তিন্নি (পর্ব ১৫)
তিন্নি (পর্ব ১৫)


তিন্নির যখন জ্ঞান ফিরলো তখন ও দেখলো যে একটা ঘরের মধ্যে হাত, পা, মুখ বাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে রয়েছে। মাথায় খুব ব্যথা। তিন্নি মাথা ঘুরিয়ে চারিদিকটা ভালো ভাবে দেখতে লাগলো।
ঘরটা খুব একটা বড় না। ছাদ টালির, দরজা জানালা গুলো একটু ভাঙ্গা ভাঙ্গা, ঘরের মেঝে যদিও সিমেন্টের । ঘরের খুব কাছে নিশ্চয়ই গোয়াল আছে। খুব গোবরের গন্ধ। তিন্নির গা গুলিয়ে ওঠে।
খুব জল তেষ্টা পেয়েছে ওর। জানালা দরজার ফাঁক দিয়ে দিনের আলো আসছে। আলোর জোর দেখে মনে হচ্ছে বেলা দশটা বা এগারোটা হবে। দরজা খোলার শব্দ হল। তিন্নি ভয়ে চোখ বন্ধ করে চুপচাপ পড়ে রইল।
ঘরে ঢুকলও একজন মহিলা, তার হাতে একটা থালা, আর তার পিছনে একটি ছোট মেয়ে, তার হাতে একটা জলের গ্লাস।
ওর পাশে এসে বসে, ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে ওকে কিছু একটা বলল মহিলা। তিন্নি ভাষাটা বুঝতে পারলো না, চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো মহিলা প্লেটে করে চারটে ইডলি আর একটা বাটিতে খানিকটা সম্বর নিয়ে এসেছে, ওকে ইশারা করে খেতে বলছে। মহিলা তিন্নিকে টেনে বসিয়ে দিল। তারপর ওর মুখের আর হাতের বাঁধন গুলো খুলে দিল।
তিন্নির খুব খিদে পেয়েছিল। ও খাবারগুলো খেয়ে জল খেল। আঃ! অমৃত। মহিলার হাতের রান্না খুব ভালো না ওর মারাত্মক খিদে পেয়েছিল বলে খাবারগুলো এরকম অমৃত সমান লাগলো তা জানে না তিন্নি। ছোট মেয়েটি ওর মায়ের আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওর খাওয়া দেখছিল। তিন্নি ওর দিকে তাকাতেই ও মিষ্টি করে একটু হাসলো। ওকে হাসতে দেখে তিন্নির মুখেও খেলে গেল হাল্কা একটা হাসি। ওর নিজেই অবাক লাগলো। এরকম একটা অদ্ভুত অবস্থায় ওর হাসি পায় কেমন করে? ওর খাওয়া হলে মহিলা ওকে পাশের একটা দরজা দেখিয়ে দিল। তিন্নি দেখলও ওটা টয়লেট। টয়লেটটা টিনের । পিছন দিকের টিনের দেয়ালটাতে একটা চৌকো জানালা। জানালাটায় কোন গরাদ নেই। কিন্তু সেটা এতো ছোট যে সেটা দিয়ে গলে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ও জানালা দিয়ে দেখলো পিছন দিকটা পুরোটাই জঙ্গলে ঢাকা। বাইরের দিকে তাকিয়ে ওর মনটা হুহু করে উঠলো। ও যদি এখান থেকে পালাতে পারতো?
এরা কারা ? ওকে কেন এখানে ধরে এনেছে? অনেকগুলো কথা ওর মনে ঘুরছিল। দরজায় দুম দুম করে কিল পড়তে শুরু হল, সঙ্গে ওই মহিলার গলা। ওকে নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসতে বলছে। হইচই শুনে ওপাশ থেকে একজন লোক চেঁচিয়ে কিছু একটা জিজ্ঞাসা করলো। তিন্নি আর দেরী না করে তাড়াতাড়ি টয়লেট থেকে বেরিয়ে এলো। দেখলও মহিলা শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আর দূর থেকে জনাতিনেক লোক ছুটে ওদের দিকে আসছে। ওকে বেরোতে দেখে লোকগুলো দাঁড়িয়ে গেল। তিন্নি চুপচাপ ঘরে ঢুকে এলো। মহিলা ঘরে ঢুকে ওকে ইশারা করে বলল যদি না চেঁচাও তাহলে তোমায় বাঁধব না। তিন্নি মাথা নেড়ে হাতের ইশারায় জানালো ও চেঁচাবে না। মহিলা দরজায় তালা লাগিয়ে চলে গেল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই তিন্নির খুব ঘুম পেলো। এখন তো ঘুম পাওয়ার কথা নয়। তাহলে কি ওরা খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়েছে? আর বেশিক্ষণ ভাবতে পারলোনা , গভীর ঘুমে ঢলে পড়লো। ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যা নাগাদ। ঘরের বাইরে কারা কথা বলছে। তাদের মধ্যে একজন হিন্দি ভাষী। বাকিদের কোথায় দক্ষিণী টান স্পষ্ট।
হিন্দি ভাষী লোকটি ধমকে উঠলো,” একটা কাজ ঠিক করে করতে পারিস না। কাকে বললাম। আর কাকে উঠিয়ে আনলি? এখন এই মেয়েটাকে নিয়ে কি করি বলতো।“
“ভুল হয়ে গেছে আন্না, অন্ধকারে বুঝতে পারিনি। তারওপর একদম এক রকমের জ্যাকেট। তাই...... এবারটা মাফ করে দাও। কালই ওকে নিয়ে গিয়ে বেচে দেব।“ মিন মিন করে বলে একজন।
“চুপকর! বেচে দেবো, আর পুলিশের হাঙ্গামা কে পোহাবে?”
“ মেয়েটার এখানে কেউ নেই। এখনে ওকে কেউ চেনেও না। আমি খবর নিয়েছি আন্না।“
“ বলছিস?”
“ হ্যাঁ আন্না।“
“ ঠিক আছে , কত দাম দেবে খোঁজ নে। “
তিন্নির হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে এলো। ওর বুঝতে বাকি রইল না যে ওর সম্বন্ধেই কথাটা হচ্ছে। ওর মনে পড়ে গেল যে ও সেদিন মৃগের জ্যাকেটটা ধার করে পরেছিল। ব্যাঙ্গালুরুতে সকালের দিকে মাঝে মাঝে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে। সেদিনও সকালে বেরোনোর সময় ওর বেশ ঠাণ্ডা লাগছিল। ও স্বপ্নেও ভাবেনি যে ওই জ্যাকেটটাই শেষ পর্যন্ত ওর কাল হয়ে দাঁড়াবে।
তারমানে ওরা মৃগকে কিডন্যাপ করতে গিয়ে ওকে কিডন্যাপ করেছে। কিন্তু ওরা মৃগকে কেন কিডন্যাপ করবে? অনেক ভেবেও এর কোনো কারণ বার করতে পারলো না তিন্নি। কিন্তু এটা বুঝতে পারলো আজ রাতে যে করে হোক ওকে এখান থেকে পালাতে হবে। নাহলে ওর সমূহ বিপদ।
ঘরের কোনে মটকা মেরে পড়ে রইল তিন্নি। অনেক রাতে খুট খুট করে তালা খোলার শব্দ হল। তিন্নি সজাগ হয়ে গেল। দরজা খুলে হাতে খাবার নিয়ে ঢুকছে ওই মহিলা। এখন সঙ্গে বাচ্ছা মেয়েটা নেই। মহিলা ঘরের কোনে খাবারের পাত্র রেখে তিন্নির দিকে আসতেই ও ঝাঁপিয়ে পড়লো মহিলার ওপর। তার ঘাড়ের ওপর একটা ক্যারাটের চপ মারতেই মহিলা অজ্ঞান হয়ে পড়লো। ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট হওয়ার সুফল।
যে দড়িগুলো দিয়ে ওরা তিন্নিকে বেঁধে রেখেছিল সেই দড়িগুলো দিয়েই ওই মহিলার হাত মুখ ভালো করে বেঁধে , নিজের জামাকাপড়ের ওপর ওর শাড়িটা জড়িয়ে বেরিয়ে এলো তিন্নি। ঘরে তালা লাগিয়ে চাবিটা পাশের জঙ্গলের মধ্যে ফেলে দিল। দেখলো এই ঘরটা মূল বাড়ীটার চেয়ে বেশ খানিকটা দূরে। এর পাশেই একটা গোয়াল। তাতে বেশ কয়েকটা গরু মোষ। এরা বোধহয় গোয়ালা। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে আশেপাশে কেউ নেই দেখে, তিন্নি, বাড়ীর পিছন দিকের জঙ্গলে পৌঁছল চুপি চুপি। খানিকক্ষণ ধীরে ধীরে হেঁটে ও দৌড়তে শুরু করলো। ভাগ্যিস ওরা ওর পায়ের জুতোটা খুলে নেয়নি। বেশ খানিকক্ষণ দৌড়নোর পর ওর ডানদিকে দূরে, একটা ক্ষীণ চলমান আলো দেখতে পেলো ও।
{ক্রমশ...)