#মা তুঝে সালাম
#মা তুঝে সালাম
আজ আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, মেরুদন্ড টানটান করে সোজা হয়ে, উন্নতশিরে নিজেকে অবস্থান করিয়েছি, নিজের একটা পরিচয় তৈরি করতে পেরেছি, এর জন্য যাঁর অবদান শতকরা একশোভাগের বেশি বই কম নয়, তিনি আমার প্রণম্যা 'মা।' আজ তিনি সশরীরে এ পৃথিবীতে নেই, কিন্তু তিনি আমার অন্তরাত্মা জুড়ে সর্বদাই বিরাজ করেন। আমি চোখ বুজলেই তাঁকে দেখতে পাই, তাই আমার কাছে, তিনি আজও বেঁচে আছেন।
তাঁর প্রতি বিনম্র চিত্তে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে, তাঁকে প্রণাম জানিয়ে আমি আমার সেই প্রেরণাদাত্রী সম্পর্কে আজ কিছু বলবো। শুনতে গল্পের মত হলেও, নিখাদ সত্যিটাই পরিবেশন করছি।
আমরা পূর্ববঙ্গীয়। বাবা ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করলেও, মা অবশ্য কোলকাতায় ১৯৪২ সালের ২০শে এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। দেশভাগের সময়, বাবা কোলকাতায় পিসির বাড়ি চলে আসেন এবং এখানে চাকরি করে এখানেই সেটল হন।
মামার বাড়ির অবস্থা খুব ভালো ছিলো না বলে, মায়ের অনেক ছোট বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। মা'র যখন ঊনিশ বছর বয়স, আমি জন্মগ্রহণ করি। আমরা পাঁচ বোন, এক ভাই।
দাদুর মুখেই শোনা, মা ছোটবেলায় পড়াশুনায় খুব ভালো ছিলেন। গানের গলাও ছিলো ভীষণ সুন্দর। কিন্তু অর্থাভাবের জন্য কোনোটাই তিনি পরিপূর্ণ ভাবে শিখতে পারেন নি। এর জন্য মায়ের খুব আফসোস ছিলো।
মা নিজে যেটা করতে পারেন নি, আমাদের দ্বারা সেটা পূরণ করতে চেয়েছিলেন।
বাবার একার আয়ে আমরা ছ'ভাইবোন পড়াশুনা করেছি। গান শিখেছি।
নবম শ্রেণী পর্যন্ত কোনো টিউশন নিতে হয় নি। মা সংসারে সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, দিনের শেষে আমাদের পড়াতে বসতেন। মা বলতেন, ভোরবেলা সব থেকে উত্তম সময়। ওই সময় উঠে পড়াশুনা করলে ভালো ফল করা যায়। মায়ের অনুপ্রেরণায়, শ্রেণীতে প্রতি বছর আমরা রীতিমত এক থেকে তিনের মধ্যে স্থান পেতাম। অত কাজকর্ম করার পর, মা মাঝেমাঝেই টিফিন পিরিয়ডে আমাদের বিদ্যালয়ে আসতেন। দিদিমণিদের সাথে দেখা করতেন। আমরা কেমন পড়াশুনা করছি, কোনোরকম ফাঁকি দিচ্ছি কিনা, সব খোঁজ খবর নিয়ে ঘরে ফিরতেন। দিদিমণিরাও বলতেন, 'শুধুমাত্র মীরাদি ছাড়া, আর কোনো অভিভাবক বিদ্যালয়ে তাঁদের বাচ্ছাদের কোনো খবরাখবর নিতেই আসেন না।' দিদিমণিরাও আমাদের খুব সুনজরে দেখতেন। আমরাও যতটা সম্ভব ভাল মানুষের মত বিদ্যালয়ের নিয়মনীতি অনুসরণ করে চলতাম।
এহেন মজবুত ভিতের উপর যখন আমাদের জীবন তৈরি হচ্ছে, ঠিক সেসময় আমার বাবার চাকরি চলে যায়। আমি তখন মাধ্যমিকের প্রথম ব্যাচ। বাবা ডক লেবার বোর্ডে চাকরি করতেন। বাংলাদেশ থেকে এখানে এসে বয়স বাড়িয়ে দিয়ে চাকরিতে ঢুকেছিলেন। সেইসময় ইমার্জেন্সি পিরিয়ডে একদিন, মোট সাড়ে তিনহাজার মানুষকে জোর করে ছাটাই করে দেওয়া হয়। খাতায় কলমে বাবার বয়স তখন পঞ্চাশ বছর। মাত্র সতেরো বছর চাকরি করে বাবা অফিস করতে গিয়ে দেখেন, বাবার চাকরি আর নেই। কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছিলো, যাঁদের পঞ্চাশ বছর হয়ে গেছে, তাঁরা আর চাকরি করতে পারবেন না। সংসারে ঘোর অমানিশা নেমে এলো।
বাবার থেকে মা ষোল বছরের ছোট। সেই মুহূর্তে সব অন্ধকার ঠেকলেও, কান্নায় খানিক বুক ভিজিয়ে নিলেও, আমার মা কোথাও যেন দপ্ করে জ্বলে উঠলেন।
জ্বলন্ত অভাবকে মা প্রত্যক্ষ করে এসেছেন। ততদিনে আমার মা দুঃখের আগুনে পুড়ে নিখাদ সোনায় পরিণত হয়ে গেছেন। মা ভীষণ মিতব্যয়ী ছিলেন।বাবার যা আয় ছিলো, মা নিজে খুব কষ্ট করে, নিজের সব শখ আহ্লাদকে বিসর্জন দিয়ে, সংসার চালিয়েও মাটির ভাঁড়ে কিছু কিছু করে জমিয়ে রাখতেন। ওটা ছিল মায়ের ভবিষ্যতের সঞ্চয়।
তখনও বাবা অফিস থেকে কোনো টাকা পান নি। মা কিন্তু ওই দুর্দিনে নিজের করা সঞ্চয় থেকে অতিকষ্টে এত জনের পেট চালানো, পড়াশুনা করানো, সবটাই সামলেছেন। গানটা বন্ধ হয়ে গেলো। মা বলেছিলেন, বাঁচতে গেলে শিক্ষার দরকার। ধীরে ধীরে পূর্ণ ভাণ্ডার শূন্য হতে শুরু করলে, মা চিন্তায় পড়েছিলেন। যদিও কারো কাছে মা হাত পাতেন নি। সর্বংসহা দূর্গারূপী মহিলা কিভাবে যেন নিজের মধ্যে শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন। মা'র প্রবল ব্যক্তিত্বের সামনে পড়ে, আমার কাকা তাঁর বৌদিকে দেখে অবাক হয়ে যান। তাঁর চিন্তা হয়, একজন বেরোজগেরে মহিলা কিভাবে এই দুর্দিনে সংসারটা ধারণ করে রেখেছেন। টলে পড়ে যেতে দেন নি। তিনি নিজে থেকে আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। খাওয়া খরচটা উঠলেও, পড়াশুনার খরচ টা
চালাতে মা'কে কষ্ট করতে হচ্ছিলো। পিসিরা বলেছিলেন, 'মাইয়াদের পড়াশুনা করাইয়া কী করবা, বিয়া দিয়া দাও।'
মা'র চোখ থেকে সেদিন আগুন ঠিকরে বেরিয়েছিলো
মা বলেছিলেন, 'আমার বাচ্ছারা পড়াশুনা করবে। ওরা নিজেদের পায়ে নিজেরা দাঁড়াবে।'
আমরা টিউশন শুরু করলাম। পড়াশুনা চললো। মায়ের খুব কড়া শাসন ছিলো। মা ছিলেন আমাদের বন্ধুর মত। আজ থেকে কত বছর আগে, সমাজে চলতে গেলে, মেয়েদের পদে পদে কত বিপদ আসে এবং তা থেকে কীভাবে পরিত্রাণ পাওয়া যায়, মা প্রতিপলে সেই শিক্ষা দিয়েছিলেন। কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, সব কিছু মা শেখাতেন। মায়ের কাছে আমরা সব কথা শেয়ার করতাম। তাই হয়ত যে সময়ে সবাই বারমুখো হতে চায়, বন্ধু খুঁজতে চায়, আমাদের মধ্যে সেসবের প্রয়োজনই হয় নি।
মা বলতেন, 'তোর মধ্যেই সব শক্তি আছে। আত্মবিশ্বাস যেন কখনো হারিয়ে ফেলিস না। তাই বলে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কখনোই ভালো নয়।'
যেহেতু এতগুলো ভাইবোনের মধ্যে আমরা মানুষ হয়েছি, তাই স্বার্থপরতা বা আত্মসুখী হতে কখনো শিখিনি। মা বলতেন, 'একাতো সবাই থাকতে পারে। সবাইকে নিয়ে, সবাইকে দিয়ে ক'জনা থাকতে পারে। মা আমাদের ভাগ করে খেতে শিখিয়েছেন।
সবথেকে বড় কথা মা কোনো জাতিভেদপ্রথা মানতেন না। বিদ্যালয়ে সব জাতির মেয়েরা পড়ে। আমাদের বাড়িতে কোনো বন্ধু বান্ধব আসলে মা কাউকে না খাইয়ে ছাড়তেন না। ডালভাত হলেও তাই খাওয়াতেন। শুধু তাই নয়, কেউ যদি কোনো বিপদে পড়তো, মায়ের নজরে আসলে, মা কখনো মুখ ফিরিয়ে থাকেতেন না। নিজের সাধ্যমত তার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেন। সব থেকে বড় কথা মা, যে কারো মুখ দেখে বলতে পারতেন, সে অভুক্ত আছে কিনা। এমনও হয়েছে, সকলের অলক্ষ্যে মা নিজেরটুকু তাকে খাইয়ে দিতেন। আমরা যখন জানতে পারতাম, রাগারাগি করতাম, বলতাম, 'মা, এটা তুমি কেন করলে? তুমি অসুস্থ হয়ে পড়লে, আমাদের কে দেখবে,'
মা বলতেন, 'একবেলা না খেলে, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে না। এসবে আমার অভ্যাস আছে।' এই হলো আমার মা।
আমি সায়েন্স নিয়ে পড়বো বলে ঠিক করেছিলাম। কিন্তু একে বাবার চাকরি ছিলো না, তার উপর বিজ্ঞান বিভাগে পড়াটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ। মা বলেছিলেন, 'দুঃখ করিস না। যে বিষয়টা তোর কাছে সড়গড়, তাই নিয়েই পড় '
মা আমাদের কোনো অভিধান ছাড়াই বাংলা পড়াতেন। নিজে নিজে লেখার আগ্রহ তিনিই আমাদের মধ্যে তৈরি করে দিয়েছিলেন। ফলতঃ সবাই বাংলা বিষয়টাকে কঠিন বললেও, আমার কাছে বাংলাটা তত কঠিন লাগতো না। তাছাড়া বহু লাইব্রেরীর সদস্যপদ নিয়েছিলাম। তাই শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাকে নিয়েই এগিয়ে গিয়েছিলাম। আজও লেখালেখির কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে রেখেছি। বই পড়তে, ভালো বই সংগ্রহ করতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। এই লেখালেখিটা স্কুলবেলা থেকেই করি। বিদ্যালয়ের ম্যাগাজিনে লেখা দেবার জন্য আমার সে কি উন্মাদনা। সব থেকে বড় কথা, যেটাই লিখতাম, মা'কে পড়ে শোনাতাম। মা হয়তো বলতেন, 'ঠিক আছে।' আমার যেন খুঁতখুঁতেভাব থেকেই যেতো। কিছুতেই পছন্দ হতো না। বারেবারে এডিট করতে থাকতাম। এই নাপসন্দ ব্যাপারটা আমার যেন চরিত্রগত। কী করে নিঁখুতত্বে পৌঁছাবো, তার জন্য আপ্রাণ প্রয়াস চালাতাম। শেষমেষ জমা দিতাম। কিন্তু মন যেন সন্তুষ্ট হতো না। একদিন আমি লক্ষ্য করেছি, মা আমার এরকম অবস্থা দেখে কাপড়ের আঁচলে মুখ ঢেকে মিটিমিটি করে হাসছেন। সেদিন মায়ের উপর আমার ভীষণ রাগ হয়ে গিয়েছিল। আমি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলতেই, মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, 'বোকা মেয়ে। আমিতো এটাই চাই। জানিস একবার সন্তুষ্টি এসে গেলে, সৃষ্টির পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। স্রষ্টা সবসময় চরমে পৌঁছাতে চায়। আর এই চরমটা যে কোথায় গিয়ে ঠেকে, সেটা সে নিজেও জানে না। তাই বারেবারে লেখে, বারেবারে মোছে, কাটাকুটি করতে থাকে। একেবারে অন্তে সে একটা কিছু সৃষ্টি করে ফেলে। তাতেও যে সে সবসময় খুশি হয়, তা নয়। বুকভরা আশীষ সাথে দিলাম। তুই পারবি।'
এসব কথা বলতে গিয়ে আজও কেমন শিউরে উঠি। মায়ের আশীষ সাথে নিয়ে পথ চলছি। সফলতা কতটা পেয়েছি বা পাচ্ছি, সেটা পাঠককুল বলবেন। আমি শুধুই পড়ি এবং লিখি। কেন যেন এই দু'টো ছাড়া আমি আমার জন্য আর কিছু ভাবতে পারিনা।
একেবারে শেষে যেটা বলবো, এবারের আন্তর্জাতিক কোলকাতা বইমেলা ২০২৩তে আমার ছোটগল্পের বই 'আরাধিকা' প্রকাশ পেয়েছে। বাবা স্বর্গীয় চিত্তরঞ্জন দাস এবং মা স্বর্গীয়া মীরা দাসের করকমলে বইটি উৎসর্গীকৃত। কারণ ওনারা ছাড়া এই সুন্দর মর্ত্যধামে আমার আবির্ভাব হতো না। আর আমার মা ছাড়া আমার এতটা পথ চলা কখনোই সম্ভব হতো না।
