STORYMIRROR

Bula Biswas

Action Inspirational

4  

Bula Biswas

Action Inspirational

#দেশপ্রেমের আবেগ

#দেশপ্রেমের আবেগ

5 mins
281

ছোটগল্প

বিষয়: দেশপ্রেম

কলমে: বুলা বিশ্বাস 

শিরোনাম:

#দেশপ্রেমের আবেগ


         শঙ্করনারায়ণবাবু, মিলনি হাইস্কুলের হেডমাষ্টার ছিলেন। তাও নয় নয় করে সতেরো বছর হয়ে গেলো উনি রিটায়ার করেছেন। ওনার এক ছেলে। বাইপাশের কাছে ঢাউস এক ফ্ল্যাট কিনেছেন। বাবা , মা, স্ত্রী, ও এক পুত্র নিয়ে উদিতনারায়ণ ওখানেই থাকেন। এছাড়া সবসময়ের একজন কাজের লোক, রান্নার দিদি, ড্রাইভার আলম শেখ ওদের পরিবারেরই সদস্য সদস্যাস্বরূপ, ওদের হাতের নড়ি। 

উদিত আর ওর স্ত্রী রাই চাকরি করেন। বাচ্চাটা সামনেই একটা নার্সারি স্কুলে পড়ছে। শঙ্করবাবুর কাজ, রোজ ওকে স্কুল থেকে আনা, ওর সাথে খেলা করা, নিজের কিছু লেখা লেখি এবং সাথে প্রতি সন্ধেবেলায় পাড়ার কিছু দুঃস্থ ছেলেমেয়েদের বিনা পারিশ্রমিকে পড়ানো।


সামনে পনেরোই আগষ্ট। প্রতিবছর পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে স্কুল থেকে প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক শঙ্করনারায়ণবাবুর নিমন্ত্রণ পত্র আসতো। বছর দুই হলো আর কোনো নিমন্ত্রণ পত্র আসে না। তার একটা বড় কারণ হলো, ওনারা যে নতুন ফ্ল্যাটে শিফ্ট করেছেন, সেটা অনেকেই জানেন না। আসলে ঠিকানাটাই পরিবর্তন করা হয় নি। 

কিন্তু তাই বলে স্বাধীনতা দিবসে পতাকা উত্তোলন হবে না শঙ্করনারায়ণবাবু সেটা ভাবতেই পারেন না। 

ওনারা যে ফ্ল্যাটে থাকেন কমিটির চেয়ারম্যান বলে দিয়েছেন, ছাদে কোনো ফ্ল্যাগ হোষ্টিং হবে না। পতাকা উত্তোলন করতে গেলে, আপনারা নীচে খোলা কোনো জায়গায় করুন। 

অগত্যা, শঙ্করনারায়ণবাবু আগের বছরে পনেরোই আগষ্টের আগের দিন ড্রাইভার কে বলে রেখেছিলেন, সকাল সকাল গাড়ি বার করতে। আর যে ছেলেটা গাড়ি ধোয়, তাকেও আসতে বলেছিলেন। কোদাল, শাবল, বাঁশ বালতি, পতাকা, ফুল সব বহন করে নিয়ে পাশের একটা খোলা মাঠে ফ্ল্যাগ হোস্টিং করেছিলেন। 


এবছরে সেই মাঠটা আর খালি পড়ে নেই। প্রোমোটারদের যা উপদ্রব, তাতে খালি জমি প্রায় চোখেই পড়ে না। কিন্তু তাই বলে দমে গেলে হবে না। এ বছরেও পনেরোই আগষ্টে পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দেশ মাতৃকার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে হবে। তাই আবারও সেই ব্যবস্থা। 


ড্রাইভার, কাজের ছেলে, পতাকা উত্তোলনের সরঞ্জাম নিয়ে তিনি খোলা মাঠের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। জানলার কাঁচটা নামিয়ে দিয়ে চশমাটা নাকে গলিয়ে, যতদূর দৃষ্টি যায়, দৃষ্টিকে প্রসারিত করে একটুকরো খালি জমি খুঁজতে থাকেন। তাঁকে দেশের মাটির উপর পতাকা উত্তোলন করতে হবে।স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক সিসেবে এটা করা তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলে উনি মনে করেন। 


আগের বছরে সেরকম একটা জায়গা খুঁজে পেয়েছিলেন, তবে অনেক কষ্টে। এখন সব প্রোমোটারদের রাজ। 

এবার অবশ্য অনেক ভোর ভোর যখন বেরোচ্ছেন, ওনার ছেলে, ওনাকে বলেছিলেন, 'আচ্ছা বাবা, তোমারতো বয়েস হয়েছে। পতাকা উত্তোলনটা কি খুব জরুরি? তাছাড়া আমাদের যখন জমি নেই, তুমি অন্যের জমি খুঁড়তে গেলে, তাঁরাতো বাধা দেবেনই। কী দরকার বাবা, এসব ঝামেলা করার?'


ছেলের কথা শুনে উনি প্রায় রেগে গিয়েই বললেন, 'শোনো, এসব অর্বাচীনের মত কথা বলো না। যা বোঝো না, তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না। তুমিতো ইতিহাসে পড়েছো, বিদেশীদের হাত থেকে, পরাধীন ভারতবর্ষকে মুক্ত করার জন্য কত লড়াই হয়েছে। কত বীর শহীদ হয়েছেন। তাঁদের রক্তে রাঙানো, দেশের মাটির মূল্য কতখানি, সেটা বোঝো তুমি? খুব আয়াসে দেশ স্বাধীন হয় নি। আমরা পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত হয়েছি। বিদেশীদের শাসন চলাকালীন, তাদের দেশের পতাকা, আমাদের দেশের মাটিতে ফৎফৎ করে উড়তো। আমরা ভারতীয়রা পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে, ওদের অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করেছিলাম। বহু বিদ্রোহ, বহু সংগ্রামের পর আমার দেশের মাটির উপর আমরা পূর্ণ অধিকার পেয়েছি। দেশমাতৃকার প্রতি সম্মান দেখানো, আমাদের সকলের কর্তব্য।


দেশ যখন স্বাধীন হয়েছে, বিদেশীরা দেশ থেকে হটে গিয়েছে, তাদের পতাকা অস্তাচলে চলে গেছে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখো, আজকের দিনে সবাই পতাকা উত্তোলন করে, দেশের মাটির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছেন। 

তাহলে, আমাকে কেন চুপচাপ থাকতে বলছো? আমাকে বাধা দিয়োনা। সেই কবে থেকে আমি স্বাধীনতা দিবসে ফ্ল্যাগ হোষ্টিং করছি, আজও করবো।'

বাবার মুখের উপর উদিতনারায়ণ আর কোনো কথা বলতে পারেন না  


শঙ্করনারায়ণ বাবু, বেশ কিছু দূরে গিয়ে, একটা খোলা মাঠ দেখতে পেলেন সেখানে বেশ কয়েকজন প্রাতঃভ্রমণ করছেন। শঙ্করনারায়ণবাবু, ড্রাইভারকে রাস্তার পাশে গাড়ি থামাতে বলে, কাজের ছেলেটাকে দিয়ে পতাকা উত্তোলনের সরঞ্জাম নিয়ে মাঠের একধারে চলে এলেন। 

ছেলেটা জায়গাটা পরিষ্কার করছে। শঙ্করনারায়ণবাবু গায়ে সাদা আদ্যির পাঞ্জাবী, চোস্তা, পায়ে চপ্পল, চোখে গোল্ড ফ্রেমের চশমা পরে, দাঁড়িয়ে তা দেখভাল করছেন। ছেলেটা বাঁশটা পোঁতার জন্য, যেইমাত্র শাবল দিয়ে মাটি কোপাচ্ছে, হঠাৎ কোথা থেকে জনা আট দশ ছেলে এসে শঙ্করনারায়ণবাবুকে ঘিরে ধরেন। 'এখানে কী হচ্ছে দাদু? কাউকে কিছু না বলে একেবারে জমি দখলের চেষ্টা? এ তো দেখছি, দিনে দুপুরে ডাকাতি!'

শঙ্করনারায়ণবাবু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, 'এ কি, তোমরা এসব কী কথা বলছো? আজ স্বাধীনতা দিবস। পতাকা উত্তোলন করে দেশ মাতৃকার প্রতি শ্রদ্ধা জানাবো। কোথাও একটুকরো খালি জমি পাইনি। এখানে একটু খালি জমি দেখলাম। তাই ভাবলাম, এখানেই তাহলে....'

'বাঃ, একেবারে তাই এখানেই কোদাল গাইতি নিয়ে মাটি কাটাকাটি শুরু করে দিলেন? 

না দাদু, এখানে এসব কিচ্ছুটি করতে পারবেন না। নিন নিন, তাড়াতাড়ি তল্পিতল্পা গুটিয়ে, এখান থেকে কাটুন তো! এখুনি বিশুদা এসে পড়লে, রক্তারক্তি কাণ্ড বাঁধিয়ে বসবে। ওর মটকা হেব্বি গরম থাকে।'

ছেলেগুলোর ওরকম কদর্য ভাষার বয়ান দেখে, শঙ্করনারায়ণবাবুর মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেলো। স্বাধীনতা দিবসের দিনে, জন্মভিটের প্রতি এদের যে কোনোরকম আবেগ নেই, তা অনুভব করে উনি বেশ দুঃখ পেলেন।

আর কথা না বাড়িয়ে সব তল্পিতল্পা তুলে, শঙ্করনারায়ণবাবু গাড়ি নিয়ে আরো খানিকটা দূরে গিয়ে দেখতে পান, বাঁদিকে বেশ খানিকটা জংলা গাছপালা, আর একটা এঁদো পুকুর মতো কিছু একটা রয়েছে। নির্জন জায়গা। কেউ কোথাও নেই। উনি তাড়াতাড়ি ছেলেটা কে নিয়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঢুকে পুকুরপাড়ের ধারে, বাঁশ পুঁতে, পতাকা উত্তোলন করে ফেললেন। দেশের মাটির উপর হাঁটু গেঁড়ে বসে, মাটিতে মাথা ঠুকে প্রণাম করে, সে এক বিজয়ীর হাসি ঠোঁটের কোণে এঁকে, ছেলেটাকে বললেন, 'নে নে, এইবেলা জন্মভূমিকে প্রণাম করে, তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে চল। আবার না কোন উপদ্রবে পড়ি।' 

সব কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে ওনার বেলা দশটা বেজে গেছে। 'ও আমার দেশের মাটি, তোমার 'পরে ঠেকাই মাথা,' গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে শঙ্করনারায়ণবাবু ঘরে ঢুকে দেখেন, সোফার উপরে বসে ওনার স্ত্রী, ছেলে, বউমা ওনার ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে ভীষণ দুশ্চিন্তা করছেন। কারণ ওনারা ভালো করেই জানেন, দেশের আর্থসামাজিক কাঠামোটা এখন কত অবনতির পথে নেমেছে। যে কোন সময়ে, যে কোনো ইস্যু নিয়ে, যে কেউ গণ্ডগোল পাকাতেই পারে। শঙ্করনারায়ণবাবু বাড়ি ফিরে আসায়, ওনারা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। 


শঙ্করবাবু আপাত খুশি হলেও দেশমাতৃকাকে সম্মান দেবার জন্য ওনাকে আজ যে হেনস্থা হতে হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত কাজটা হাসিল করার জন্য ওনাকে যেমন লুকিয়ে লোক চক্ষুর আড়ালে পতাকা উত্তোলনের মত মহান কাজটি করতে হয়েছিলো, একজন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তিনি বেশ মর্মাহত হয়েছিলেন। সারাদিন একটা বিষন্নতার স্রোত তাঁর মনের মধ্যে শীর্ণতোয়া নদীর মত বয়ে যাচ্ছিলো। কাউকে তিনি মনের এই দুঃখটা শেয়ার করতে পারেন নি। কারণ তাঁর দুঃখ বোঝার মত এই পৃথিবীতে হয়তো কেউ নেই। তাঁর এসব অভিযোগ শুনে বাড়ির সবাই হয়তো ওনার উপর বিরাগভাজন হবেন। মুখে না বললেও সবার মনে একটা কথা ঘোরাঘুরি করবে, 'কেন বাবা, এই বয়সে আর ওই সব করা। বিশেষ করে অন্যের জমিতে মাটি কোপানোটা সত্যিইতো অন্যায়!'

এটা যে কোনো অন্যায়ই নয়, সেটা ভেবে ওনার চোখের কোণ ক্ষণকালের জন্য চিকচিক করে উঠেছিল বইকি!


            --------------

কলমে: বুলা বিশ্বাস 

ফোন নাম্বার: ৭৯৮০২০৫৯১৬

মেল আইডি:

bulabiswas60@gmail.com



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Action