সবার বড়দিন
সবার বড়দিন


আজ সকাল থেকে বাবার কান্ড কারখানা গুলো দেখতে দেখতে বেশ অবাক লাগছিল মিঠির। মানুষটা তো সেই কোন সকালে উঠে শহর চাচাদের সঙ্গে কাজে চলে যায়। মিঠির বাবা রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করে শহর চাচাদের সঙ্গে। আর কাজ বন্ধ থাকলে বেলুন নিয়ে যায় মেলায়, বা কোনো পার্কের সামনে। টে এখন তো কোথায় যেন একটা বাড়ি তৈরির কাজ চলছিল!! শহর চাচার কড়া নিয়ম ঠিক দশটার সময় পৌঁছে যেতে হবে কাজের জায়গায়। কিন্তু বাবা আজ এখনও বাড়িতে কি করছে কে জানে! বাবাকে কিছু জিজ্ঞেস করতেও ভয় লাগে মিঠির। যবে থেকে মা মরে গেছে বাবাও কেমন যেন একটা হয়ে গেছে। আনমনা থাকে সারাদিন, কথাবার্তা বলে না বেশি। নিঃশব্দে কাজে যায়, ফিরে আসে। এদিকে সারাদিন যে বড় একলা লাগে মিঠির সে খবর কি বাবা রাখে!
----- আজ কাজে যাবে না বাবা?
সাহস করে প্রশ্নটা করেই ফেলল মিঠি। বাবা একটা কাপড়ের ব্যাগে জামাকাপড় গোছাতে গোছাতে বললেন,
---- যাবো তো।
---- তাহলে এতো দেরি করছো যে, শহর চাচা বকবে না?
---- এখন কাজ বন্ধ। এই ক'দিন একটা মেলায় যাবো বেলুন নিয়ে।
---- মেলা! কোথায় গো বাবা?
---- সেই শহরে, মেদিনীপুরে। চার্চের মেলা। কোনোদিনও যাইনি আগে, শুনেছি মেলাটা নাকি খুব বড়।
---- ওও।
---- তুইও চান করে নে, তোর জামা কাপড় নিয়ে নিয়েছি আমি।
---- আমিও যাবো?
---- হ্যাঁ। ওখানেই তো থাকবো কয়েকদিন। অরুণদের দোকান যাচ্ছে টেম্পুতে, ওদের সঙ্গেই যাবো। তোকে একলা বাড়িতে রেখে কি যাওয়া যায়!!!
---- আচ্ছা। তাহলে আমি এক্ষুণি চান করে নিচ্চি।
মিঠির মনে আজ খুব আনন্দ। কতদিন পর বাবার গা ঘেঁষে বসতে পেয়েছে সে। কতদিন পর বাবা আজ এতক্ষণ কাছে আছে ওর।
---- বাবা
---- কিরে?
---- এই মেলাটা কিসের মেলা গো?
---- চার্চের মেলা। বড়দিনে বসে।
---- বাবা বড়দিনটা আসলে কি গো? আমি ঠিক বুজতে পারি না।
---- ও তোর বুজে কাজ নেই। বড়দিন আমাদের কিছু না, ও অন্য লোকদের পূজা। আমাদের ঠাকুরের নয়।
মেলাটা যেখানে বসবে সেখানে টেম্পুটা পৌঁছাতেই মনটা ভালো হয়ে গেল মিঠির। রাস্তার পাশে কি সুন্দর করে ছোটো ছোটো পুতুল আর গাছ দিয়ে সাজানো রয়েছে একটা জায়গা। সেখানে দেখাচ্ছে একটা ছোট বাচ্চা তার মায়ের কোলে শুয়ে, আর একটা ছেলে পরি ডা
না মেলে উড়ে আসছে তার কাছে। একটা খুব বড় তারাও রয়েছে সেখানে। রাস্তার ওপারে বিশাল একটা গেল পেরিয়ে মেলার ভেতরে ঢুকলো মিঠিরা। ওরা আসার আগেই অনেক দোকান এসে সারি দিয়ে বসে গেছে সেখানে। সত্যিই এতো বড় মেলা মিঠি আগে কখনও দেখেনি। একটু এগোতেই মিঠি দেখলো ভেতরে সিমেন্ট বাঁধা রাস্তার ডান দিকে উঁচু এক বেদির ওপর কাঁচের বাক্সে একটা নারীর মূর্তি। সামনে একটা টেবিলের ওপর অনেকগুলো আধপোড়া মোমবাতি রয়েছে, কোনোটা জ্বলছে আর কোনোটার আগুন ফুরিয়ে গেছে। মূর্তিটার মুখের দিকে তাকাতেই মনটা খুব ভালো হয়ে গেল মিঠির, কি সুন্দর মা মা দেখতে মূর্তিটা! মুখটার দিকে তাকালেই যেন মনে হয় স্নেহ ভরা দৃষ্টি নিয়ে কাছে ডাকছে। মুর্তিটার দিকে তাকিয়ে যেন এক অজানা পৃথিবীতে চলে গিয়েছিল মিঠি, বাবার ডাকে সম্বিৎ ফিরল,
---- কিরে কি করছিস? সর, আমাকে সবটা ঠিক করতে দে।
---- বাবা
---- কিরে?
---- এটা ঠাকুর গো বাবা?
---- হুমম।
---- কি ঠাকুর গো?
---- আমি অতশত জানিনা। এ অন্য লোকেদের ঠাকুর, আমাদের জেনে কাজ নেই।
---- নমো করব না?
---- দরকার নেই। এখন নে আমাকে সাহায্য কর দোকানটা পাততে।
---- কি হল বাবা তুমি এখন এই ঠাকুরটাকে নমো করছো কেন? তুমিই তো বলেছিলে এটা আমাদের ঠাকুর নয়।
মেয়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে রাঘব বলল,
---- ভুল বলেছিলাম রে মা, ঠাকুর নিশ্চয় আমাদের সবার হয়। নয়তো বড়দিনের মেলার প্রথম দিনই এতো বেলুন বিক্রি হয়ে যায়! আজ অব্দি একদিনে কখনও আমার এত বেলুন বিক্রি হয়নি। এ ঠাকুরের আশীর্বাদ ছাড়া আর কি বলবো বল?
---- তাহলে বাবা আমিও নমো করব? আমারও না কাল প্রথম এসে ঠাকুরটা দেখে কি ভালো লেগেছিল,কি সুন্দর দেখলেই মা মা মনে হয়। সবার মা বোধহয় এক হয় বাবা, বুঝলে?
---- হ্যাঁ রে মা, প্রাণ ভরে প্রণাম কর। তারপর চল; শুনেছি বড়দিনে নাকি অনেক সুন্দর সুন্দর কেক পাওয়া যায়। আজ তোকে বড়দিনের কেক কিনে খাওয়াবো।
---- সত্যিই?
---- তিন সত্যি।
দু'হাত জোড় করে ওই মা ঠাকুরকে প্রাণ ভরে প্রণাম করল মিঠি, আর মনে মনে বলল মা আজ তোমার জন্য বহুদিন বাদে বাবার মুখে এতো হাসি দেখতে পেলাম, আর বাবাকে এতো কাছেও পেলাম কতদিন পর।