সাতরঙা বিজয়া
সাতরঙা বিজয়া
হ্যাঁ জানি তো আমাদের আবার দেখা হবে। না, আমি যাব না; তিনিই আসবেন আবার। একটা নিয়মরক্ষার নিমন্ত্রণ করতে হয় ঠিকই, তবে সময় মতো তিনি চলে আসেন। রক্ষা করার দায়িত্ব যখন ওনার, তখন সেই দায়িত্ব পালনে তিনি সবসময় তৎপর থাকেন। যদিও এবছর উনি ওনার কর্তব্য পালনে অনেকখানি ব্যর্থ বলেই মনে হয়; কিন্তু এই ব্যর্থতার সম্পূর্ণ দায়ভার আবার ওনার কাঁধে চাপানোটাও অনৈতিক কারণ তিনি এর আগে বহুবার নানারকম ভাবে সাবধান করলেও সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি তা স্বাচ্ছন্দ্যে উপেক্ষা করে গেছল। যাইহোক রাত বেড়েছে, বাড়ি ফিরতে হবে। রাস্তাঘাটের অবস্থা তো মোটেও ভালো না। বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে গা ভর্তি গয়না পরে রওনা দেওয়াটা বোধহয় সহজ কথা নয়! মানলাম তিনি আমাদেরকে রক্ষা করতে আসেন ঠিকই কিন্তু তিনিও ঝকমকে আলো ছাড়া দেখা তো দেন না। তাহলে কি অন্ধকারে তিনিও ভয় পান? নাকি তিনি তারই শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির কৃতকর্মে লজ্জিত হয়ে জলে গলে যাওয়ার রাস্তাটাই শ্রেয় বলে মনে করেন? একদিকে তিনি শান্তি বোধ করতেই পারেন, কারণ তিনি তো মাটির; চামড়ার নন। চামড়ার স্বাদের কারবারে এখন চতুর্দিক মাতোয়ারা। এখানে ছায়ার দৈর্ঘ্য দীর্ঘতর হয়েই চলেছে প্রতিরাতে, মায়ার বাঁধন ছিন্ন হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে, একটা নারী কায়াকে গ্রিলডে রেঁধে খেতে মনুষ্য জাতি হয়ে উঠেছে বেহায়া, এখানে তো আজও সদ্যোজাতকে কোলে নিয়ে মা রাস্তা পেরোন–রক্ত রেখে যায় সে দাগ, এখানে আজও পেটের ভাত জোগাড়ে শরীর হয়ে ওঠে পণ্য–সেখানে থাকে না কোনো অভিমান-রাগ। নবমী এলে মনখারাপের পাশাপাশি অনেক অভিযোগও উঠে আসে তোমার প্রতি। তোমার মন্ডপের বাইরে বসে অসহায় সত্তোরার্ধ বৃদ্ধাকে খাবার খুঁজতে হয়, তোমার মন্ডপের বাইরে দাঁড়িয়ে বেলুনওয়ালা দুটো বেলুন বিক্রি করে তার সন্তানের জন্য একটা এগরোলের দাম জোগাড় করে, তোমার মন্ডপের বাইরেই কিছু ক্ষণস্থায়ী ভালোলাগা মুহূর্তের মধ্যেই মিলিয়ে যায় নেশার গন্ধে, তোমার মন্ডপের বাইরেই কেউ হাত ছেড়ে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায় অন্য কোনো বন্দরে নোঙরের আশায়–তোমার মন্ডপে প্রচুর আশা জমে, পাহাড় তৈরী হয়ে যায়। তুমি সেসব ডিঙিয়ে চলে যাও নিজের ঠিকানায়।
আমার মা তোমাকে না খাইয়ে খায় না; অথচ তুমি কিন্তু আমার মা কোনোদিন না খেলে খোঁজ রাখো না। আমার প্রতিটা ব্যর্থতায় মা বুকে জড়িয়ে ধরে, তোমার স্পর্শ অধরাই চিরকাল। নিজেকে সান্ত্বনা দিতে এটা বলতেই পারি, পৃথিবীর সব মা এক - সেখানে দুর্গা বা আমার মা আলাদা নয়; কিন্তু তোমার জন্য আয়োজনের আড়ম্বরে সেজে ওঠে চারিপাশ অথচ তুমি মাত্র চারদিনের; আমার মা আমার সব জন্মের। ধরো যদি আজ তোমাকে আমি না ছাড়ি, বায়না করে বলি থেকে যাও কিন্তু তুমি তো আমার কথা রাখবে না কিন্তু আমার মা রাখে। তোমার কাছে আশা-অভিযোগ সব সমান, কোনোটাই তুমি শোনো না। আমাদের কি―দুদিন মনখারাপ, তিনদিনে বেঁচে থাকার আর বাঁচিয়ে রাখার দায় মাথাচাড়া দেয়। এমনিতেও আমরা স্বজনহারাতে দিনদিন অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, গা-সওয়া হয়ে গেছে।
কোনোবছর তুমি বৃষ্টিতে আসো, কোনোবছর আসো রোদে–কখনো তোমায় রোদ-বৃষ্টির খেলায় রামধনু হয়ে আসতে দেখলাম না। আগামী বছর পারলে রামধনু হয়ে ফিরে এসো–মাতৃস্নেহের পরশে আমরা বেঁচে থাকার উত্তাপ পাব।