায় ট্রাকশ্যুট পড়ে দৌঁড়াতে যায়। মাঠে যারা ফুটবল খেলে, তাদের সাথে খানিক খেলে নেয়। এভাবে মাঝে মাঝে ওদের কোচ মল্লিকাদির খেলার দক্ষতা প্রত্যক্ষ করেন। 

একদিন ওদের কোচ মল্লিকাদিকে জিজ্ঞেস করেন, ওনার যে জুনিয়র টিমটা আছে, মল্লিকাদি কি ওদের কোচ করাতে পারবে? খুব বেশি বেতন উনি দিতে পারবেন না। তবে খুব কমও দেবেন না। 

একটা নেগোশিয়েশন করে মল্লিকাদির কাজটা হয়ে গেল। 

ভীষণ খুশিতে বাড়ি ফিরে এসে মল্লিকাদি অর্চনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, 'সব তোর জন্য হয়েছে। জানিস ময়দানে একটা কাজ আমি পেয়ে গেছি। কাল থেকে জয়েনিং। আর দু'দিন থাকতে দে। আমি একটা ঘর ভাড়া করে নেবো।'

অর্চনা'র চোখে জল। বললো, 'অবশ্যই যাবি। যা আগে স্নান সেরে নে। এই দু'টো দিন আমরা একটু আমাদের প্রাণের কথা বলে নি।'

মল্লিকাদি খিলখিল করে হাসতে হাসতে কলঘরে চলে যায়। শাওয়ার চালিয়ে দিয়ে স্নান করে আর অঝোরে কাঁদতে থাকে। আজ যে ওর মা, বাবা, ভাই বোন সবাইকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, খুব কাছে পেতে মন চাইছে। 

মনের ব্যথা মনেতেই রেখে, মল্লিকাদি নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বছর দুই পরে, একটি অনাথ শিশুকন্যাকে ও অ্যাডপ্ট করে। রুমকির মা মল্লিকা দাস এখন ভীষণ কর্মব্যস্ত এক পূর্ণাঙ্গ নারী। মেয়ের পরিচর্যা করা, সাথে নিজের কাজ সবকিছু নিঁখুতভাবে করার চেষ্টা করে। নিজের জন্য ভাবার অবসর কোথায়??


        



विषय का मूल्यांकन करें
लॉग इन

Similar bengali story from Action