শীতের লেপ
শীতের লেপ
সারাদিন দুষ্টুমি করে আর মার খায় টিটো। না স্কুলে নয় , আজকাল স্কুলে টিচাররা মারে না। গাইড বুকে নোট লিখে দেয়। আর সেই নোট দেখে মারে ওর মা। টিটোর বাবা ওদের সাথে থাকে না। না না ঝগড়া করে নয়, আসলে বাবা ফরেস্ট গার্ডের কাজ করে। ওর ডিউটি পেঞ্চ জঙ্গলের ভিতরে। যেখানে ওর কোয়ার্টার সেখানে কোন ভালো স্কুল নেই। তাই ওরা থাকে অমরাবতী শহরে। সেখানের একটা ইংরিজি মাধ্যমের স্কুলে পড়ে ও।
ওর মার, কলেজে পড়তে পড়তে ওর বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আর ব্যাস, পড়াশোনা জলাঞ্জলি দিয়ে ওর মা, দীপান্বিতা, ওর বাবা শম্ভুর সঙ্গে পালায়। টিটোর মা বাঙালি আর বাবা মারাঠা, পাটিল।
টিটোর মামার বাড়ী খুব বড়লোক, কিন্তু ও কখনো সেখানে যায় না। শুধু ও কেন, ওরা কেউই যায় না। কেন যায় না... টীটো জানেনা। সত্যি কথা বলতে কি তাতে ওর বিশেষ কিছু আসে যায় না।
কিন্তু ক্লাসে পড়া না পারলে বা পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে যখন ওর মা চুলের মুঠি ধরে গুমগুম করে পিঠে কিল বসায় আর দাঁত চিপে চিপে বলে,” সব রক্তের দোষ। সেই বাপের মত মুখ্যু হবি, মামাদের মত বিদ্যান হবি না।“
তখন টিটোর ঐ অজানা মামাদের ওপর ভীষণ রাগ হয়। কি দরকার ছিল অত বিদ্যান হবার? খামোখা ওকে ওদের জন্য মার খেতে হচ্ছে। যদি ওরাও বাবার মত হত, তবে কি ভালোই না হত!
টিটোর খুব ইচ্ছা করে বাবার মত ফরেস্ট গার্ড হতে। কি ভালো কাজ! সারাদিন জঙ্গলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াও, চোরা শিকারিদের পিছনে তাড়া কর...... উফফফ! ভাবলেই রোমাঞ্চ হয় টিটোর।
বাবা যখনই বাড়ী আসে ওর খুব ভালোলাগে। কত মজার মজার গল্প বলে বাবা। একবার একটা ভালুকের বাচ্ছা মায়ের সাথে জল খেতে এসে একটা গর্তের মধ্যে পড়ে যায়। মা ভালুক অনেক চেষ্টা করেও তাকে গর্ত থেকে বার করতে পারে না। তখন ওর বাবারা গিয়ে সেই বাচ্ছাটাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে। তারপর থেকে যখনই ওর বাবাদের সঙ্গে ভালুকটার দেখা হয় বাচ্চাটা ছুটে এসে ওদের হাত চেটে দেয়, আর ওর বাবারা ওকে আদর করে।
সেদিন রাতে টীটো স্বপ্ন দেখল, ওও একটা ভালুকের বাচ্ছাকে গর্ত থেকে উদ্ধার করেছে। কিন্তু বের করে আনার আগেই একটা ভীষণ চেঁচামিচিতে ওর ঘুমটা ভেঙ্গে যায়। অন্ধকারে চোখ মেলে নিজের বিছানায় শুয়ে শুয়ে টীটো শোনে পাশের ঘরে মা বাবার তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। এটা ওর কাছে নতুন কিছু নয়। বাবা বাড়ী আসলেই বাবা মার মধ্যে ঝগড়া হয়। বেশীরভাগ সময় কারণটা টীটো। কিন্তু আজ যেন টীটো নয় অন্য কিছু নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। কান খাড়া করে টীটো কিছু টুকরো কথা শুনতে পেলো।
মা বলছে,” হ্যাঁ ছেড়ে দেবে। ঐ কটা টাকায় চলে না।“
“রুপিয়া সবকুছ নাহি হোতা।”
“ হ্যাঁ সব...... টাকাই সব। আমি যে ভুল করেছি আমি আমার ছেলেকে মানুষ করে সেই ভুল শুধরাবো।“
“ পাপ কি পাইসে সে?”
“ রাখো তোমার পাপ পুণ্য। এই ঠাণ্ডায় ছেলেটাকে একটা লেপ পর্যন্ত কিনে দিতে পারো না বাবা হয়ে...... লজ্জা করে না? পাপ পুণ্য...বাবা হিসাবে তুমি ফেল করেছ । বুঝেছ?” মায়ের গলাটা সাপের মত হিসহিসে শোনায়।
ঝগড়া শুনতে শুনতে টীটো আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল ও জানে না। সকালে ঘুম ভাঙতে ও দেখে ওর বাবা কখন চলে গেছে ওকে না বলেই।
সপ্তাহ খানেক বাদে টিটোর বাবার বন্ধু মঙ্গেশ কাকু ওদের বাড়ী এলো একটা বড় প্যাকেট হাতে করে, বলল,” শম্ভু নে ভেজা।“
টিটো আর ওর মা প্যাকেটটা খুলে দেখে তারমধ্যে রয়েছে গাঢ় নীল রঙের একটা লেপ। কি নরম! তার ওপর একটা বিরাট ময়ূর আঁকা।
সেদিন রাতে টিটো আর ওর মা সেই লেপটা ঢাকা দিয়ে শুলো। টিটোর লেপটা পেয়ে এতো আনন্দ হচ্ছিল যে ও বকবক করেই যাচ্ছিল। অন্যদিন হলে মা ওকে একটা থাপ্পড় মেরে চুপ করিয়ে দিত। কিন্তু আজ যেন মার মনটা ভালো নেই। ওর কথা শুনতে শুনতে ওর মায়ের চোখে জল ভরে উঠলো।
“তুমি কাঁদছ?”
“নাহ......” বলে মা চোখের জলটা মুছে নিল।
পরের সপ্তাহে বাবা বাড়ী এলো। টিটোর আনন্দ আর ধরে না।
“ জানো বাবা আমাদের মত লেপ আমার কোন বন্ধুর কাছে নেই।“
ওর কথা শুনে বাবা হেসে ওর মাথার চুলটা ঘেঁটে দিলেন।
সেদিন রাতে বাবা মায়ের গলার আওয়াজে আবার টিটোর ঘুম ভেঙ্গে গেল।
“ তুমি কি সত্যি পোচারগুলোর থেকে পয়সা নিয়ে লেপটা কিনলে?” মায়ের গলাটা কাঁদো কাঁদো।
“ তুঝে ক্যা লাগতা হ্যায়?’
“ না মানে ... আমি তো তোমায় তাই বলেছিলাম। মানে এখন মনে হচ্ছে ঐ নিরীহ প্রাণীগুলোর রক্তলাগা লেপ আমার ছেলের চাই না।“
“ মালুম হ্যায়।“
“ তাহলে?”
“ পাকড়ওয়া দিয়া সালো কো। ইয়ে রাজাই মুঝে প্রাইজ মে মিলা পাগলী। “
“ তুমি প্রাইজ পেয়েছো?”
“ হাঁ। তো অব পাস হুয়া ম্যায়?”
“ ফুল মার্কস সে। ” বলে মা যেই বাবার কাঁধে মাথাটা রেখেছে , “ ইয়ে......!” বলে চেঁচিয়ে টিটো ওদের মধ্যে লাফিয়ে পড়লো।