#অবাধ্য মন
#অবাধ্য মন
ছোটগল্প
বিষয়: দুঃসাহসিকতা
কলমে: বুলা বিশ্বাস
শিরোনাম:
#অবাধ্য মন
খাঁচায় বন্দী মনটা মুক্তি চায়। নীল আকাশে ওই দূর বলাকারা, যখন ডানা মেলে রোদের আলো গায়ে মেখে মনের আনন্দে উঁচুতে আরো উঁচুতে উড়তে থাকে, মুক্তির মনও ওদের সাথে 'কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা'তে উধাও হয়ে যায়। সে মনে শুধু ফেলে আসা স্মৃতিরা বিচরণ করতে থাকে। স্কুল জীবন, কলেজ জীবন বন্ধুদের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটানোর জীবন, দুম করে কোথাও উধাও হয়ে যাবার জীবন।
কাজ কর্ম সেরে মুক্তি ওর শোবার ঘরের জানলার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে রাস্তার পানে তাকিয়ে অনেক কিছু ভাবতে থাকে। বাইরের রাস্তাটা এখন অনেকটাই জনশূন্য। মাঝে মাঝেই ফেরিওয়ালাদের সুর করে হাঁক, নিস্তব্ধতাকে ভেঙে খানখান করলেও মুক্তির মনের নাগাল এখন কেউ পাচ্ছে না।
ওর মনে পড়ে, কলেজে পড়ার সময় সরস্বতী পুজোর দিন , সবাই মিলে ঠিক করে ফেলেছিল ব্যাণ্ডেল চার্চ যাবে।তৃষ্ঞা, বকুল, মল্লিনাথ, দেবাশিস, জহর, রুমা, তপতী কেউ বাকি ছিল না। ত্রিদিব বললো, 'চল আমরা হারিয়ে যাই। দূরে, অনেক দূরে ট্রেনে করে একেবারে শেষ স্টেশন। ভীষণ মজা করবো।'
সত্যিই সেদিনই হয়তো ওদের হারিয়ে যাবার দিন ছিলো!!!
মুক্তি বললো ক্ষেপেছিস নাকি? তুই এর মর্ম জানিস? এসবের জন্য দম চাই, অর্থ চাই। তাছাড়া বাড়িতে এসব বলে বেরোতে পারবি? দুটো থাপ্পড় খেলে যার বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ঘোরে, তার আবার হারিয়ে যাওয়া!' বলে মুক্তি হি হি করে হাসতে লাগল।
দেবাশিস চিৎকার করে মুক্তিকে বেশ করে মুখ করে উঠলো 'দিলিতো ওর স্বপ্নটাকে ভেঙ্গে।
ত্রিদিব ওর মাথাটা দু'হাঁটুর মাঝখানে ঢুকিয়ে চুপ করে বসে ছিল।
মুক্তি ওকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, 'সরি রে, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দে। চল, সত্যিই আজকে হারিয়ে যাব। এই উদাসী মন, এই পাগল যাযাবর মনটাকে চল বেশ করে প্রশ্রয় দিই।'
ত্রিদিব হা হা করে হেসে ওর গালে একটা টোকা মেরে বলে উঠলো, 'ইয়ে হুয়ি না বাত। আমি এটাই চাইছিলাম। তোদের কেমন ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করলাম বল? দেবাশিসের কাছে ঝাড় খেয়ে একেবারে তেড়েপুড়ে উঠলি! কী রে মাসিমা, মেসোমশাইএর মুখটা মনে পড়ছে! গুম গুম কিলানি! সব সইতে পারবিতো!'
'আরে ওসব কথা মনে করাস না। শোন না, তোরাতো আমাকে নিয়ে পড়লি। সবাইকে জিজ্ঞেস কর। ওরা যাবে কিনা। তা না হলে কিন্তু এই তোদের মত তিন পাগলের সাথে আমি একা যাব না। সবাই বললো, 'দেখো ভাই, আমরা বন্দী পাখিরা, একটু উড়তে চাই। মনটা বড় উড়ুউড়ু করছে রে! আমরা সবাই যাব।'
তৃষ্ঞা বললো, 'হ্যাঁ রে বাড়িতে বলে যাবি না?'
মল্লি বললো, 'ধ্যুর! তাহলে আর মজা কিসের!'
বেলা দেড়টা। শিয়ালদহ থেকে বনগাঁ লোকাল ধরে ওরা চললো ওদের হারিয়ে যাওয়ার দেশে। ট্রেন থেকেই ঝালমুড়ি, আলুরচপ, সিঙাড়া এটা সেটা খেয়ে ওরা চলেছে। আজ যেন ওদের মুক্তির আনন্দ। ওরা কোনোদিন এতো বেপরোয়া ছিল না। কিন্তু সেদিন মনটা ভীষণ বাঁধনছাড়া হতে চেয়েছিল। ট্রেন চলছে, মুক্তি জানলার কাছে সিটটাতে বসে বাইরে মুগ্ধ দৃষ্টিতে প্রকৃতিকে দেখছে। দূরে সবুজ ধানক্ষেত, চোখ যেন জুড়িয়ে যাচ্ছে। মল্লিটা ট্রেনের দুলুনি আর জোরালো হাওয়ায় মুক্তির কাঁধের উপর হেলে পড়ছে। ওতো ঘুমিয়ে পড়ছে মনে হয়। মুক্তি ওকে একটা ঠ্যালা দিয়ে বললো, 'কি রে,এখনই ঘুমিয়ে পড়লে কী করে হবে! তোকে ফেলে কিন্তু আমরা নেমে পড়বো।'
'আরে না না ঘুমোচ্ছি না। একটু ঘুম ঘুম ভাব আসছে।' 'এই দেবাশিস, তুই ওর পাশে এসে বোস। আমার কাঁধের উপর থেকে থেকে এমন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে,আমি সামলাতে পারছি না বাবা। তুই বোস।'
এইভাবে হৈ হৈ করতে করতে ওরা বনগাঁ স্টেশনে নেমে পড়ে।
এখানে ওরা একেবারে নতুন। স্টেশনে কিছু বখাটে লোকেদের আড্ডাতো থাকেই। ওরা যখন প্ল্যাটফর্ম ধরে স্টেশনের বাইরে যাবার জন্য এগোচ্ছে, তিন চারটে ষণ্ডা মার্কা ছেলে ওদের পিছু নিয়েছে। ওদের গ্রুপে দেবাশিস আর মল্লিনাথের বেশ মজবুত চেহারা। দেবাশিস প্রথমে লক্ষ্য করেছে। ও মল্লি আর জহরকে ইশারা করে অ্যালার্ট করে দেয়। ওদের দলে মোট পাঁচজন মেয়ে আছে। সবাই আবার সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে শাড়ি পড়েছে। সাজগোজও বেশ করেছে। বদমাইশ লোকগুলোর চোখমুখ ভালো নয়। দেবাশিসের ভয় লাগতে শুরু করেছে। ও আসন্ন বিপদ সম্পর্কে ভাবতে ভাবতে কেমন চোখে অন্ধকার দেখছে।
কথায় বলে না 'রাখে হরি, মারে কে?'
ওরা যখন ট্রেনে বসে সবাই মিলে গল্প করছিল, একজন বয়স্ক ভদ্রলোক আর তাঁর স্ত্রী ওদের গল্প শুনেছিলেন আর বেশ মজা পাচ্ছিলেন। ওনারা বুঝতে পেরেছেন, এরা এ জায়গায় একেবারে নতুন। মজা করতে করতে বেরিয়ে পড়েছে। এ রাস্তা যে খুব একটা ভাল নয়, এটা আদৌ ওরা জানে না। তাহলে হয়তো ওরা এই ডবকা মেয়েবন্ধুদের নিয়ে এভাবে বেড়াতে চলে আসত না।
ওনাদের নাতি নাতনীরাও প্রায় এই বয়সেরই। ওনাদের ওদের কথা বেশ ভালো লাগছিলো। মাঝে মাঝে ওনারাও ওদের সাথে কথা বলছিলেন। ওদের একবার জিজ্ঞেসও করেছিলেন, এখানে ওরা কোথায় যাচ্ছে? ওরা বলেছিলো, 'ঠাকুমা, আমারা আজ ঘুরতে বেরিয়েছি। এখানে আমাদের কেউ নেই।'
ওনারা অবশ্য বলেছিলেন, 'তবে সোনারা এখানে বেশিক্ষণ থেকো না।একটু আধটু ঘুরে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যেও। বদমাইশ লোকেদের খপ্পরে পড়লে, রক্ষা নেই কিন্তু।' ওরা ওনাদের কথায় তখন কোনো পাত্তা দিয়েছিল বলেতো মনে হয় না। কারণ মনে ওদের তখন দেদার ফূর্তি।
কিন্তু ট্রেন থেকে নেমে পড়ার পর ওরা বুঝতে পারছে, বিপদ পিছু নিয়েছে। ওই ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলার দৃষ্টিও ওদের পিছনে ধেয়ে আসা বিপদ থেকে এড়িয়ে যায় নি। ওনারা দেখছেন কোলকাতা থেকে আসা ওই ছেলেমেয়েগুলো যত দ্রুত এগোচ্ছে, বদমাইশ চারটে লোক ওদের ঠিক পিছন পিছনে চলেছে।
সাথে সাথেই ওই ভদ্রলোক ওদের ডাক দিয়ে বললেন, 'আরে, তোরা একটু আস্তে চল। আমরা যে বড় পিছিয়ে পড়েছি। কয়েকটা জিনিস কিনে তবে ভ্যানে উঠে বাড়ি যাব। আর সবকিছুইতো আমার কাছে আছে।'
কথাগুলো বদমাইশ লোকগুলোর কানে যেমন গেলো। ওদের কানেও কথাগুলো যেতেই, ওরাতো ঘাবড়ে গেল। দেবাশিস পিছনে ওনাদের দিকে তাকাতেই, ওনারা ইশারা করে ওদের আস্তে হাঁটতে বললেন।
ওরা আস্তে হাঁটতে শুরু করলো। তারমধ্যে ওই বয়স্ক ভদ্রলোক আর তাঁর স্ত্রী ওদের কাছাকাছি এসে বললেন, আগে চল কিছু কেনাকাটা করে নি। একটু মিষ্টিও নেবো বুঝলি। শেষপাতে মিষ্টি না হলে জমে না, তাই না? দেবাশিস বললো, 'দাদু , যা নেবার তাড়াতাড়ি নাও। ভীষণ খিদে পেয়েছে।'
মোটামুটি প্রায় ওরা সবাই ইতিমধ্যে এই অভিনয়ের কারণটা বুঝে গেছে।
আর ওই দুষ্ট লোকগুলো ওদের পিছন থেকে সরে গেল। কারণ ওরা বুঝলো, এই ছেলেমেয়েরা ওদের আত্মীয়ের বাড়িতে যাচ্ছে। ওরা আবার অন্য শিকার ধরতে অন্য কোথাও চলে গেল।
ওরা সবাই স্টেশনের বাইরে চলে এলো। ওই দুজন স্বামী স্ত্রী ওখানকার লোকাল বাসিন্দা। ওনাদের জন্য সেদিনটা ওরা জোর বাঁচান বেঁচে গিয়েছিল, তা না হলে খেয়ালের বশে ওভাবে বেরিয়ে পড়ে সেদিনই ওদের খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারতো।
সেদিনটা ওরা ওনাদের বাড়িতে ছিল। যে যার বাড়িতে মিথ্যে করে জানিয়ে বলেছিল, ওরা ওদের বন্ধুর বাড়িতে সরস্বতী পুজো উপলক্ষ্যে ওই রাতটা থাকবে, পরেরদিন দধিকর্মা সেরে বাড়ি ফিরবে। ওরা পরের দিন ভোরবেলায় ট্রেনে করে যে যার বাড়ি ফেরে।
মুক্তি ভাবে, এটাতো একটা ঘটনার ঘনঘটা। বিয়ের আগে, এর পরে ওরা বন্ধুরা মিলে মাঝেমাঝেই ব্যাগপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়ত। ভবঘুরে মন নিয়ে ওরা শেষ উত্তরাখণ্ডে ট্রেকিং এ গিয়েছিলো। তাও ওই জুলাই মাসে, মানে ভরা বর্ষণে। তার অনুভূতিই স্বতন্ত্র।
তারপরতো ওর বিয়ে হয়ে যায়। ভবঘুরে মন খাঁচায় বন্দী হয়ে যায়। সংসার সমাজ সব ভালো লাগে। কিন্তু কখনো কখনো মনটা বড্ড অবাধ্য হয়ে পড়ে। শিকল ছিঁড়ে বেরিয়ে পরার জন্য মন আকুতি বিকুলি করে ওঠে। অন্তরাত্মা গুঁমড়ে কেঁদে ওঠে। সে কান্না শোনার মত লোক এ সংসারে মুক্তি একটাও পায়নি যে! ভবঘুরে হওয়ার বাসনা এখনো মনকে জাগিয়ে তোলে।।
-------------
কলমে: বুলা বিশ্বাস
ফোন নাম্বার: 7980205916
মেল আইডি:
bulabiswas60@gmail.com
