সাম্রাজ্য - একটি রূপকথা
সাম্রাজ্য - একটি রূপকথা
১.
রৌদ্র কেমন ঝিকমিক করে উঠছে যেনো মরু হাওয়ার সাথে রৌদ্রের সোনালী স্রোতের লাভা গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বেশ কয়েক বছর যাবত গরম আবহাওয়া পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। আশ্চর্য বিষয় সমস্ত পৃথিবীই কি মরুভুমি হয়ে যাবে? ব্যাপার কি? এর প্রতিকারে মানুষ কি কিছুই করছে না - কিছুই করবে না? এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবী অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে নির্ঘাত। - বিশাল প্রকাণ্ড এক গর্জন গাছের চূড়ার বসে পরান আজকাল এই ধরনের উচ্চমানের চিন্তা ভাবনা করেন! মজার ব্যাপার হচ্ছে আজকাল ক্লান্ত দুপুরগুলোতে পক্ষী সমাজের সকল সর্দাররা পরানের কাছে অতীতের নানান অভিজ্ঞতার গল্প শুনতে চলে আসেন। গল্প শুনে শুনে শিহরিত হোন কখনো ভয়ে কখনো বা আনন্দে। আর শুনবেন না কেনো? পরান তো আর যেনোতেনো কোনো পাখি নন, সবার রাজা ঈগল! তাঁর বয়স ও অভিজ্ঞতাও বেশী, শারীরিক শক্ত অবকাঠামো, অত্যাধিক শক্তি, সাহসিকতা এদের বংশ পরম্পরা সম্পত্তি তাছাড়া দীর্ঘায়ু ও স্মরণশক্তি বেশী হওয়ায় পূর্ব পুরুষদের ব্যক্ত করা ঘটনা সহ গচ্ছিত হয়েছে অনেক অনেক বিরল ও সাহসিকতার অভিজ্ঞতা।
২.
পরান আজকাল খুবই বড় ধরনের এক চিন্তায় মগ্ন থাকেন যা শুধু পক্ষীকুলই নয় মানব সমাজ সহ সমস্ত প্রাণীকুলই বিপদের মুখে চলে যাচ্ছে। আর তাই হয়তো আজ অতীত আর পূর্বপুরুষদের খুবই মনে পড়ে। এ ধরনের সমস্যা তারা কিভাবে মোকাবেলা বা সমাধান করতেন? তাদের সময় এ ধরনের সমস্যা অবশ্যই হয়েছে কিন্তু পরান আজ এ ধরনের সমস্যার কথা দিনের পর দিন ভেবে ভেবে ক্লান্ত ও অবসন্ন বোধ করেন। আশ্চর্য বিষয়, অত্যাধিক চিন্তা থাকলে কি ঘুম আসে বেশী? হয়তোবা। দাদাজান ও বাবার সাথে আরো বেশী সময় সঙ্গ পেলে হয়তো এই ভয়ঙ্কর জটিল সমস্যার সমাধান সহজে বার করতে পারতেন। বাবা বেঁচে থাকলে আজ বড় সাহস পেতেন। হয়তো দ্রুত ও শক্ত সিদ্ধান্তও নেয়া সম্ভব হতো। বাবার জন পরানের খুবই মন খারাপ লাগে আর তখনই নিজেকে খুব একা লাগে।
৩.
ইদানিং বিদেশ হতে প্রচুর বিদেশী পাখি চলে আসছে যা পক্ষিকুলের সঠিক আইন মেনে চলছেনা এবং সাথে তাল মিলাচ্ছে সমাজ বর্হিভূত কিছু পাখি তার মধ্যে অন্যতম কোকিল ও ময়না। এছাড়া মানুষ এই সকল বিদেশী পাখিদের খুবই কদর করছে বিশেষ করে নানান বড় বড় বিল, ঝিল, নদী, হাওড় এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের জন্য অভয়ারণ্য ও অভয়াশ্রম বলে ঘোষণা করেছে! কি অদ্ভুৎ! বিদেশী এই পাখিগুলো যখনই আসছে সাথে করে নিয়ে আসছে খুবই খারাপ ধরনের মহামারী রোগ! এখানকার পক্ষীকুল এ ধরনের রোগ বা মহামারীর সাথে পরিচিত নয় তাই দিন দিন এখানকার পাখি বিলুপ্ত প্রায়। পরানের বিশ্বস্ত ডান হাত দোয়েল আর বাবুই আর শক্তিশালী বিশ্বস্ত শকুন প্রায় বিলুপ্ত বললেই চলে। গৃহপালিত হাঁসমোরগ সমাজ কাকের মাধ্যমে প্রতিদিন খবর পাঠাচ্ছেন। অন্যান্য সবাই বিপদগামী তাছাড়া মানুষও যে বিপদে নেই তা কিন্তু নয় সবচেয়ে বড় বিপদই হবে মানব সমাজের জন্য! কিন্তু মানুষের স্বল্প জ্ঞান আর স্বল্প আয়ূতে অতীত অভিজ্ঞতা স্মরণ না থাকায় হয়তোবা বুঝতেও পারছেন না! তাছাড়া পক্ষীরাজ ঈগল মানুষের সাথে যোগাযোগের কোনো মাধ্যম খোঁজে পাচ্ছেন না! ভরসা ছিলো ময়না, কিন্তু যখনই মানুষের সাথে ময়নার যোগাযোগের কোনো না কোনো ভাবে মাধ্যম তৈরি হয়েছে ময়না’ পক্ষী সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন করে পাখিদের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে! আর এ জন্য মানুষের সাথে যোগাযোগ করার মাধ্যম কোনোভাবেই তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না।
৪.
এরমধ্য সবচেয়ে বড় সমস্যা যা, তা হচ্ছে নিজে টিকে থাকা। এর সমাধান আগে প্রয়োজন। বিদেশী পাখি দেখতে রঙ বেরঙ সহ ভিন্ন ভিন্ন দেশ ঘুরে এদের আমলাতান্ত্রিক জ্ঞান যথেষ্ট বেশী বলা চলে। এদের পাল্লা দিন দিন ভারী হচ্ছে এর একটা ব্যবস্থা না নিলে নিজ অস্তিত্ব নিয়েই এখন প্রশ্ন হয়ে দাড়াবে। আসলে নিজে টিকে থাকতে হবে এটিই আসল কথা। ঈগল দিন দিন কমে যাচ্ছে। ছোট ছোট শত্রু এক হয়ে ঈগলদের অনেক ক্ষতি করে দিয়েছে বিশেষ করে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ পরানের ছোটভাই জুরান, ধীরান ও নীরান। শত্রুর আগ্রাসনে এতো ক্ষতি হয়েছে যে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে বললেও খুবই কম বলা হয়। এলাকায় প্রচুর বিদেশী পাখির আগ্রাসন এখন বড় ধরনের সমস্যা ও হুমকি তৈরি করেছে। জুরান খুবই সমস্যায় আছে যা প্রতিদিন দোয়েল ও বক, চিলের মাধ্যমে পরানের কাছে খবর পাঠাচ্ছেন। জুরান ধীরান ও নীরানের শত্রু দিন দিন যেভাবে ভারী হচ্ছে যে কোনো সময় এলাকা দখল করে নিতে পারে যা ঈগল রাজ্যর জন্য বিপদজনক। বিদেশী পক্ষীকুল এখন কিভাবে দখলদারী করে যাচ্ছে তা খুবই ভাবনার বিষয় হয়ে দাড়াচ্ছে দিনকে দিন।
৫.
কয়েকদিন যাবত নিম্নচাপের কারণে পরিবেশ আর বাতাস খুবই খারাপ অবস্থা আর ঘন ও ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। পরান গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ছোটভাই জুরান, ধীরান ও নীরান সহ সকল পক্ষীকুল সমাজের সর্দারদের জরুরী তলব পাঠিয়েছেন। পক্ষীরাজ ধীরান অপরুপ টিয়া সমাজ নিয়ন্ত্রণ করেন, টিয়া ধীরানের দ্বারা সবসময়ই উপকৃত, অপরূপ টিয়া দ্বারা বিদেশী পাখিদের ফাঁদে ফেলা হয়তো সম্ভব। তাছাড়া কাক ও কবুতর শত্রু দ্বারা নিয়ন্ত্রণহীন হলেও এখনও জুরানের অধিনেই আছে। আর বক সমাজ নিয়ন্ত্রণ করছেন নীরান। বকেরও খুব খারাপ সময় যাচ্ছে বিদেশী মহামারী রোগে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছে হাজারো প্রাণ! যেই খবর পরানের কানে প্রতিনিয়তই আসছে।
৬.
নিকষ কালো আধারের অমাবস্যার নিঃশব্দ থমথমে রাত। থেমে থেমে পরানের বিশ্বস্ত গোয়েন্দা - পেঁচা সর্দার জঙ্গলের সীমানা প্রাচীর গাছে বসে গম্ভীর আওয়াজ দিয়ে আরোও ভুতুরে ভয়ার্ত পরিবেশ তৈরি করে যাচ্ছে। পরান কেওক্রাডং পাহাড়ের চূড়ায় বড় একটি পাথরের উপর দাড়িয়ে অপেক্ষা করছেন। ছোটভাই জুরান, ধীরান আর নীরানের কাছে খবর পৌছে গিয়েছে। এখন যতো রাতই হোক বড়ভাই পরানের ডাকে সবাই এখানে আসবেনই। - আসতেই হবে আর এই বিশ্বাসেই পরান কেওক্রাডং পাহাড়ের চূড়ায় হাজার বছরের পুরোনো বৃষ্টিতে ভেঁজা রৌদ্রে পোড়া লালাভ পাথর সারথি ‘র উপর দাড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অনেক অনেক দূর পথ আকাশের অন্ধকার পানে তাকিয়ে আছেন। - এখানে এই পাথর সারথি’তে বিশেষ বিশেষ সময়ে পূর্বপুরুষরা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন। আজও কোনো কঠিন সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় পরানের বিশ্বস্ত দূরদৃষ্টি ধারী শকুন সর্দার তার দল নিয়ে বেশ কিছু দূরে গম্ভীর পায়চারি করছেন। আর পরানের বিশ্বস্ত চিল সর্দার ও তার দল দ্রুত পাহাড়ের চারোদিকে ঘুরে একটি নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করে রাখছেন। পাহাড়ের ঢালের জঙ্গলে অবস্থিত ছোট বড় সকল পক্ষীকুল ভয়ে থর-থর করে কাঁপছেন। কেউ কিছুই জানে না - শুধু বুঝতে পারছে এখানে কিছু একটা হবে, ভয়ঙ্কর কিছু। এতোদিন যা শুধু দাদী নানীদের কাছে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর সব ঈগল সাম্রাজ্যর রূপকথার গল্প শুনে এসেছে। শতবছরে যা কদাচিৎ হয়, হয়তোবা তেমন কিছু। ঈগল সাম্রাজ্য শত বছরের জন্য গঠন হয় আর সচরাচর এদের যুদ্ধ বিগ্রহ হয়না বললেই চলে আর যখন যুদ্ধ হয় তখন প্রবল রক্তপাতের সাথে শত্রুদের সমূলে বিনাস করা হয়।
৭.
পক্ষীরাজ ঈগল পরান খানিকটা এগিয়ে আসেন, নিকষ কালো আধারের অমাবস্যার অন্ধকারের মধ্যেও যেনো দূরে কিছু দেখতে পাচ্ছেন - কিছু শুনতে পাচ্ছেন! দূরদৃষ্টি ধারী শকুন সর্দার আশ্চার্য হোন কিছুই দেখতে না পেয়ে! - পরান পরিস্কার দেখতে পান তিন জোড়া সুবিশাল শক্তিশালী ডানার আওয়াজের সাথে তিনটি ঈগল ধেয়ে আসছে কালো আকাশে।
ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত হবে আজ, ঈগল রাজ আর পক্ষীকুলের অস্তিত্ব নিয়ে ভয়ঙ্কর কিছু হবে।