শখের বাড়ী
শখের বাড়ী
(ঘটনাটি সাতের দশকের প্রথম দিক সত্য ঘটনা । কেবল নাম ও স্থানে কিছু বদল হয়েছে।)
বিষের গড়ের পুকুরের দক্ষিণ, পূর্ব ও উত্তরের সুউচ্চ পাড় বরাবর কবরখানা।আর এর পূর্বউত্তর সংলগ্ন রায় বাগান। বেশ বড় বাগান, বিশ একরের কম নয়, মধ্যিখানে পদ্ম আর শালুক ভরা মস্ত সূর্যি পুকুর ।পুকুরের উত্তর পাড়ে গ্রাম থেকে বেশ দুরে বিচ্ছিন্ন বেশকিছু ক্ষেত মজুর উপজাতি মানুষদের বসবাস। সূর্যি পুকুরের উত্তর পাড়ে আম তেঁতল বয়রা আর অর্জুন ঘন বন জঙ্গলে মধ্যেই সারিবদ্ধ কুঁড়ে ঘরে তারা রায় বাবুদের জায়গায় , না হলেও ত্রিশ বছর সময়কাল নির্বিঘ্নে বসবাস করছিল।
রায়েদের অনেক ক্ষেতজমি। চাষবাসের কাজে সুদুর দুমকা থেকে এদের এনে নিজ পুকুর পাড়ের বাগানের থাকতে দেয়।তখন বৃটিশ আমল।
কোন সমস্যা কিছু ছিল না। সমস্যা হল সূর্যি পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে কবর সংলগ্ন সস্তায় জমি কিনে সীতারাম সরেন বড় জায়গায় নিজের ভিটেতে সখের বাড়ি করল ঠিক তখন থেকেই। আদিবাসী ঘরে সে সময় ক্ষেত মজুরী একমাত্র উপার্জন হলেও সীতারাম একটূ অন্যরকম। সে তখনকার দিনে মেট্রিক পাশ, গ্রামের এক প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক। নির্জন পরিবেশ বাড়ি সংলগ্ন ফল সব্জির বাগান করতে আদিবাসী পাড়া থেকে বেশ দুরে অনেকটাই জমি কিনে ঘর বানালো। যজ্ঞ করে গৃহ প্রবেশ করল।
স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলে।এক নতুন সমস্যা দেখা দিল ।রাতে শোবার পর কেউ তার দরজায় ধাক্কা মারে, এক দুবার নয় লাগাতার।কপাট ঝন ঝন করে। কিছুক্ষণ পর আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়।আবার খানিক পর আবার ধাক্কাধাক্কির শব্দ।সীতারাম নিঝুম রাতে নির্জনে দরজা খুলে বের হওয়ার সাহস পায় না। সীতারামের বৌ ভয় পায়।এমন তো প্রতিরাতেই হয়! তিনবার করে।সেই গৃহ প্রবেশের দিনের রাত থেকেই। চার পাঁচটা রাত এভাবে তবু সহ্য করল, পরে সীতারামকে বৌ মতি বলল , "রইল তোমার নিজের ভিটেতে নতুন সখের বাড়ী ,আমি চললাম। বাপের বাড়িতে থাকব।আর দরকারে, বাবুদের দেওয়া যৌথ জায়গায় আগের তোমাদের পুরোন ছোট কুঁড়ে ঘরে থাকব। আর এখানে একদিনও নয়। "
দিশেহারা সীতারাম তার ইস্কুলের সহশিক্ষক ও বন্ধু হরনাথকে সব ঘটনা বলে। যুক্তিবাদী বিজ্ঞান মঞ্চের না কী যেন সে সক্রিয় সদস্য, আর নির্ভীক সাহসী। ভুত প্রেত দৈত্য দানা সবই নাকি তাদের মতে মিথ্যা!কখনও কুসংস্কার বা দুর্বলতা।
তিনি পরামর্শ দিলেন । "এ কোন মানুষের নিশ্চয়ই ধান্ধাবাজী, তুমি ভয়ে কম টাকায় অমন নতুন বাড়ি ছেড়ে পালাও বা কম দামে বেচে দাও এই ধান্ধা।"
সীতারামের সখের পাকা বাড়ী ,জানালা দরজা গুলো লোহার সিট আর গ্রীল দিয়ে তৈরি বেশ মজবুত। ফাঁকা জায়গা চারধারে চার পাঁচশো মিটার অবধি বসতি শুন্য। কেউ রাতে যেন চুরি ডাকাতি করতে না পারে। তাই এমন শক্তপোক্ত ।
সীতারামের বৌ তার একমাত্র শিশু সন্তান নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল। একটা সুবিধা হল। এদিন রাতে বন্ধু হরনাথকে নিয়ে ঘরে থাকল।কিন্ত আজ আর সেই শব্দ হল না ।
বন্ধু বলল "হয়ত তোমাদের শোনার ভুল।"
সীতারাম খুব রেগে যায়"আজ হল না, ঠিক আছে তা হলে কেন আমার বৌ ভয়ে থাকছে না। আমি আর বৌ যা শুনলাম সব ভ্রম! এটা কী বলছ! "
আবার তারা পরের রাতে শুলো ,সেদিনও কোন শব্দ হলো না।
দুদিন পর বন্ধুটি বলল "যদি তাই হয় , যে শব্দ করে কোন দুষ্ট চরিত্রের মানুষ । তোমার বৌকে ভয় দেখাতে এমন শব্দ করছে।"
ঠিক হল বৌ নিয়ে সীতারাম ঘরে শোবে , আর দুরে হরনাথ লুকিয়ে থাকবে নিকটে এক আমগাছের উপর। যাতে কোনরকম সমস্যা না হয় ,পা থেকে মাথা অবধি বর্ষাতির মত কালো পোষাক , লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করবে, আবার গাছে পোকা কাঠ পিঁপরের হাত থেকে রক্ষা পাবে। সঙ্গে জোরালো চার সেল ব্যাটারীর লম্বা টর্চ, যেটা আলো জ্বেলে দেখা যাবে ।আবার কোন দুষ্ট মানুষের হাত থেকে আঘাত করে আত্মরক্ষা করা যাবে এছাড়াও তার প্রিয় মস্ত ছুড়ি, কোমরে গুঁজে রাখল যদি দরকার পরে ! শেষ রক্ষা।
অনেক কষ্টে বৌকে রাজি করিয়ে হরনাথ অন্তত একদিনের জন্য রাতে এই ঘরে তার সাথে থাকতে মতিকে রাজী করাল। তবে শর্ত এমন শব্দ যদি আজ হয় জীবনে এ বাড়ীতে সে আর থাকবে না ।
গ্রীষ্মের রাত ,পূর্ণিমা আর দুদিন পরে তাই মেঘমুক্ত আকাশে রাতে চাঁদের আলোয় ঝলমল করছিল। হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে । নিঝুম রাত ক্রমশ যত বাড়ছে ,নীরবতা ততই যেন হরনাথের মনে চেপে বসছে। আর মাঝে মধ্যে এই নীরবতা ভেঙ্গে নিশা পাখির ডাক, আর উড়ে যাওয়া শব্দ, পুকুর পাড়ের বাগানের আলো আধাঁরে খেলা চলছিল। গাছের পাতা হালকা হাওয়ায় নড়াচড়ার সাথে সাথে, আলো ছায়ার খেলায় এক অদ্ভুত ধাঁধাদৃশ্য হরনাথের দৃষ্টি বিভ্রাট হচ্ছিল।
দিনের চেনা পরিবেশ কেমন অচেনা রহস্যময় মনে হচ্ছিল।বসতি থেকে দুরে নির্জন প্রান্তরে হরনাথের এক অজানা অপার্থিব পরিবেশ সে অনুভব হচ্ছিল হরনাথে চোখে ঘুম নেই , রহস্য আজ রাতে তাকে বের করতেই হবে।একবার দরজা ধাক্কাধাক্কির শব্দ হোক ! লোহার কপাট তাই শব্দে তীব্রতা কাঠের দরজার চেয়েও বহু গুন বেশী হবে। কথাছিল দরজায় ধাক্কা ধাক্কির শব্দ হলেই সীতারাম ধারালো কাটারি হাতে দরজা খুলে বের হবে, আর হরনাথ গাছ থেকে ঝাঁপ মেরে যেই হোক তাকে হাতে নাতে ধরবে। কী শাস্তি সেটা পরে বিবেচনা করা হবে।
এই একনাগাড়ে বেশ কিছুক্ষণ শব্দ রাতে বার তিনেক বেশ কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর হয়। এদিন আবার সেই ঝন ঝন তীব্র দরজা ধাক্কার শব্দ ।সীতারামে বৌ ভীষন শঙ্কিত, সঙ্গে স্বামীর উপর যারপরনাই সে বিরক্ত।
সীতারাম বাইরে বন্ধু আছে এই ভরসায় কপাট খুলতে যায়। তার স্ত্রী ভয় পায়। অজানা আশঙ্কায় দরজার কপাট খুলতে বার বার নিষেধ করে। কিন্ত সীতারামের বন্ধুকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির সে স্ত্রীর শত নিষেধ অমান্য করে । এক হাতে আত্মরক্ষার জন্য ধারাল কাটারি,অন্য হাতে সে দরজার খিল খুলে কপাট খুলতে গেল। কিন্ত একী ! কপাট যে খোলাই যায় না! কেউ যেন বাইরে থেকে টেনে আছে। অনেক চেষ্টা করে খুলতে না পেরে ।জানালা খুলতে যায়, সেই একই অবস্থা।
নিরুপায় হয়ে বিছানায় সীতারাম বসল । ভাবল এ'তো বন্ধুর সাথে গদ্দারী হল। ও বাইরে একা বিপদে পরল না তো ! তার ভীষণ খারাপ লাগছে কিন্ত করবে কী। সে অসহায়।একটু পর আবার দরজায় সেই ঝাক্কা ঝন ঝন ভীষণ শব্দ । কিন্ত কী আশ্চর্য কপাটের খিল সে খুলে রেখেছে ,আর তো লাগায় নি ! তবু এমন জোর ধাক্কাতে কপাট খুলছে না! এবার সত্যিই সীতারাম ভয় পায়। বন্ধু বাইরে একা ,তার কোন বড় বিপদের কথা ভেবে ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছিল।
রাতের শেষদিকে আরও একবার শব্দ হল।সকাল হয়ে গেছে, বাইরে পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে,একটা ধমকা হাওয়াতে দরজার কপাট আমনা আমনি খুলে গেল।
বিষ্ময়ে হতবাক সীতারাম এবার দৌড়ে গেল।দরজার কপাট সম্পূর্ণ খুলে, আমগাছে নিকট ছুটল ,যেখানে হরনাথ থাকার কথা এক অজানা আতংকে ছুটে গিয়ে দেখল। হরনাথ আমগাছের উপর বসে, ক্লান্ত অবসন্ন সারারাত না ঘুমানোর কারনে সকালে একটু ঘুম ঘুম আসায় চোখ বুজে ছিল।
সীতারাম চিৎকার করে ভাই হরনাথ। চমকে হরনাথ উঠে পড়ে। সীতারাম ভেবেছিল হয়ত সে ভয়ে মরে গেছে বা কোন অলৌকিক শক্তি তাকে রাতে মেরে ফেলেছে।
হরনাথ বলল "এত চিৎকার করছ কেন ! কী হল?"
সীতারাম হরিনাথকে, জীবিত দেখে স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেন প্রান ফিরে পেলো।বলল , "তাড়াতাড়ি নেমে এসো।"
হরনাথ নেমে এসে হাসতে হাসতে বলল , "ভাই তোমার আসামী ধরতে সারা রাত জেগে আছি । কৈ আজও তো কেউ তোমার বাড়ীতে , দরজায় ধাক্কাধাক্কির করল না! সে কী তবে জানে না তোমার স্ত্রী ঘরে আছে?"
সীতারাম মাথায় যেন কাজ করছে না। শুধু বলল রাতে তুমি কিচ্ছু শুনতে পাও নি?
অবাক হরনাথ বলল কেন তোমারা শব্দ শুনেছ!
হরনাথকে এবার সীতারাম সব ঘটনা খুলে বলল । তার স্ত্রী একই কথা শুধু বললই না।রীতিমত ঝগড়া অশান্তি করে বাচ্ছা নিয়ে বাপের সে তার বাড়ি চলে গেল। বলে গেল " থাকো তোমার এই সখের ঘর নিয়ে আমি চললাম।"
সীতারাম এবার ভুত তাড়ানোর ওঝার খোঁজ শুরু করতে লাগল। সন্ধান পেল, এক নামকরা ,পাগলা রবি ,মস্ত ভুতের ওঝা!
।ঘরে ঢুকেই সে বলল "এখানে অশরীরীর বাস। এই জায়গাটা এক সময়ে কবরখানার অংশ ছিল পরে হয়ত কবর স্থল সরে গেছে। আর তোমার এই ঘরের নিচে একটা কবর আছে। কবরের ভুত, সে এই ঘরটা দখল চাইছে। আর ঘরের বাসিন্দাদেরই শুধুমাত্র ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চায়। আর তার উপস্থিতি শুধু ঘরেই।বাইরে কোন প্রভাব নেই। যা কিছু শব্দ ঘরের ভিতরেই শোনা যায়, বাইরে কোন শব্দ বের হয় না, আর তাদের রাতে এই ঘর থেকে বের হতেও দেয় না।"
হরনাথ এই ভুতের ওঝার তুকতাক বিশ্বাসই করে না।বলল "এই বাড়িতে যে অশরীরী আছে কিছু প্রমাণ দিতে পারবেন!"
ওঝা বলে "দুটো নতুন মাটির মালসায় নিয়ে আসুন ,আমি আমার মন্ত্রপুত তরল ঢেলে দেবো ।আপনার ইচ্ছা মত যেকোন একটা ঐ কবর ঘরে, আর অন্য একটা আপনার শোবার ঘরে রাত রাখবেন,সকালে দেখবেন আপনার ঘরের এই তরলের রং একই থাকবে। আর ঐ ঘরে তরল গাড় লাল হয়ে যাবে । ঐ ঘরে চাবি দেবেন, দরকার হলে সারা রাত নজর রাখবেন। পরদিন সকালে যদি আমার এ কথা না মেলে ,আমি এই পেশা ছেড়ে দেবো।"
হরনাথ এই চ্যালেঞ্জ নিল। হালকা হলুদ রং,ভুতের ওঝার এই রহস্যময় তরল , দুটি নতুন মাটির মালসায় এক দশমাংশ করে ঢেলে দেয়। নিজের মনমত ইচ্ছায় হরনাথ একটি মালসা তরল সমেত ঐ রহস্যময় ঘরে, অন্যটি নিজের শোবার ঘরে রাখে। ঐ রহস্য ঘরে চাবি দেয়। নজর রাখে সারা রাত।
হরনাথ অবাক বিষ্ময়ে দেখে ওঝার কথা সত্যি । এর কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি সে পায় নি।ম্যাজিকে হয় কিনা তার জানা ছিল না।
হরনাথ জিজ্ঞেসা ছিল" সব ক্ষেত্রেই কী ভুতুরে ঘরে এই রহস্য তরল রেখে ,এই রেজাল্ট আসবে! "
ওঝা হেসে বলেছিল " সব রোগের কী এক ওষুধ হয় ! অশরীরীর তার মৃত্যু কালীন ইচ্ছা, আকাঙ্খা, পরিতৃপ্তি, স্থান,কাল, তিথি, নক্ষত্রের অবস্থানসহ অনেক কিছু উপরে ,তার আচরণ, শনাক্তকরন নির্ভর করে ।সে এক জটিল অধ্যয়ন! কজনই বা সঠিক জানে !" এর বেশী কিছু বলে নেই।
সেই বাড়ী আজও ভগ্ন দশা। ভুতুরে বাড়ি সবাই বলে। কেউ কিনতে কেন ব্যবহার করার আর সাহস দেখায়নি।।
